করযোগ্য আয় না থাকলেও ২ হাজার টাকা কর নিয়ে আপত্তির কারণগুলো
'ইনকাম ট্যাক্স' বা আয়কর শব্দটা শুনলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের ভয় বা আতঙ্ক তৈরি হয়। অথচ নির্দিষ্ট সীমার বাইরে আয় করলে যে কর দিতে হবে, এটি স্বতঃসিদ্ধ।
কিন্তু তারপরও আয়কর নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক এক নির্মম বাস্তবতা। সেই বাস্তবতায় এবার বিতর্কের নতুন ইস্যু, করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম কর দিতে হবে ২ হাজার টাকা।
গত ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বর্তমান সরকারের সবশেষ বছরে, অর্থাৎ নির্বাচনের বছরে যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, সেখানে ব্যক্তিখাতের কর নিয়ে তার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যার কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন আছে, তাকে প্রতি বছর ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে এবং করযোগ্য আয় না থাকলেও এতদিন ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় যে শূন্য কর দেখানোর সুযোগ ছিল, তার দিন শেষ। অর্থাৎ এখন করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। মানে এটি প্রকারান্তরে শূন্য কর। কিন্তু সেই শূন্য করের আর্থিক মূল্য ২ হাজার টাকা। এর কী প্রয়োজন ছিল বা এটি বাস্তবায়িত হলে রাষ্ট্রের কত টাকা আয় বাড়বে, তারচেয়ে বড় যেসব বড় প্রশ্ন সামনে আসছে তা হলো:
১. কর দেওয়ার পদ্ধতি এতই জটিল যে একজন সাধারণ মানুষ চাইলেই নিজে ফরম পূরণ করে নির্দিষ্ট ব্যাংকে বা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ওই ২ হাজার টাকা জমা দিয়ে প্রাপ্তিস্বীকারপত্র নিতে পারবেন না। বরং তাকে একজন আইনজীবীর দ্বারস্থ হতে হবে। খুব ব্যতিক্রম না হলে এ জন্য আইনজীবীকে ফি দিতে হবে।
প্রতি বছর যে আয়কর মেলা হয়, সেখানে কর দেওয়ার সুযোগ থাকলেও সবার পক্ষে মেলার ভিড়ের মধ্যে কর জমা দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে তাদেরকে ঘুরেফিরে আইনজীবীর কাছেই যেতে হবে। সুতরাং দেখা যাবে মাত্র ২ হাজার টাকা কর দেওয়ার জন্য তাকে আইনজীবীর অফিসে যাওয়া-আসা এবং ফি মিলিয়ে আরও কয়েক হাজার টাকা খরচ করতে হবে।
বিদ্যুৎ বিলের মতো যদি ঘরে বসেই অনলাইন পেমেন্টের মাধ্যমে ২ হাজার টাকা কর দেওয়ার সুযোগ থাকতো, তাহলে মানুষ হয়তো টাকার এই অংক নিয়ে খুব বেশি আপত্তি করতো না। কিন্তু মানুষের মধ্যে ভীতির মূল কারণ কর দেওয়ার পদ্ধতি এবং অন্যান্য খরচ ও হয়রানি।
২. কর ব্যবস্থা সহজ ও জনবান্ধব করার দাবি বহুদিনের। কিন্তু এই খাতে খুব বেশি সংস্কার এসেছে বা কর পদ্ধতি সাধারণ মানুষের জন্য খুব সহজ হয়েছে, সেটি বলার কোনো সুযোগ নেই। বরং সিস্টেমটাই এমন করে রাখা হয়েছে যে এখানে রাঘববোয়ালরা কোটি কোটি টাকা কর ফাঁকি দিতে পারে এবং যার কোনো আয় নেই তাকেও ন্যূনতম কর হিসেবে ২ হাজার টাকা দিতে গিয়ে ৬ হাজার টাকা খরচ করতে হবে।
৩. সরকার বলছে, অন্তত ৩৮ ধরনের সেবা নিতে আয়কর রিটার্নের প্রমাণ জমা দিতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ নেওয়া থেকে শুরু করে খুব সাধারণ কিছু বিষয়ও আছে, যেগুলো নিয়ে নাগরিকদের আপত্তি আছে। যেমন: ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড নিতে; কোনো ব্যবসায়ী বা পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ পেতে; ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে; কোনো ক্লাবের সদস্য হতে চাইলেও তাকে আয়কর রিটার্নের প্রমাণ জমা দিতে হবে।
