ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের মতো সংস্কারের ক্ষেত্রেও উপেক্ষিত সাংবাদিকরা

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সাংবাদিকদের উপেক্ষা করে পাস করা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠোর, সমালোচিত এবং সবচেয়ে বেশি আপত্তির মুখোমুখি হওয়া গণমাধ্যম-বিরোধী 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন'। সম্প্রতি আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, আইনটি সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। তবে, আবারও গণমাধ্যমকর্মীদের পরামর্শ নেওয়ার বিষয়টি এই প্রক্রিয়ায় কোথাও নেই।

গত বুধবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত এক সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হবে। বিষয়টা কি এরকম যে তিনি সেই পর্যন্ত সময় হাতে নিয়ে রাখলেন, যখন বলতে পারবেন—নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে, এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের চেয়েও অনেক জরুরি কাজ করার আছে? আমরা অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ বলেই এমনটা ভাবছি, তা নয়। এমন ভাবনা আসার কারণ, অতীতেও একই ধরনের কথা বিভিন্ন উপলক্ষে অনেকবার বলার নজির তার রয়েছে। এমনকি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও তিনি এ ধরনের কথা বলেছেন। নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য হলেও এবার যা বলেছেন তা তিনি করে দেখাবেন বলে আমরা আশা করব।

কিন্তু আইনটি সংশোধনের চলমান প্রক্রিয়াটিতেও সাংবাদিকদের উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং আমলাদের হাতে এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকছে বলে মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমরা অনুমান করতে পারি যে এর ফলাফল কী হবে। কারণ, তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত।

আইনমন্ত্রী বলেছেন, 'আমরা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার কাছ থেকে এই আইনের বিষয়ে পাওয়া কারিগরি সুপারিশগুলোর পর্যালোচনা প্রায় শেষ করে এনেছি।' জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক মার্চে এগুলো জানিয়েছিলেন। আইন ও সংসদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইসিটি, আইন ও বিচার বিভাগের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি আইন সংশোধনের জন্য কাজ করছে এবং তারা '২-৩ বার' বৈঠক করেছে।

এটা জেনে আমরা আনন্দিত। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আমরা সাংবাদিকরা কোথায় আছি?

যে পেশার মানুষ এই আইনে অসংখ্যবার কারাদণ্ড পেয়েছেন, অগণিতবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন; যে পেশাটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং যারা এই আইনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে, তারাই এই আইন সংশোধনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। এখন পর্যন্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন বা সম্পাদকদের সংগঠনের কোনো প্রতিনিধিকে এই আলোচনায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সাংবাদিক ও সম্পাদকদের এ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে কেন? প্রণয়নের শুরু থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা সম্পাদক পরিষদের বলিষ্ঠতম ও ধারাবাহিক দাবির মধ্যে অন্যতম।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা পর্যায়ে আমাদের কয়েকজনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। সে সময় আমরা যেসব আপত্তি উত্থাপন করেছিলাম এবং সংশোধনের দাবি জানিয়েছিলাম, তা পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়। পরে আমরা বুঝতে পারি, আমাদের ডাকা হয়েছিল যেন তারা দাবি করতে পারেন যে সাংবাদিকদের সঙ্গে পরামর্শ করে এই আইনটি করা হলো। বিষয়টি নিশ্চিত করতেই এটি এক ধরনের সাজানো নাটক ছিল।

সেটা সাড়ে ৪ বছর আগের কথা। আইনটি পাস হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়নের অভিজ্ঞতা, মন্ত্রীদের বিপরীতমুখী কথা, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের আগে প্রক্রিয়া অবলম্বনের মিথ্যা আশ্বাস এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গত সাড়ে ৪ বছরে নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করার পর আমরা এই উপসংহারে পৌঁছাতে বাধ্য হয়েছি যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমনই এক নিপীড়নমূলক আইন, এতটাই মুক্ত সাংবাদিকতা বিরোধী আইন এবং এর কাঠামোটিই এমন যে, এর সংস্কার না করে বরং সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে লড়তে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা ভালো।

এবার কারণগুলো বলছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শাস্তির ২০টি ধারা রয়েছে, যার মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য। বিনা বিচারে অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়ে কি কোনো আইনের সূত্রপাত হতে পারে? কাউকে জামিন না দেওয়ার অর্থ হলো, অভিযুক্তকে আটকের পর থেকেই তাকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এমনকি, পরবর্তীতে আদালত যাদেরকে নির্দোষ সাব্যস্ত করতে পারেন, তাদেরকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়। কেবলমাত্র অভ্যাসগত ও ভয়ংকর অপরাধীদের ক্ষেত্রে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। কারণ, তাদেরকে কারাগারের বাইরে রাখাটা সমাজের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। সাংবাদিকরাও কি সেই শ্রেণিরই? এই আইনে সাজার মেয়াদ গড়ে ৪ থেকে ৭ বছর। সর্বনিম্ন সাজা ১ বছর এবং সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টিকে জামিন অযোগ্য করার ফলে এই আইনের উদ্দেশ্য অনেকটাই স্পষ্ট—শাস্তি দেওয়া এবং ভয় তৈরির উদ্দেশ্যেই এই আইন প্রণীত, ন্যায়বিচারের জন্য নয়। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাংবাদিকদের।

