সোমালিয়ান জলদস্যু এবং সমুদ্রে জাহাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা

এমভি আব্দুল্লাহ। ফাইল ছবি সংগৃহীত

গাড়ি, জাহাজ, উড়োজাহাজ—সবই যানবাহন। ঢাকা থেকে একটি গাড়ি চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে কখনো কোনো নিরাপত্তারক্ষী সঙ্গে নেয় না। এমন অবস্থায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী একটা গাড়ি কুমিল্লায় থামিয়ে সহজেই লুণ্ঠন করা যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে করণীয় কী?

বাস মালিক ইচ্ছা করলে সব বাসে কয়েকজন অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী রাখতে পারেন। অথবা সরকার পুরো রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। প্রাচীন যুগে দেখা যেত কোনো ক্যারাভান কনভয়ের দায়-দায়িত্ব পরিবহন মালিক বা সমিতি নিয়ে নিত। আধুনিক যুগে সবাই দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করে। রাষ্ট্র পুরো রাস্তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। তবে এখনো ব্যাংকের টাকা পরিবহন করার জন্য কিংবা কোনো অতি মূল্যবান সামগ্রী পরিবহনের সময় নিজ উদ্যোগে আলাদা নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করা হয়।

এ হলো একটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিবহনের ক্ষেত্রে কী করা যায়? ধরা যাক, ভারত থেকে ট্রাকে করে মূল্যবান কোনো মালামাল পরিবহন করা হচ্ছে, যা পথিমধ্যে লুণ্ঠন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে মালিক চিন্তা করল ট্রাকে দুজন অস্ত্রধারী রক্ষী রাখা হবে। ভারতে তাদের অনুমতি রয়েছে অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করার। কিন্তু বাংলাদেশ কি তাদের অনুমোদন দেবে?

কখনোই না। আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে কেউ অস্ত্র নিয়ে আরেক দেশে প্রবেশ করতে পারে না। এজন্য বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে যে কেউ গাড়ি নিয়ে চলাচল করতে পারে। কিন্তু কেউ যদি গাড়ি এসকর্ট করার জন্য একটি সামরিক যান ব্যবহার করে, তাকে আলাদা অনুমতি নিতে হবে।

উড়োজাহাজ আন্তর্জাতিক পরিবহন। যাত্রাপথে কেউ সেটা হাইজ্যাক করতে পারে। কিন্তু কোনো বাণিজ্যিক উড়োজাহাজে অস্ত্র পরিবহন করা সম্ভব না। এমনকি কোনো অস্ত্রধারী গার্ডও রাখা হয় না। পথিমধ্যে যে কেউ একটি বিমান থামিয়ে লুণ্ঠন করতে পারে। কিন্তু তা কি সম্ভব?

সম্ভব না। কারণ একটি গাড়ির মতো রাস্তায় উড়োজাহাজ থামিয়ে লুণ্ঠন করা সম্ভব না। একটি উড়োজাহাজ যখন যে দেশের উপর দিয়ে যাবে, যে দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করবে, আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী সে দেশ তার নিরাপত্তা দেবে।

উড়োজাহাজের মতোই একটি আন্তর্জাতিক পরিবহন জাহাজ। জাহাজ নিজেই সুরক্ষিত। চাইলেই সহজে কেউ একটি জাহাজ থামিয়ে লুণ্ঠন করতে পারে না। তাই আন্তর্জাতিক পরিবহনে জাহাজ কোনো নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া চলতে পারে। আদি যুগে জলদস্যুরা বিভিন্ন উপকূলে অবস্থান নিয়ে জাহাজ লুণ্ঠন করত। আধুনিক যুগে তা অসম্ভব। একটি দেশের নেভি কিংবা কোস্টগার্ড সবাইকে প্রতিরক্ষা দেয়।

কিন্তু আন্তর্জাতিক নৌ-রুটের সব এলাকা কোনো দেশের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন বঙ্গোপসাগর উপকূলের ২৪ মাইল পর্যন্ত একটি দেশের টেরিটরিয়াল ওয়াটার হতে পারে। মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত তাদের নিজ নিজ এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করল। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের মাঝের একটি এলাকা হয়তো উপকূল থেকে হাজার মাইল দূরে। সেই এলাকার দায়িত্ব কার? সেই এলাকায় আমি ইচ্ছা করলেই কি যা কিছু করতে পারি?

এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ১৯৮২ সালে আগমন ঘটে 'ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি'র (ইউএনসিএলওএস)। এই আইনের অধীনে কোনো দেশের আওতার বাইরের যেকোনো এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

সমুদ্রে জাহাজের নিরাপত্তা

বর্তমান যুগে সমুদ্রে জাহাজের নিরাপত্তা কখনোই কোনো সমস্যা ছিল না। একটা ট্রাককে রাস্তায় কলাগাছ ফেলেও থামিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু একটা জাহাজ থামানো যায় না। সেই প্রেক্ষাপটে একটা জাহাজ অনেক নিরাপদ। যদি চিন্তা করি একটা চলন্ত ট্রেন ডাকাতি করব, আমার প্রয়োজন হবে দ্রুতগামী আরেকটি যান, যে দ্রুতগতিতে চলে ওয়েস্টার্ন মুভির মতো একটি চলন্ত ট্রেনে উঠে যাবে। জাহাজে ডাকাতির ব্যাপারে মোটামুটি এমনই একটা কৌশল ব্যবহার করা হতো।

বঙ্গোপসাগর থেকে আন্দামান সাগর হয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথটিকে বলা হয় মালাক্কা স্ট্রেইট। এ প্রণালীর এক পাশে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর, আরেক পাশে ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়া থেকে রাতের আধারে জলদস্যুরা দ্রুতগামী ছোট বোট নিয়ে জাহাজের পাশে গিয়ে ভিড়ত। ছোট জাহাজের গায়ে রশি বাঁধা হুক আটকে তারা রশি বেয়ে উঠে যেত। উঠে চলন্ত জাহাজের লোকজনের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে নেমে যেত। চট্টগ্রাম নোঙরেও একই ঘটনা ঘটত। রশি বেয়ে জাহাজে উঠে জাহাজের মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যেত। অনেক সময় এমনও ঘটেছে যে অস্ত্রের মুখে জাহাজের সেফ থেকে টাকা নিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেছে। কিন্তু পুরো জাহাজ হাইজ্যাক করা হয়নি। কারণ এটা সম্ভব না। জাহাজ হাইজ্যাক করলে তাকে নিয়ে কোথাও আশ্রয় নিতে হবে, সেটা কোনো রাষ্ট্রই দেবে না। এখন এসব খুব কঠিন। কারণ সব দেশেই কোস্টগার্ড খুব কার্যকরী।

২০০০ সাল থেকে সোমালিয়ায় জলদস্যুতা শুরু হয় ভিন্ন মাত্রিকে

সোমালিয়াতে কোনো কার্যকর সরকার নেই। সুতরাং তাদের কিছু সশস্ত্র জনগণ নৌকা নিয়ে সমুদ্রে গিয়ে প্রথম দিকে বিদেশি ফিশিং ট্রলার দখল করে নিতে শুরু করল। এসব ট্রলার বেআইনিভাবে তাদের উপকূলে মাছ ধরত। পরে বুঝতে পারল জাহাজ হাইজ্যাক একটি লাভজনক ব্যবসা। পরে তারা নিরপরাধ বাণিজ্যিক জাহাজ দখল করা শুরু করল।