মানে তার টিআইএন থাকতে হবে এবং টিআইএন থাকলেই প্রতি বছর ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে। আর ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে গেলেই তার করযোগ্য আয় না থাকলেও ২ হাজার টাকা জমা দিতে গিয়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ হবে। সেইসঙ্গে তার সময়, বিশেষ করে যারা ঢাকা শহরে থাকেন, তাদের ওই অর্থ ও হয়রানির সঙ্গে ট্রাফিক জ্যামের অত্যাচারও যুক্ত করতে হবে।
প্রশ্ন হলো, কোনো পেশাজীবী সংগঠন, ধরা যাক সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনের কেউ সদস্য হতে চান। তাকেও কেন আয়কর রিটার্নের প্রমাণ দিতে হবে? ক্লাবের সদস্য হওয়ার সঙ্গে আয়কর রিটার্নের কী সম্পর্ক? পাড়া-মহল্লায় যেসব ক্লাব আছে, যেসব সামাজিক সংগঠন আছে, সেসবের সদস্য হতে গেলেও আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে? এর মধ্য দিয়ে কি ক্লাব ও সামাজিক সংগঠনের কালচারকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে?
৪. করযোগ্য আয় করার পরেও দেশের যে বিপুল জনগোষ্ঠী বছরের পর বছর করজালের বাইরে থেকে যাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে কেন কর আদায় করা যাচ্ছে না? এনবিআর এসব মানুষকে কেন ধরতে পারছে না বা ধরছে না?
৫. কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন নিতে গেলেও আয়কর রিটার্নের প্রমাণ দিতে হবে। ধরা যাক, যার বেতন ২০ হাজার টাকা, তার বার্ষিক আয় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ করযোগ্য আয়ের কম। কিন্তু রিটার্ন জমা দিতে হবে।
আগেই বলা হয়েছে, এই ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর দিতে গিয়ে তাকে অন্তত ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ করতে হবে—যেটি তার প্রতি বছরের খরচের সঙ্গে যোগ হবে। কিন্তু তার কি আয় বেড়েছে? উপরন্তু নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। এখন ওই বাড়তি ৫/৬ হাজার টাকা তিনি কোথা থেকে জোগাড় করবেন? ধারদেনা করে তাকে কর দিতে হবে?
এটি কোনো আধুনিক ও জনবান্ধর রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না। মানুষের আয় বাড়বে না অথচ তার খরচ বাড়তে থাকবে এবং সেখানে রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না—এর মধ্য দিয়ে সৎ মানুষরাও বাড়তি আয়ের জন্য অসৎ পথে পা বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে পারেন।
'কর দেওয়া গৌরবের'
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম মনে করেন, করযোগ্য আয় না থাকলেও ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দেওয়াটা গৌরবের ব্যাপার। তিনি বলেছেন, ২ হাজার টাকা কর দিয়ে গৌরবের অধিকারী হবেন গরিবরা।
তার মানে, এনবিআর চেয়ারম্যানের ভাষায় 'গরিবরাও' কর দেবেন 'গৌরবান্বিত' হওয়ার জন্য! কিন্তু সাধারণ মানুষকে গৌরবান্বিত করা তো দূরে থাক, অন্তত রাষ্ট্রীয় সেবাগুলো যাতে হয়রানি, ঘুষ, তদবির ও সময়ক্ষেপণ ছাড়া পেতে পারে, সেজন্য রাষ্ট্র কী করছে—সেই প্রশ্নের সুরাহা করা যায়নি এখনো।