বর্তমানে দেশে ৯টি আইন রয়েছে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে। আরও ৩টি আইন চূড়ান্ত খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। এর পাশাপাশি প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের বিষয়টি ধরলে এমন আইনের সংখ্যা হবে ১৩টি। প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের খসড়া বারবার দেখতে চাওয়া সত্ত্বেও গণমাধ্যমের কাউকে দেখতে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া, তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) বিদ্যমান সংবাদপত্রের অনলাইন উপস্থিতি, বিশেষ করে মাল্টিমিডিয়ার উপস্থিতি সীমিত করার চেষ্টা করে প্রিন্ট মিডিয়ার টিকে থাকাকেই আরও বিপন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে গত বুধবার তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, 'আইনটির অপব্যবহার অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।' আমরা এই বিবৃতিকে স্বাগত জানাই এবং কখন থেকে আইনটির অপব্যবহার বন্ধ হবে, তা জানতে চাই। মন্ত্রী হিসেবে যেহেতু তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেন, সেহেতু এই আইনের অপব্যবহার বন্ধে তার উদ্যোগকে নিঃসন্দেহে স্বাগত জানানো হবে এবং তিনি আমাদের সাধুবাদ অর্জন করবেন। আমরা একটি বিষয় তার নজরে আনতে চাই, সেটি হলো, ৬টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা—অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সিভিকাস, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস ও ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস—যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, ২০২৩ সালের প্রথম ৩ মাসে ৫৬ জন সাংবাদিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। সে হিসাবে মাসে প্রায় ১৮ জন সাংবাদিক এই আইনের ভুক্তভোগী। ঢাকাভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) জানায়, ২০১৮ সাল থেকে কার্যকর হওয়ার পর এ পর্যন্ত এই আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৩৩৯টি মামলা করা হয়েছে।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, মুক্ত গণমাধ্যম অন্য সব স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। বিপরীতে, মুক্ত গণমাধ্যমের অনুপস্থিতিতে সব অধিকার, বিশেষত মানবাধিকার ও গণতন্ত্রে সুনিশ্চিতভাবে ক্ষয় দেখা দেয়। পুরো বিশ্বই এর উদাহরণ। যেসব দেশে মুক্ত গণমাধ্যম রয়েছে, তারাই কেবল স্থিতিশীল ও অধিকারভিত্তিক সমাজ নিশ্চিত করতে পেরেছে। বাকিরা ক্ষণিকের সম্ভাবনা দেখতে পেলেও দিন শেষে তা ব্যর্থ হয়।

এ প্রসঙ্গে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এশিয়ার দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার আধুনিক সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে গণতন্ত্র ও মুক্ত গণমাধ্যম।

জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পরপরই গণতন্ত্র ও মুক্ত গণমাধ্যমের পথে চলতে শুরু করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তারা তাদের সক্ষমতা ও টেকসই সাফল্যের মাধ্যমে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে যাচ্ছে।

বেশ কয়েক দফা সামরিক ও আধা-সামরিক একনায়কতন্ত্রের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রমাণিত হয়, অধিকারভিত্তিক সমাজে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ সব ধরনের স্বাধীনতা রক্ষা করাই টেকসই উন্নয়নের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। অনেক ছোট একটি দেশ এবং আগ্রাসী প্রতিবেশী থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়া প্রমাণ করেছে যে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা একটি দেশের জন্য কী ভূমিকা পালন করতে পারে।

এই ২টি দেশই অসামান্য অর্থনৈতিক সাফল্যের নেপথ্যে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রমাণ তুলে ধরে। এ ক্ষেত্রে শুধু উপযুক্ত আইন প্রণয়ন নয়, বরং প্রতিদিনই সেগুলো সমাজের প্রতিটি স্তরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সাফল্য নিশ্চিত করা হয়েছে এবং এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দিচ্ছি, কারণ আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে আরও উপরের পর্যায়ে উন্নীত হতে চাই এবং ধীরে ধীরে উন্নত দেশে পরিণত হতে চাই। শুধু ভৌত অবকাঠামো দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মনের, চেতনার, মূল্যবোধের ও আত্মার অবকাঠামো নির্মাণ—যা শুধুমাত্র স্বাধীনতা থেকেই আসতে পারে এবং যার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments