সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের গল্পে শরীফা ট্রান্সজেন্ডার নাকি হিজড়া?

সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের শরীফার গল্পের শরীফা একজন হিজড়া নাকি ট্রান্সজেন্ডার—এ নিয়ে বিতর্ক চলছে বছরের শুরু থেকেই।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক একটি সেমিনারে বই থেকে শরীফার গল্পের পাতা দুটি ছিঁড়ে ফেলেন এবং জনসমক্ষে সবাইকে একই কাজ করার আহ্বান জানান। এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়টির পক্ষ থেকে জানানো হয় ওই শিক্ষকের চাকরির চুক্তি নবায়ন করা হবে না। তিনিসহ শিক্ষাঙ্গনের আরও কয়েকজন এবং ধর্মীয় নেতাদের একাংশের দাবি, শরীফার গল্পটির মাধ্যমে কোমলমতি শিশুদের ভেতরে সমকামিতা এবং ট্রান্সজেন্ডারের ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বই থেকে শরীফার গল্পটি বাদ দেওয়ার জন্য আইনি নোটিশ পাঠান।

সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় 'শরীফার গল্পের' বিষয়বস্তু পর্যালোচনায় পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি শরীফার গল্পের মাধ্যমে কোমলমতি শিশুদের ভেতর সমকামিতা এবং ট্রান্সজেন্ডারের ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে? গল্পের চরিত্র শরীফাকে কি একজন ট্রান্সজেন্ডার নাকি হিজড়া হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে বইটিতে? হিজড়া আর ট্রান্সজেন্ডার কি একই?

চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় হিজড়াদেরকে বলা হয় ইন্টারসেক্স। একজন ইন্টারসেক্স মানুষের শরীরে একইসঙ্গে পুরুষ ও নারীর জননাঙ্গ এবং প্রজননতন্ত্রের মিশেল থাকে। যেমন: একজন ইন্টারসেক্স মানুষের যৌনাঙ্গ যদি পুরুষ সদৃশ হয়, তাহলে তার শরীরে একইসঙ্গে টেস্টিস বা অণ্ডকোষ এবং ডিম্বাশয়ও থাকতে পারে। পুরুষাঙ্গ থাকা সত্ত্বেও তার শরীরে মেয়েলি হরমোন, যেমন: ইস্ট্রোজেনের আধিক্য থাকতে পারে।

বিপরীতভাবে, একজন ইন্টারসেক্স মানুষের শরীরে একইসঙ্গে যোনি এবং অণ্ডকোষ থাকতে পারে। এ কারণেই জন্মের পর ইন্টারসেক্স শিশুর লিঙ্গ নারী বা পুরুষে নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। সেক্স নির্ধারণের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা তাদেরকে ইন্টারসেক্স হিসেব চিহ্নিত করেন।

বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য বা ফিনোটাইপের বৈচিত্র্য ছাড়াও ইন্টারসেক্সদের জিনোটাইপেও অস্বাভাবিকতা থাকে। একজন স্বাভাবিক পুরুষ এবং নারীর সেক্স ক্রোমোজোম থাকে যথাক্রমে এক্স, ওয়াই (XY) এবং এক্স, এক্স (XX)। ইন্টারসেক্সের ক্ষেত্রে এই সেক্স ক্রোমোজোম হতে পারে এক্স, এক্স, ওয়াই (XXY) অথবা শুধুমাত্র একটি এক্স (XO), কোনো ওয়াই ক্রোমোজোম নেই।

বয়ঃসন্ধির সময়ই হরমোনের কারণে ইন্টারসেক্সদের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। অনেক সময় জন্মের পরপরই ইন্টারসেক্স বোঝা যায় না। কিছু হিজড়া বা ইন্টারসেক্সদের ভেতরে মেয়েলি ভাবের প্রাধান্য থাকে। আবার কারো কারো ভেতরে থাকে পুরুষালি ভাবের আধিক্য। আবার অনেকের কোনো লিঙ্গেরই প্রাধান্য থাকে না।

