সাংবাদিক খুনের ঘটনা নিয়ে সিনেমা হতে পারবে না?
মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভাকিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জ্যান কুচিয়াক ও তার বাগদত্তা মার্টিনা কুশনিরোভার হত্যার ঘটনা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র 'দ্য কিলিং অব এ জার্নালিস্ট' মুক্তি পায় ২০২২ সালে। ওই বছর সারাবিশ্বে গণমাধ্যম সম্পর্কিত যে সিনেমাগুলো মুক্তি পায়, তার অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র বলে এটিকে বিবেচনা করা হয়।
২৭ বছর বয়সী কুসিয়াক ও কুসনিরোভা, দুজনকেই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গুলি করে হত্যা করা হয়। সহকর্মীদের বিশ্বাস, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মারিয়ান কোচনারের নির্দেশে তাদের খুন করা হয়। কেননা ওই সময় কুসিয়াক সংবাদ ওয়েবসাইট অ্যাকচুয়ালিটি ডট এসকের জন্য কোচনারের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান করছিলেন।
এই হত্যাকাণ্ড ১৯৮৯ সালের ভেলভেট বিপ্লবের পর স্লোভাকিয়ায় সবচেয়ে বড় বিক্ষোভের জন্ম দেয়। পরিণামে পুলিশ বাহিনীর প্রধানসহ সরকারি কর্মকর্তারা একেরপর এক পদত্যাগ করতে থাকেন। আর অ্যাকচুয়ালিটি ডট এসকে-এর সহকর্মীদের কাছে হত্যাকাণ্ডের পুলিশী তদন্ত নথি ফাঁস হলে স্লোভাকিয়ায় দুর্নীতির পুরো চিত্র সর্বসাধারণের সামনে উন্মোচিত হয়। রিপোর্টাররা বলেন, ফাইলগুলো দেখায় যে, কোচনার কীভাবে বিচারক, রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের শাসাতেন ও ভয়ভীতি দেখাতেন। (গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক- জিআইজেএন)।
বাংলাদেশে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকেও খুন করা হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০১২ সালে। যে রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। প্রতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি তাদের হত্যা বার্ষিকীতে সাংবাদিকরা রাজপথে নেমে মানববন্ধন করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ১০৯ বার সময় নিয়েছে। সবশেষ গত ২ এপ্রিল ছিল প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম ওইদিনও প্রতিবেদন দাখিল করতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়সীমা আগামী ১৬ মে পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। এর আগে, দুটি পৃথক আদালত তদন্ত এবং হত্যার পেছনের উদ্দেশ্য উদঘাটন এবং প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তারে তদন্তকারীদের ব্যর্থতার জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করেন। (ডেইলি স্টার, ২ এপ্রিল ২০২৪)।
এরকম বাস্তবতায় 'অমীমাংসিত' নামে একটি সিনেমা সেন্সর বোর্ডে আটকে যাওয়ার খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। খবরে বলা হয়, বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিলে গেছে এমন কারণ দেখিয়ে রায়হান রাফী পরিচালিত এই সিনেমাটি আটকে দিয়েছে সেন্সর বোর্ড। বলা হচ্ছে, এই সিনেমার ঘটনার সঙ্গে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার মিল রয়েছে।
যে চারটি কারণ দেখিয়ে সিনেমাটির ছাড়পত্র আটকে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো- (১) চলচ্চিত্রটিতে নৃশংস খুনের দৃশ্য রয়েছে; (২) কাল্পনিক কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপের বিষয়বস্তু বাস্তবতার সঙ্গে মিল রয়েছে; (৩) এ ধরনের কাহিনী বাস্তবে ঘটেছে এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন এবং (৪) চলচ্চিত্রটির কাহিনী/বিষয়বস্তু বিচারাধীন মামলার সঙ্গে মিল থাকায় ভুল বার্তা দিতে পারে এবং তদন্তে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। (ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি, ২৫ এপ্রিল ২০২৪)।
কী অদ্ভুত যুক্তি! অপরাধবিষয়ক বা থ্রিলার মুভিতে খুনের দৃশ্য থাকবে না? বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিল রেখে কোনো সিনেমা বানানো যাবে না? সিনেমায় কী দেখানো হলো, সেটি কী করে তদন্তে বিঘ্ন ঘটাতে পারে? এক যুগেও যে হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী— এই সিনেমা তাদের তদন্ত কাজে বিঘ্ন ঘটাবে, এটি কতটা বাস্তবসম্মত? এমন অদ্ভুত ও উদ্ভট চিন্তা কী করে সেন্সর বোর্ডের মাথায় এলো? শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতা সম্পর্কে তাদের ন্যূনতম কোনো ধারণা আছে? এখন যে একুশ শতক— সেটি তারা ভুলে গেছেন? সারা পৃথিবীতে কীভাবে সিনেমা তৈরি হয় এবং কোন প্রক্রিয়ায় সেগুলো মুক্তি পায়, সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা আছে? প্রতিবেশী ভারতের বলিউড তো বটেই, কলকাতায় অর্থাৎ টালিউডেও যে কত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সিনেমা হয় এবং সেসব সিনেমায় ধর্ম ও রাজনীতির নানা বিষয়ে যে কত সাহসী সংলাপ থাকে— সেগুলো তারা দেখেন?
সেন্সর বোর্ড 'দ্য কোড ফর সেন্সরশিপ অব ফিল্মস ইন বাংলাদেশ, ১৯৮৫' এর ১-এ বর্ণিত যেসব উপাদান 'অমীমাংসিত' সিনেমায় আছে বলে একে আটকে দিয়েছে, সেই আইন ও বিধান একুশ শতকের সঙ্গে কতটা প্রাসঙ্গিক, কতটা যৌক্তিক এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কতটা উত্তীর্ণ— সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে পুরোনো ধ্যান-ধারণা ও চিন্তার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে— এমন আইনও বদলানোর সময় এসেছে। সারা পৃথিবীতে কী ধরনের সিনেমা হয় এবং সেখানে কী থাকে; উন্নত বিশ্বে সিনেমা মুক্তির প্রক্রিয়া কী এবং সেখানে সিনেমার ছাড়পত্রের পদ্ধতিগুলো কেমন— তাও খতিয়ে দেখা দরকার। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়।
প্রশ্ন হলো, সাগর-রুনি হত্যার সঙ্গে মিলে যাবে বলে এই ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানানো যাবে না? সেনানিবাস এলাকায় খুন হয়েছেন বলে কলেজছাত্রী তনুকে নিয়ে কোনো গল্প বা উপন্যাস লেখা যাবে না বা তাকে নিয়ে কোনো সিনেমা তৈরি করা যাবে না? নারায়ণগঞ্জে র্যাবের কতিপয় সদস্যের হাতে লোমহর্ষক সাত খুনের ঘটনা নিয়ে কোনো সিনেমা বানানো যাবে না? সত্য ঘটনার সঙ্গে মিলে গেছে— এমন অদ্ভুত অভিযোগে সেন্সর বোর্ড সেটি আটকে দেবে? বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো ভয়াবহ ঘটনা ইউরোপ-আমেরিকায় তো বটেই, ভারতে হলেও এই ঘটনা নিয়ে এতদিনে দুর্দান্ত সিনেমা তৈরি হয়ে যেতো এবং সেটি দারুণ ব্যবসা সফলও হতো। কিন্তু আমাদের দেশে রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে সিনেমা হলে নিঃসন্দেহে সেন্সর বোর্ড 'দেশের ভাবমূর্তি' ক্ষুণ্নের অভিযোগে সেটি আটকে দিতো! তার মানে কি সত্য ঘটনা অবলম্বনে সিনেমা হতে পারবে না? সিনেমা হবে সব কাল্পনিক ঘটনা নিয়ে? আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো সিনেমা হতে পারবে না?
সরকার বা সেন্সর বোর্ড কি তাহলে এখন কোন কোন বিষয়ে সিনেমা বানানো যাবে না, তার একটি তালিকা তৈরি করে দেবে? সেই ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতে উপন্যাসিক ও গল্পকাররা কোন কোন বিষয়ে গল্প-উপন্যাস লিখতে পারবেন না বা লিখলেও কোনো পত্রিকা বা প্রকাশক সেগুলো ছাপতে পারবেন না— তারও তালিকা তৈরি করে দেবে? ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে এরকম ঘটনা ঘটলেও তাতে বিস্মিত হওয়া যাবে না...।
স্মরণ করা যেতে পারে, দীর্ঘ চার বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে আটকে ছিল মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সিনেমা 'শনিবার বিকেল'। অভিযোগ, এই সিনেমার পটভূমি হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। যদিও পরিচালক বরাবরই এ কথা অস্বীকার করেছেন। প্রশ্ন হলো, যদি হলি আর্টিজানের সঙ্গে এই সিনেমার পটভূমির মিল থাকেই, তাতেই বা সমস্যা কী? ভারতের মুম্বাইয়ে হোটেল তাজে জঙ্গি হামলা নিয়ে 'দ্য অ্যাটাক অব ২৬/১১' নামে সিনেমা হয়নি? নানা পাটেকরের অনবদ্য অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সেটি কি একটি শিল্পোত্তীর্ণ এবং একইসঙ্গে একটি ব্যবসা সফল সিনেমা হয়নি? সে দেশের সেন্সর বোর্ড কি এই সিনেমা আটকে দিয়েছে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ পৃথিবীর আরও অনেক বড় ঘটনা নিয়ে অসংখ্য সিনেমা হয়েছে। তার মধ্যে কয়টি সিনেমা সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছে? একই বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন নির্মাতা, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সিনেমা বানিয়েছেন এবং এটিই স্বাভাবিক। কারণ বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপ্তি বিশাল। শুধু হিটলারের শেষ কয়দিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়েও একাধিক সিনেমা হয়েছে। সুতরাং হলি আর্টিজানের ঘটনাটি কী ছিল, সেটি বের করে আনা গোয়েন্দা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কাজ। তাদের বলা ও লেখার ভঙ্গি একরকম। কিন্তু সেই একই বিষয় নিয়ে যখন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা গল্প বলবেন, তখন সেটির বয়ান অভিন্ন নাও হতে পারে। তিনি ওই বিরাট ঘটনার খুব সামান্য একটি অংশ নিয়ে দুই আড়াই ঘণ্টার একটা ভিজ্যুয়াল বানাতে পারেন। এমনকি ওই বিশাল ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষের মধ্য থেকে স্রেফ একজন মানুষকে নিয়েই সিনেমাটা বানাতে পারেন। এখানেই সাংবাদিকতা ও সিনেমার পার্থক্য। একই কথা 'অমীমাংসিত' সিনেমার ক্ষেত্রেও।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
Comments