আগে জলদস্যুরা জাহাজে উঠে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যেত। কারণ এর বাইরে তাদের করার কিছু ছিল না। কিন্তু সোমালিয়ান জলদস্যুরা একটা জাহাজ হাইজ্যাক করে তাদের এলাকায় নিয়ে যায়। নাবিকদের জিম্মি করে। পরে পুরো জাহাজের মুক্তির জন্য একটি মূল্য নির্ধারণ করে। জাহাজ মালিকরা মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজ মুক্ত করে নেয়। পরবর্তীতে সোমালিয়াতে এটি প্রায় ব্যবসায় পরিণত হয়। পেশাদারিত্ব বাড়তে থাকে, আধুনিক নৌযান ব্যবহৃত হতে থাকে।

প্রথম দিকে শুধু উপকূলীয় এলাকায় ছিল তাদের বিস্তার। পরবর্তীতে গভীর সমুদ্রে জাহাজ হাইজ্যাকের কৌশল বের করে। একটি বড় জাহাজ বা ফিশিং ট্রলারকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। এর সঙ্গে থাকে ছোট ছোট দ্রুত গতির স্পিড বোট বা স্কিফ। ফলে জলদস্যুদের ব্যাপ্তি বেড়ে যায়, উপকূল থেকে হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত জাহাজ এর শিকার হতে থাকে। ২০১১ সালে জাহাজ হাইজ্যাক চরম পর্যায়ে পৌঁছে। এক বছরে প্রায় ২৩৭টি জাহাজ হাইজ্যাক হয়।

জাহাজে কেন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে না

মগের মুল্লুকের মতো জাহাজ যখন হাইজ্যাক হতে লাগল, সবার মনে একই প্রশ্ন—জাহাজে কেন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় না? একটি টাকা বহনকারী গাড়িতে দুটো অস্ত্রধারী গার্ড রাখা সম্ভব হলে শত কোটি টাকা মূল্যের জাহাজে কেন কিছু অস্ত্র রাখা হয় না?

আসলেই এটা কোনো ভুল জিজ্ঞাসা নয়। জাহাজে গোটা চারেক অস্ত্র থাকলে জলদস্যুদের বড় বাহিনীকেও ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব। একটি জাহাজ নিজেই একটি দুর্গ। একটা বড় জাহাজ পানি থেকে প্রায় ২০-২৫ ফিট উপরে থাকে। জাহাজ স্টিলের তৈরি, মাঝারি মানের মেশিনগানের বুলেট তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। এ ছাড়া জাহাজের ব্রিজ পানি থেকে অনেক উপরে, ক্ষেত্র বিশেষে ৬০-৭০ ফুট উপরে হতে পারে। এত উপর থেকে নিচের একটি ছোট বোটকে গুলি করে সহজেই ফুটো করে ডুবিয়ে দেওয়া সম্ভব। জাহাজের ওপর থেকে স্থিরভাবে তাক করে সহজেই তাদের পরাভূত করা অনেক সহজ।

জাহাজে একজন নাবিক স্টিল প্লেট দ্বারা সুরক্ষিত, আর ছোট একটি বোটে দস্যুরা সম্পূর্ণ অরক্ষিত। জাহাজের ওপর দাঁড়িয়ে একজন অস্ত্রধারী নাবিক একাই এক ডজন জলদস্যুবাহী নৌকাকে পরাভূত করতে পারে অতি সহজে। একটি জাহাজ একদিনে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল খরচ করে, সেই খরচে কয়েক ডজন আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনা যাবে। আর অস্ত্র চালানোও কঠিন কোনো ব্যাপার না। একজন নাবিক একজন ফায়ার ফাইটারও। কঠিন কঠিন কাজ তাকে দৈনন্দিন জীবনে করতে হয়। সেখানে অস্ত্র চালানো শেখা তার জন্য কঠিন কিছু নয়।

তাহলে কেন জাহাজে অস্ত্র রাখা হয় না

এটা করলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এটা রাখা হয় না ভিন্ন এক কারণে। একটি জাহাজ বিশ্বের যেকোনো বন্দরে প্রবেশ করতে পারে, বিনা অনুমতিতে যেকোনো দেশের জলসীমা দিয়ে চলাচল করতে পারে। জাহাজের নাবিকরা যেকোনো দেশে ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারে। এসব করতে পারে আন্তর্জাতিক নীতিমালার অধীনে।