ইন্টারসেক্স একটি জেন্ডার-নিউট্রাল শব্দ। অর্থাৎ ইন্টারসেক্স দিয়ে কোনো লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ করা হয় না। ইংরেজিতে সেক্স এবং জেন্ডার দুটি ভিন্ন শব্দ। বাংলায় সেক্স এবং জেন্ডার দুটো শব্দকেই 'লিঙ্গ' শব্দটি দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেক্স হচ্ছে বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক লিঙ্গ, যা নির্ধারণ করা হয় জন্মের সময় যৌনাঙ্গের গঠন প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে, জেন্ডার হচ্ছে সমাজে একজন ব্যক্তির লিঙ্গ পরিচয়। একজন ব্যক্তি নিজেকে কোন লিঙ্গের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সেটা।

আমাদের সমাজে হিজড়াদের থার্ড জেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে ইন্টারসেক্সদের থার্ড জেন্ডার বলা হয় না। হিজড়াদেরও লিঙ্গ পরিচয় থাকতে পারে। তারাও চাইতে পারে নিজেকে একজন নারী বা পুরুষ হিসেবে পরিচয় দিতে এবং সমাজে নারী বা পুরুষ হিসেবে পরিচয় পেতে। কিন্তু আমরা তাদের ওপর জোর করে 'তৃতীয় লিঙ্গ' নামক একটি অর্থহীন লিঙ্গ চাপিয়ে দিয়েছি।

একজন হিজড়া, যার ভেতরে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য পায়, তিনি যদি নিজেকে নারী হিসেবে দাবি করেন এবং নিজেকে নারী রূপে প্রকাশ করেন, তখন কি হবে? তখন কি তাকে ট্রান্সজেন্ডার তকমা দিয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাব? আমাদের সমাজ কি তাকে বলবে যে তার নারী হওয়ার অধিকার নেই। সারা জীবন তাকে তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় দিয়েই বেঁচে থাকতে হবে?

এখন দেখা যাক ট্রান্সজেন্ডার করা? আভিধানিকভাবে একটি 'নির্দিষ্ট' লিঙ্গ নিয়ে জন্মের পরবর্তীতে বিপরীত লিঙ্গে রূপান্তরিত হওয়াকেই সহজভাবে বলা হয় ট্রান্সজেন্ডার। এখানে 'নির্দিষ্ট' শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ট্রান্সজেন্ডার হতে হলে জন্মের সময় তার একটি সুনির্দিষ্ট লিঙ্গ থাকতে হবে—পুরুষ বা স্ত্রী লিঙ্গ। ইন্টারসেক্সদের ক্ষেত্রে যা সম্ভব না। এই কারণে আভিধানিকভাবে একজন ইন্টারসেক্স কখনো ট্রান্সজেন্ডার হতে পারেন না।

উল্লিখিত গল্পের শরীফা কি ট্রান্সজেন্ডার নাকি হিজড়া? চলুন, গল্পের চরিত্র, এর বর্ণনা এবং প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে দেখি শরীফা আসলে কোন লিঙ্গের?

গল্পের শুরুতেই শরীফা বলছে যে ছোটবেলায় সবাই তাকে ছেলে বলত, কিন্তু একসময় সে বুঝতে পারল যে তার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও সে আসলে মেয়ে। সে মেয়েদের জামা পড়তে চাইত এবং মেয়েদের সঙ্গে খেলতে পছন্দ করত। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলে তারা তার কথাবার্তা এবং চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করত। পরবর্তীতে তার সঙ্গে পরিচয় হয় আরেকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের। সে শরীফাকে নিয়ে যায় হিজড়া সম্প্রদায়ের কাছে। সেখানে সে দেখতে পায় তার মতোই আরও অনেক মানুষ। শরীফা হিজড়াদের সঙ্গেই থেকে যায়।

এই হচ্ছে গল্পের শরীফার পরিচয়।

গল্পের প্রথম লাইন থেকে বোঝা যায় যে শরীফার শারীরিক গঠন পুরুষের মতো। সেক্ষেত্রে তার পুরুষাঙ্গের উপস্থিতি থাকাটাই স্বাভাবিক, নিদেন পক্ষে জন্মের সময়। দ্বিতীয় লাইন থেকে বোঝা যায়, শরীফার মানসিকতা মেয়েলি, যা সম্ভবত সে টের পায় তার বয়ঃসন্ধির সময়টাতে। তৃতীয় লাইন থেকে বোঝা যায়, শরীফার সেকেন্ডারি সেক্স ক্যারেক্টারিস্টিক্স বা গৌণ বৈশিষ্ট্যগুলো কিছুটা মেয়েদের মতো। এ কারণেই তার কথাবার্তা, চালচলনে ছেলেরা হাসাহাসি করত।

