‘শনিবার বিকেলের কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই’
'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে' এমন অভিযোগে মোস্তাফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত 'শনিবার বিকেল' সিনেমাটির বাংলাদেশে মুক্তি আটকে দিয়েছে সেন্সর বোর্ড। ২০১৮ সালে নির্মিত সিনেমাটি ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে।
ফারুকী বলছেন, প্রথম প্রিভিউয়ের পর সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়া কথা শুনতে পেলেও দ্বিতীয় প্রিভিউ করে তা আটকে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে নিয়ম অনুযায়ী এ বিষয়ে আপিল করা হয়। সিনেমার পক্ষে আপিল বোর্ডে প্রতিনিধিত্ব করেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু।
সিনেমাটির বিষয়ে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু সম্প্রতি বলেছেন, 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়টি একেবারেই মিথ্যা একটি উক্তি। আমি ৩ বার সিনেমাটি দেখেছি। এই সিনেমাটি জঙ্গিবাদ, নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ।'
আপিলের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'আমার সব যুক্তি তুলে ধরার পর চেয়ারম্যান বললেন, "আপনার সব যুক্তি সঠিক। তবে আমি তাৎক্ষণিক কোনো ফলাফল দিতে পারব না। ছবিটিকে উপর মহলে প্রেরণ করব।"'
এরপর প্রায় সাড়ে ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও 'শনিবার বিকেল' বিষয়ে কোনো সমাধান হয়নি।
বাংলাদেশ, ভারত ও জার্মানির যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত 'শনিবার বিকেল' সিনেমায় অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ইয়াদ হুরানি, এলি পুসো, সেলিনা ব্ল্যাক, রাহাত রহমান, নাদের চৌধুরী, ইরেশ যাকের, মামুনুর রশীদ, ইন্তেখাব দিনার, মনোজ কুমার প্রামাণিক, গাউসুল আলম শাওন প্রমুখ।
সিনেমাটিতে 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন' হওয়ার মতো কী ছিল জানতে চাইলে সিনেমাটির একজন অভিনেতা ও বিশিষ্ট নাট্যকার মামুনুর রশীদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই সিনেমার কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা চমৎকার একটি সিনেমা। এটাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে সেই প্রশ্ন আমারও। এই সিনেমা মুক্তি দিলে আমাদের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হতো। কিন্তু তারা চিন্তা করলেন একেবারে উল্টো।'
'এমন সিদ্ধান্ত শিল্পকে সংকুচিত করা' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'সিনেমার আঙ্গিকগত দিক থেকেও এই সিনেমাটি অনেক উন্নত। এটি একটি ওয়ান শট ফিল্ম বা আনকাট ফিল্ম। প্রায় ১২ দিন রিহার্সাল করে তারপরে আমরা একটা শটে এই সিনেমার শুটিং করেছি। এমন সিনেমা পৃথিবীতে খুব কম হয়।'
সেন্সর বোর্ড বিষয়ে তিনি বলেন, 'সেন্সর বোর্ড উঠিয়ে দেওয়া উচিত। আমাদের দেশেও সার্টিফিকেশনের দিকে যাওয়া উচিত। সেখানে শুধু বলা হবে, এই সিনেমাটি এই বয়সের দর্শকদের জন্য। কতদিন আর সেন্সর বোর্ড থাকবে। সেন্সর শব্দটিই একটি উপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদী শব্দ। আর্মি রুল এলে সেন্সর আসতো, ব্রিটিশরা সেন্সর দিত, খবরে সেন্সর—আমরা এমন অনেক সেন্সরে ভুগেছি।'
'শনিবার বিকেল' সিনেমাটি যে সেন্সর বোর্ড প্রিভিউ করেছিল সেই বোর্ডের সদস্য ছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিবেশক ও প্রদর্শক মো. ইফতেখারউদ্দিন নওশাদ। 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন' হওয়া প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়টি এই সিনেমায় ছিল বলেই সেটার সেন্সর সার্টিফিকেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু এটাই নয় "রানা প্লাজা"ও একই কারণে বন্ধ রাখা হয়। তখন আমি একটি বোর্ডের অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্তে একমত হয়েছিলাম, এখনও সেই বিষয়ে একমত আছি।'
সিনেমার সার্টিফিকেশনের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে সার্টিফিকেশনের ব্যাপারটি খুবই প্রয়োজন। বাচ্চাদের নিয়ে সিনেমা দেখতে গেলে তারা তো সেটা শিখবে। গালির জায়গায়গুলো টুট টুট আওয়াজ দিলেই এখন সিনেমাটি ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু, সার্টিফিকেশনের বিষয় হলে তখন বাচ্চাদের আর নেওয়া হবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা চালু করা খুবই জরুরি। এর জন্য নীতিমালা করা হয়েছে। কিন্তু এখনও কেন চালু করা হচ্ছে না তা বুঝতে পারছি না।'
২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য অরুণা বিশ্বাস। 'শনিবার বিকেল' সিনেমাটিতে 'ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন' করার মতো কী আছে জানতে চাইলে অরুনা বিশ্বাস বলেন, 'সিনেমাটির যখন প্রিভিউ হয় তখন আমি সেন্সর বোর্ডে ছিলাম না। কাজেই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।'
সিনেমা সার্টিফিকেশনের যুগে সেন্সর বোর্ড থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, 'শুনেছি সার্টিফিকেশনের বিষয়ে কাজ চলছে। কবে নাগাদ সেটা বাস্তবায়ন হবে সেটা জানি না। আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তাল মেলাতে সার্টিফিকেশনের ধারা অবশ্যই প্রয়োজন। সেন্সর বোর্ড না থেকে যদি সার্টিফিকেশন বোর্ড হয় তাহলে নিশ্চই সেটা সমসাময়িক বিশ্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে।'
শিল্পে সেন্সরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'প্রতিটি দেশেরই তো কিছু নিয়ম থাকে, সেই ধারায় সেন্সর বোর্ড কাজ করছে। ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে বলতে পারি, সৃষ্টিশীল কোনো কিছুকেই আটকানো যায় না, আটকানো উচিত না।'
জয়া আহসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ থেকে সেন্সর বোর্ড উঠে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে এটা ফাঁসির দড়ির মতোই চলচ্চিত্রের গলায় চেপে বসছে। চলচ্চিত্রের গল্প তো প্রেসক্রিপশন নিয়ে হতে পারে না। চলচ্চিত্রের গল্প হবে চূড়ান্ত কল্পনা, নিরেট বাস্তব, বাস্তব থেকে অনুপ্রাণিত কল্পনা—যেকোনো কিছু।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা চলচ্চিত্রের মুক্তি চাই, শিল্পের মুক্তি চাই। কারণ আমরা মানুষের মুক্তি চাই।'
গত ১২ আগস্ট ফারুকী তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ঘোষণা দেন, 'আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যদি শনিবার বিকেলের ছাড়পত্র না পাই, তাহলে আমরা আদালতের কাছে যাবো।'
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারে এক কলামে চলচ্চিত্র নির্মাতা আশফাক নিপুণ লিখেছেন, '"শনিবার বিকেল" সিনেমা দেখে আমরা হাসবো নাকি কাঁদবো নাকি ভাববো—সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে দেন। ভাবমূর্তি নাকি অভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, সেটা আমাদের বুঝতে দেন। জোর-জবরদস্তি করে আর কাউকে হোক না হোক,এই জাতিকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না, এটা ইতিহাসেই প্রমাণিত। কাজেই অবিলম্বে "শনিবার বিকেল" ছবির মুক্তি চাই এবং শিল্পে সেন্সরশিপ প্রথা বাতিল চাই।'
Comments