জাহাজ একটি বেসামরিক যান। যদি অস্ত্র বহন করে, তখন সেটি সামরিক নৌযানে পরিণত হবে। একটি উড়োজাহাজ যেকোনো দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু সামরিক উড়োজাহাজ হলে সেটা আর পারবে না। সেক্ষেত্রে আগে থেকে অনুমতি নিতে হবে। সামরিক উড়োজাহাজ কিংবা নৌযান অবশ্যই কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। তাই তাদের সরকার অন্য দেশ থেকে অনুমতি নিয়ে থাকে জলসীমা কিংবা আকাশসীমা ব্যাবহারের প্রয়োজন হলে। একটি জাহাজ ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং তাকে যেকোনো সময় যেকোনো দেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। তার পক্ষে সম্ভব না একটি সামরিক নৌযান হিসেবে চলাচল করা। এজন্যই জাহাজে অস্ত্র বহন করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না।

ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে এশিয়ার যোগাযোগের সবচেয়ে প্রচলিত নৌপথ হচ্ছে সুয়েজ খাল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল পরিবহনের রুটও সুয়েজ খাল। ফলে এডেন উপসাগর বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত নৌ চলাচল এলাকা। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে সোমালিয়ার অবস্থানও একই এলাকায়। যেহেতু সোমালিয়ায় কোনো কার্যকর সরকার নেই এবং নেই কোনো কোস্টগার্ড কিংবা নেভি, সরকারের নেই আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা, তাই অনায়াসে তারা চালিয়ে যায় মধ্যযুগীয় বর্বরতা।

এতে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ক্ষতি বেড়ে যায়। সুতরাং তারা প্রিমিয়াম বৃদ্ধি করে, পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়। এ ধরনের বর্বরতা মোকাবিলার জন্য ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) অধীনে নিরাপত্তা প্রদানের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর অধীনে বিভিন্ন দেশের নেভি জাহাজ এলাকায় টহল দিতে শুরু করে। কনভয় সিস্টেম চালু করা হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে একসঙ্গে ১০-২০টা জাহাজ কনভয়ে যোগ দেয়। এর আগে-পিছে নেভির জাহাজ থাকে।

এ ছাড়া অনেক জাহাজ শুধু একটি এলাকার জন্য নিরাপত্তারক্ষী ভাড়া করে থাকে। সেই একই সমস্যা দেখা দেয়—নিরাপত্তারক্ষী নেওয়ার পর জাহাজের বেসামরিক মর্যাদা রহিত হয়। কোনো দেশ নিরাপত্তারক্ষী নামতে দিতে পারে না। ফলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ভাসমান নিরাপত্তারক্ষীদের ঘাঁটি তৈরি হয়। যেমন: সুয়েজ থেকে এশিয়াগামী জাহাজগুলোতে নিরাপত্তারক্ষী ওঠে জেদ্দার অদূরে ভাসমান একটি জাহাজ থেকে। আবার তারা নেমে যায় ওমানের কাছের আরেকটি ভাসমান জাহাজে। এভাবেই সমুদ্রে জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুরু হয়।

আইএমবির হাই-রিস্ক এলাকার একটি ম্যাপ তৈরি করে। সেই এলাকায় জাহাজ ঢুকলেই তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করতে হয়। হয় গার্ড বহন করে, কিংবা কোনো কনভয়ে যোগ দিয়ে। এ ছাড়া জাহাজের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া লাগাতে হয়, জাহাজের চারদিকে ফায়ার হোস লাগিয়ে সর্বদা চারদিকে পানির প্রবাহ রাখতে হয়। অনেক সময় এসব প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্যই জলদস্যুরা জাহাজে উঠতে ব্যর্থ হয়। তারপরেও যদি তারা জাহাজে উঠে পরে, তখন দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। জাহাজে একটি সিটাডেল তৈরি করা হয়, মানে সুরক্ষিত এলাকা। সাধারণত ইঞ্জিনরুম এবং তার পেছনের স্টিয়ারিং রুমকে বানানো হয় সিটাডেল। এ এলাকায় বাইরে থেকে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। স্টিলের মোটা পাত ভেদ করা প্রায় অসম্ভব। সিটাডেলের ভেতরে কয়েক দিনের খাবার ও পানি রাখা থাকে। এর সঙ্গে থাকে একটি ভিএইচএফ রেডিও ও একটি স্যাটেলাইট ফোন।

