অমীমাংসিত ‘অপ্রদর্শনযোগ্য’ ও অনন্তকালের তদন্ত নিয়ে কিছু কথা
সাংবাদিক মেহেরুন রুনি এটিএন বাংলায় আমার সহকর্মী ছিলেন। যেদিন রাতে তিনি খুন হন সেদিন সন্ধ্যায়ও তিনি আমাকে 'যাই রে...' বলে অফিস থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য সেটাই ছিল তার শেষ যাওয়া। এরপরের ঘটনা সবারই জানা, পূর্ব রাজাবাজারের ফ্ল্যাটে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি অত্যন্ত নির্মম ও নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক মেহেরুন রুনি ও সাগর সরওয়ার।
আলোচিত এই খুনের রহস্য উন্মোচনে সরকার জোরালো আশ্বাস দিলেও এক যুগে খুনিদের টিকিটিও স্পর্শ করা যায়নি। তদন্তই শেষ হয়নি হাই-প্রোফাইল এই মামলার। চলতি মাসের শুরুতেই এই মামলার তদন্তে ১০৮তম বারের মতো সময় বাড়িয়েছেন আদালত। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন ১০৮তম বার। এই সময় বাড়ানোর সিলসিলা কোথায় গিয়ে যে শেষ হবে, তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারবেন।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত ও রহস্যজনক ঘটনা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে মানুষের আগ্রহ ও জল্পনার শেষ নেই। মানুষ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এই হত্যাকাণ্ডের মোটিফ জানতে চান, হত্যাকারীদের পরিচয় জানতে চান। কিন্তু দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ সীমাহীন অদক্ষতা ও নির্লিপ্ততায় বার বার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে সময় নিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টতই কালক্ষেপণ করছে। বিষয়টি এক যুগ ধরে 'অমীমাংসিত' থাকায় মানুষও আছে এক ধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে।
এ ধরনের 'অমীমাংসিত' এক ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মাতা রায়হান রাফী 'অমীমাংসিত' নামে একটি ওয়েবফিল্ম নির্মাণ করেছেন। কিন্তু এটি দর্শকদের সামনে প্রদর্শন উপযোগী নয় বলে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। ২৪ এপ্রিল পরিচালককে দেওয়া এক চিঠিতে ছাড়পত্র না দেওয়ার পেছনে চারটি সুনির্দিষ্ট কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে- চলচ্চিত্রটিতে নৃশংস খুনের দৃশ্য আছে, কাল্পনিক কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপের বিষয়বস্তুর সঙ্গে বাস্তবতার মিল আছে। এ ছাড়া, চলচ্চিত্রটির কাহিনী/বিষয়বস্তু বিচারাধীন মামলার সঙ্গে মিল থাকায় ভুল বার্তা দিতে পারে। যাতে বিঘ্ন ঘটতে পারে তদন্ত।
'অমীমাংসিত' আটকে দেওয়ার এই কারণগুলো দেখে মনে কয়েকটি প্রশ্ন জেগেছে। চলচ্চিত্রে নৃশংস খুনের দৃশ্য কি পরিচালক রায়হান রাফী প্রথম যুক্ত করলেন, নাকি এর আগেও ভয়াবহ খুনের দৃশ্য সম্বলিত চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড পার হয়েছে? কাল্পনিক কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপের সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকার বিষয়টিও হাস্যকর। একজন সৃষ্টিশীল নির্মাতার কাজই তো বাস্তব যে ঘটনার বিষয়ে মানুষের আগ্রহ আছে সেটি নিয়ে কাজ করা। যাতে নতুন চিন্তার খোরাক তৈরি হয়। আর বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে ভুল বার্তার বিষয়টিও যুক্তিতে টেকে না। কারণ সংবেদনশীল এই মামলাটি সম্পর্কে 'পাবলিক পারসেপশন' ১২ বছর ধরেই তৈরি হয়ে আছে। যা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জন্য সুখকর নয়। আমার ধারণা, বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন- এই ঘটনার সঙ্গে হয়ত রাঘব-বোয়ালরা জড়িত অথবা এই মামলাতে এমন কিছু আছে, যা কৌশলে চেপে রাখা হয়েছে।
'অমীমাংসিত' আটকে দেওয়ার খবরে আমার দুটি ঘটনা মনে এসেছে। প্রথমত: নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর 'শনিবার বিকেল' চলচ্চিত্রের কথা। গুলশানে হোলি আর্টিজান হামলা নিয়ে তৈরি এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে পরিচালকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। শেষ দিকে মনে হয়েছে, অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে সিনেমাটিকে আলোর মুখ দেখাতে হয়েছে। আর মনে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রয়াত এক জ্যেষ্ঠ নেতার কথা। আমি তখন এটিএন বাংলায় কাজ করি। ওই নেতা তখন ১৪ দলের সমন্বয়ক। রাজনৈতিক একটি বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎকার রেকর্ড শেষে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম- সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে। তিনি খুবই আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, কেন যে এই মামলাটা শেষ করা হচ্ছে না, সেটা তারও বোধগম্য নয়। তার দাবি ছিল, এই মামলা ঝুলিয়ে রাখায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে আওয়ামী লীগের। আর কারও নয়। তার যুক্তিটাকে আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল।
যাই হোক মামলা তদন্তে ১০৮তম বার সময়ে নেওয়া হয়েছে। জনমত প্রভাবিত হতে পারে, মানুষের মাঝে ভুল বার্তা যেতে পারে, সেই চিন্তায় 'অমীমাংসিত' আটকে দেওয়া হয়েছে। হয়ত আগামীতেও এই মামলা নিয়ে আরও অনেক কিছুই ঘটবে। এত কিছু না করে আলোচিত এই মামলাটির জট খুললেই কিন্তু অনেক কিছুর সমাধান হয়ে যেত। দল হিসেবে ক্ষমতাসীনরা দায়মুক্ত হতো, সরকারও দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছে বলে দাবি করতে পারতো। কিন্তু কোথায় যেন সবকিছু আটকে আছে। অদৃশ্য সুতার টানে কোনো কিছুই এগুচ্ছে না। যা নিয়েই রহস্য। যে রহস্য সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেওয়া কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আলোচিত একটি হত্যা মামলা সম্পর্কে সবশেষ তথ্য জানা, খুনিদের নাম পরিচয় জানতে চাওয়া, মোটিফ সম্পর্কে জানতে চাওয়া প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকার। এই অধিকার থেকে মানুষ আর কতদিন বঞ্চিত হবে? এরইমধ্যে এক যুগ পার হয়েছে। আর কত দেরি, পাঞ্জেরি!
আর একটি কথা। বিস্তৃত পরিসরে চলচ্চিত্র কিন্তু গণযোগাযোগের মাধ্যম। বেশ কার্যকর, বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম। নানা অজুহাতে এই মাধ্যমের আধেয় আটকে রাখা ভালো কোনো বার্তা দেয় না। তাই চলচ্চিত্র আটকে দেওয়ার বিষয়টি আরও পরিষ্কার ও যৌক্তিক হওয়া উচিত। এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবেই আরও স্বচ্ছতার প্রয়োজন।
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments