ফুলের রাজনীতি

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার একটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দারুণ সমালোচনা হচ্ছে। যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, অজস্র ফুলের মাঝখানে তিনি নিজ কার্যালয়ের চেয়ারে বসে আছেন।

উপাচার্য পদে নিয়োগ পাওয়ায় তার সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা এই ফুলগুলো দিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, বদরুজ্জামান ভূঁইয়ার সাবেক কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে ছবিটি পোস্ট করেছিলেন। পরে এটি তিনি নিজের ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করেন। কিন্তু এটি নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হওয়ার পর তিনি পোস্টটি সরিয়ে নেন। (প্রথম আলো, ১৩ মার্চ ২০২৪)

প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক শিক্ষক মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া গত ৪ মার্চ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ পান। এর আগে ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি এখানে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। বাস্তবতা হলো, শিক্ষক হিসেবে মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া কতটা যোগ্য এবং প্রশাসক হিসেবে কতটা দক্ষ—সেটি এই ফুলের আলোচনায় ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ পদে কেউ নিয়োগ পেলে কিংবা কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের নেতা হলে; নির্বাচনে জয়লাভ করলে অথবা কেউ বড় কোনো সাফল্যের দেখা পেলে তার শুভানুধ্যায়ীরা তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন—এটি পুরনো রেওয়াজ।

সেই হিসেবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও যদি তার সহকর্মী, সুহৃদ ও শুভানুধ্যায়ীরা ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান, তাতে দোষের কী—এই প্রশ্ন উঠতেই পারে।

সেই প্রশ্নের মীমাংসা করার আগে একটু পেছনে ফেরা যাক।

'দুই মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিজ্ঞাপন, ব্যাখ্যা চেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে ইউজিসির চিঠি।' এটি গত ১৭ জানুয়ারি প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম—যেখানে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না মেনে নবনিযুক্ত দুজন মন্ত্রীকে জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের খরচ কোন খাত থেকে করা হচ্ছে, সেটিও জানতে চেয়েছে মঞ্জুরি কমিশন। ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপপরিচালক মো. গোলাম দস্তগীরের সই করা চিঠিতে দেশের সাতটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় নবনিযুক্ত শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এই চিঠি দেওয়ার কারণ হলো, ইউজিসি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কোনো বরাদ্দ দেয় না। তাই কোন খাত থেকে এর খরচ দেওয়া হবে, সেটি জানতে চাওয়া হয়।

প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ না থাকা এবং মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার পরেও দুই মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার কেন এই অতি উৎসাহ? উত্তর হলো, যে দুই মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, তারা দুজনই চট্টগ্রামের মানুষ। অতএব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মূলত তাদের সুনজরে আসতে চেয়েছেন। অর্থাৎ এই শুভেচ্ছার পেছনে যতটা না ভালোবাসা, তার চেয়ে বেশি রাজনীতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থ।

তারচেয়ে বড় কথা, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, যিনি একজন অধ্যাপক, শিক্ষক—তাকে কেন দুজন রাজনীতিবিদকে শুভেচ্ছা জানাতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে?

ধরা যাক বিজ্ঞাপনের টাকাটি তিনি নিজের পকেটের পয়সা থেকে দিয়েছেন (সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ), কিন্তু তারপরও এই ধরনের তোষামোদি কি একজন অধ্যাপকের আত্মসম্মানের সঙ্গে যায়?

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, যদি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের টাকাটি উপাচার্য নিজের টাকায় না দিয়ে থাকেন, তাহলে ওই টাকা নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ অন্য কোনো খাতের। সেই টাকা খরচের অধিকার ও এখতিয়ার তাকে দিয়েছে? উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও নিয়ম-কানুন জানেন না? তিনি কার টাকায় কাকে শুভেচ্ছা জানালেন এবং কেন জানালেন? 

একই সময়ে অর্থাৎ বর্তমান মন্ত্রিসভা গঠনের পরপর ফুলেল শুভেচ্ছা নিয়ে আরও একাধিক ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।

যেমন: বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে তাকেও ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বিসিবি পরিচালকেরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, তাকে ফুল দেওয়া নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় যে কার আগে কে ফুল দেবেন।

শুধু বিসিবির পরিচালকরাই নন, বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশন, ক্রীড়া সংগঠন, ক্রীড়া সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতারাও আসেন ফুল নিয়ে। একজন লিখেছেন, এত ফুল যে এগুলো একত্র করলে ক্রীড়া পরিষদের ছোটখাটো একটা কক্ষই ভরে যেত।

এই ঘটনা নিয়ে একটি পত্রিকার খবরের ভাষ্য এরকম: 'দুপুরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে যখন ক্রীড়া পরিষদের আটতলায় মন্ত্রী নিজের কক্ষে আসেন, গিজগিজ করছে চারপাশ। স্লোগান উঠল জয় বাংলা, জয় বাংলা। মন্ত্রীর সঙ্গে তার কক্ষে অনেকেই ঢুকে পড়েন স্রোতের মতো। সেখান থেকে মন্ত্রী বেরিয়ে ক্রীড়া পরিষদের পঞ্চম তলায় যান। ক্রীড়া সংগঠকেরা যেখানে অপেক্ষা করছিলেন তাকে ফুল দিতে। এই পর্ব ৩০-৪০ মিনিট চলল। ফুল নিতে নিতে মন্ত্রী একসময় ক্লান্ত হয়ে গেলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে যান নাজমুল হাসান। মিনিট ত্রিশেক পর আবার এলেন সে কক্ষে।' কিন্তু শুভেচ্ছা জানানোর এই বাড়াবাড়িতে স্বয়ং মন্ত্রীও বিরক্ত ও বিব্রত বোধ করেন। বলেন, 'আজ যে বিশৃঙ্খলা হলো, এটা আমার ভালো লাগেনি। আগামী দিনে এমন আর হবে না।'

প্রশ্ন হলো, একজন ব্যক্তি মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেলেই তাকে এভাবে দল বেঁধে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে হবে কেন? উদ্দেশ্যটা কী? উদ্দেশ্য যে তাকে ভালোবেসে অভিনন্দন জানানো, তা তো নয়। বরং উদ্দেশ্য হলো মন্ত্রীর সুনজরে থাকা। নানারকম কাজে ও ধান্দায় তাকে পাশে পাওয়া। ব্যক্তিগত নানাবিধ স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা করা। অর্থাৎ শুভেচ্ছা বা অভিনন্দন জানানো এখানে মুখ্য নয়।

আবার আসা যাক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। সেখানে কেন অজস্র ফুলের তোড়ার মাঝখানে বসে উপাচার্য ছবি তুললেন বা কেউ একজন তার সেই ছবিটা তুলে আবার ফেসবুকে দিলেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটি দায়িত্বপূর্ণ পদ। যিনি এই পদে বসেন তিনি কোনো রাজনৈতিক নেতা নন যে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন বলে তাকে দলের নেতাকর্মীরা মিছিল-সহকারে গিয়ে শুভেচ্ছা জানাবেন। উপাচার্য একজন শিক্ষক। একজন শিক্ষককে কেন এরকম অজস্র মানুষের কাছ থেকে ফুলের তোড়া নিতে হবে বা তার সহকর্মীদেরও কেন এই অতি উৎসাহ? উপাচার্যের কাছ থেকে বাড়তি ও বিশেষ সুবিধা আদায়ের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা?

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীদের অভ্যন্তরীণ ও দলীয় রাজনীতি এখন ওপেন সিক্রেট। নবনিযুক্ত উপাচার্যকে সেই রাজনীতির বলয়ে নিয়ে যাওয়া? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, একজন উপাচার্য যখন দেখেন যে তার সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা তাকে এরকম ফুলের ভারে ন্যুব্জ করে ফেলছেন, এটি তাকে বিব্রত করবে না? তিনি এই ধরনের শুভেচ্ছা জানানোকে নিরুৎসাহিত করবেন না?

ধরা যাক তার অনিচ্ছাতেই এত এত ফুলের তোড়া এলো এবং তার পুরো কক্ষ ভরে গেলো। কিন্তু সেই ফুলের মাঝখানে বসে তিনি হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলেছেন এবং সেই ছবিটি একজন ফেসবুকে পোস্ট করার পরে তিনি নিজের ওয়ালে শেয়ার করার আগে কি একবার ভেবেছেন এই ছবি নিয়ে সমালোচনা হতে পারে? এতটুকু দূরদর্শিতা কি একজন উপাচার্যের থাকার কথা নয়? নাকি আনন্দের আতিশয্যে তিনি পুরো বিষয়টিকেই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন অথবা তিনি এটিকে একটি 'ইনোসেন্ট' বা নিষ্পাপ কাজ হিসেবে দেখছেন?

সমালোচনার মুখে তিনি নিজের ওয়াল থেকে ছবিটি সরিয়ে নিলেও কাজ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে এখন মানুষকে, বিশেষ করে দায়িত্বশীল পদের মানুষকে যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাবধান থাকতে হয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য হয়তো নিজের সরলতার কারণে সেটি ভুলে গিয়েছেন।

এখন এই স্মার্টফোনের যুগে প্রতিটি ঘটনাই কারো না কারো ক্যামেরায় বন্দি হয়ে যায় এবং কোনো না কোনো সময়ে সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হবেই। ফলে সাবধানের মার নেই।

তবে মন্ত্রী, উপাচার্য, কোনো সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে যারা এরকম ফুল নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে যান, তাদের অতি উৎসাহের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকা জরুরি।

মনে রাখা দরকার, এই ধরনের শুভেচ্ছা—সেটি ফুলের তোড়া দিয়ে হোক আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েই হোক—তার পেছনে ভালোবাসা যতটা না থাকে, তারচেয়ে বেশি থাকে স্বার্থ।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

Comments

The Daily Star  | English
consensus commission bicameral parliament proposal

Consensus commission: Talks stall over women’s seats, upper house

The National Consensus Commission proposed establishing an upper house comprising elected representatives from each district and city corporation, and suggested abolishing the current system of reserved seats for women in parliament.

5h ago