ক্যাপ্টেন যখন দেখে কোনোভাবেই দস্যুদের জাহাজে ওঠা ঠেকানো যাবে না, তখন সব নাবিকদের নিয়ে সিটাডেলে আশ্রয় নেয়। সিটাডেলে ঢুকে তিনি নিশ্চিত হন যে, সব নাবিক সিটাডেলের ভেতরে আছে। তখন তিনি রেডিও ও স্যাটেলাইট ফোনে আইএমবিসহ সবাইকে জানিয়ে দেয় তাদের কেউ জিম্মি নেই, সবাই সিটাডেলে অবস্থান করছে।

তখন নিকটস্থ যুদ্ধজাহাজ এগিয়ে আসে, হেলিকপ্টার পাঠিয়ে দেয়। জলদস্যুরা জানে যে একটি নেভি কন্টিনজেন্টের বিরুদ্ধে তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা শূন্য। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা আত্মসমর্পণ করে বা পালিয়ে যায়। তাদের প্রধান অস্ত্র জাহাজের নাবিকদের জিম্মি করা। জিম্মি করতে পারলে তাদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করা হয়।

সম্প্রতি হাইজ্যাক হওয়া এমভি আবদুল্লাহ প্রসঙ্গ

বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ হাই-রিস্ক এলাকায় চলাচল করছিল। যদিও সম্প্রতি সোমালিয়া জলদস্যুদের প্রকোপ অনেক কমে গেছে, কিন্তু তারপরেও তাদের নাকের ডগায় চলাচলের সময় প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবশ্যই আলোচনা সাপেক্ষ।

তারা যে এলাকায় চলাচল করছিল, সেখানে কোনো কনভয় সিস্টেম ছিল না। সেক্ষেত্রে জাহাজ মালিকের উচিত ছিল অস্ত্রধারী গার্ড নেওয়া। অস্ত্রধারী গার্ড নেওয়া হলে জাহাজ হাইজ্যাকের সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নেমে যায়।

কোম্পানি যদি গার্ড নিয়ে না থাকে, হাই-রিস্ক এলাকায় জাহাজের নাবিকদের অধিকার থাকে জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার, মানে জাহাজে সেইল করা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। এখানে ধরে নেওয়া যায়, চাকরির মায়ায় অনেকে সেইল করতে বাধ্য হয়।

সেক্ষেত্রে জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব অন্তত বেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস (বিএমপি) অনুযায়ী সব প্রতিরোধব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জাহাজ থেকে পাঠানো ফুটেজ অনুযায়ী জাহাজের গায়ে কোনো কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। পাইরেটদের জাহাজে ওঠার ভিডিও করা হয়েছে। তার মানে কেউ সিটাডেলে যায়নি। এখন প্রশ্ন, জাহাজে কি সিটাডেল ছিল?

জাহাজের কাছেই নেভির জাহাজ ছিল। ক্যাপ্টেন সব নাবিকদের নিয়ে সিটাডেলে আশ্রয় নিলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জাহাজকে মুক্ত করা সম্ভব হতো। জাহাজ মালিকরা অর্থ বাঁচানোর জন্য নাবিকদের জীবন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। আসা করি জাহাজের ফ্ল্যাগ স্টেট এ ব্যাপারে জাহাজ মালিকদের আরও সচেতন করবে।

আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ: তেলবাহী আমেরিকান ঈগল ট্যাংকারের ক্যাপ্টেন

Comments