এই তিনটি বৈশিষ্ট্য এবং গল্পটির পটভূমি পর্যালোচনা করে বলা যেতে পারে যে শরীফা একজন হিজড়া বা ইন্টারসেক্স—যার ভেতরে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য রয়েছে।

কিন্তু জটিলতা বেঁধেছে তখনি, যখন শরীফা জানায় যে ছোটবেলায় তার নাম ছিল শরীফ আহমেদ। এটা ছিল তার বাবা-মায়ের দেওয়া নাম। পরবর্তীতে সে তার নাম পরিবর্তন করে 'শরীফা' রাখে এবং মেয়েদের লিঙ্গ পরিচয়ে হিজড়াদের সঙ্গে বসবাস করতে থাকে।

মূলত এই বিষয়টার ওপর ভিত্তি করে কিছু কিছু একাডেমিক বলছেন, শরীফা ট্রান্সজেন্ডার নারী। কিন্তু গল্পের মূল প্রতিপাদ্য এবং উপসংহার সবই হিজড়াদের নিয়ে। শরীফার নিজের বর্ণনা থেকেও এটা স্পষ্ট যে সে আর দশটা সাধারণ ছেলের মতো ছিল না। এ কারণেই গল্পের পরিপ্রেক্ষিতে শরীফাকে হিজড়া হিসেবে বিবেচনা না করার কোনো যৌক্তিক কারণেই নেই।

তাকে ট্রান্সজেন্ডার বলতে হলে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে শরীফা ছোটবেলায় একজন স্বাভাবিক পুরুষ লিঙ্গের ছেলে ছিল। কিন্তু গল্পে শরীফার চরিত্রে তা ফুটে উঠেনি। সুতরাং শুধু নাম পরিবর্তনের কারণে তাকে ট্রান্সজেন্ডার নারী বলা যাবে না। কারণ একজনকে ট্রান্সজেন্ডার হতে হলে জন্মের সময় তার সেক্স অবশ্যই নির্দিষ্টভাবে হয় পুরুষ, না হয় স্ত্রী লিঙ্গের হতে হবে। শরীফার ক্ষেত্রে পুরুষ লিঙ্গের উপস্থিতি থাকলেও সম্ভবত তার শরীরে ডিম্বাশয়ও ছিল, যার কারণে তার ভেতরে মেয়েলি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছিল।

সুতরাং প্রেক্ষাপট বিচারে এই গল্পের শরীফা একজন হিজড়া বা ইন্টারসেক্স, যে নিজেকে উপলব্ধি করেছে একজন নারী লিঙ্গের মানুষ হিসেবে, যা হিজড়াদের ভেতরে খুবই স্বাভাবিক। যারা শরীফাকে ট্রান্সজেন্ডার তকমা দিচ্ছেন, তারা হয় ট্রান্সজেন্ডার কি তা ভালোভাবে জানেন না বা কখনো তারা হিজড়া দেখাননি।

হিজড়ারা আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশে এখন হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। ২০১৩ সালে দেশে হিজড়াদের সামাজিক এবং আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং সপ্তম শ্রেণির বাচ্চাদের যদি হিজড়াদের জীবন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়, তাতে দোষের কী?

শরীফার গল্পে একজন হিজড়ার জীবন ফুটে উঠেছে। এ গল্পটি থেকে বাচ্চারা হিজড়াদের লিঙ্গ এবং তাদের ভিন্নধর্মী এক জীবন সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে করে শিশুরা যখন বড় হবে তখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। সুতরাং বই থেকে 'শরীফার গল্প' বাদ দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ আমি দেখি না। এই গল্পটি পড়ে বাচ্চারা ট্রান্সজেন্ডার বা সমকামী হতে উদ্বুদ্ধ হবে—এটা অবান্তর ভাবনা।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

16h ago