প্রশাসনের সর্বত্র সুশাসন ও জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না; কেন এখনো যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো কাজের জন্য গেলে মানুষ হাসিমুখে সেবা পেয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে 'থ্যাংক ইউ' বলে বেরিয়ে আসছে না; কেন এখনো মানুষের কাছে সরকারি হাসপাতাল, থানা, আদালত, ভূমি অফিস, পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিভীষিকার নাম—সেই প্রশ্নের সুরাহা করার আগে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিয়ে গৌরবের অধিকারী হতে বলাটা কতটা নৈতিক, কতটা যৌক্তিক তা বিরাট প্রশ্ন।
তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, নাগরিকের করের পয়সায় যেসব উন্নয়ন হয়; রাস্তা, সেতুসহ অন্যান্য যেসব অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়, সেখানে বরাদ্দকৃত অর্থের কত শতাংশ খরচ হয় আর কত শতাংশ ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায়, সেই হিসাব কি রাষ্ট্র কখনো দিয়েছে বা দেবে? একটি রাস্তার সংস্কারে যে পরিমাণ মালামাল দেওয়ার কথা, যে সময়ে শেষ করার কথা, যতদিন টেকসই হওয়ার কথা—সেসব জায়গায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ কি দৃশ্যমান? সরকার যে শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন করেছে, তার বাস্তবতা কী? সরকারি সেবার কোথায় কোথায় এই শুদ্ধাচারের প্রয়োগ হচ্ছে? সরকারি অফিসগুলোতে প্রতিদিন কী পরিমাণ অবৈধ অর্থ বা ঘুষের লেনদেন হয়—তার কোনো হিসাব আছে? যদি না থাকে, তাহলে মানুষ আয় না থাকার পরেও নির্ধারিত ৩৮টি সেবা পাওয়ার শর্ত হিসেবে কেন ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দেবে?
কর দেওয়ার জটিল প্রক্রিয়া এবং হয়রানির ভয়েও অনেকে করযোগ্য আয় থাকার পরেও কর দিতে আগ্রহ বোধ করেন না। তারা মনে করেন, একবার করের জালে ঢুকে গেলে প্রতি বছরই কর দিতে হবে; কিংবা আগের বছরের চেয়ে আয় কমে গেলে কর কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জালে জর্জরিত হতে হবে। প্রথমবার রিটার্ন দিতে গেলে কর কর্মকর্তারা ইতিহাস জানতে চান—কয়টি সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, ব্যাংকে কত টাকা আছে, কীভাবে সম্পদ অর্জন করলেন? এত প্রশ্নের জবাব দিয়ে কেউ কর দিতে উৎসাহী হন না। আবার বিরাট অংশই সচেতনভাবে আয়কর ফাঁকি দেন।
কর দিয়ে মানুষ কী পায়?
ইউরোপ-আমেরিকার নাগরিকরা অনেক বেশি পরিমাণ কর দেন। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা সেবা তারা বিনামূল্যে পান। বাংলাদেশে কোন সেবাটি রাষ্ট্র সুনিশ্চিত করে? উপরন্তু জনগণের করের টাকার বিরাট অংশই চলে যায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও পেনশনে।
করের বিরাট অংশ চলে যায় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে লুটপাটে। এই লুটপাটের টাকা চলে যায় বিদেশে পাচার হয়ে। সেখানে বেগমপাড়া গড়ে উঠে। মানুষ যখন এসব তথ্য জানতে পারে তখন ভাবে, আমার কষ্টার্জিত টাকার ভাগ কেন রাষ্ট্রকে দেব, যে রাষ্ট্র আমার শিক্ষা-চিকিৎসাসহ অন্যান্য নাগরিক ও মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করে না এবং যে রাষ্ট্র আমার করের পয়সায় বেতন নেওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমার জীবনকে নিরাপদ করতে পারে না?
অতএব রাষ্ট্র যতক্ষণ না নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারগুলো নিশ্চিতে পরিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালনে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারছে; যতক্ষণ না নাগরিকের মনে এই প্রতীতী জন্ম হচ্ছে যে, তার করের পয়সা পরোক্ষভাবে তার উন্নয়নেই কাজে লাগছে; এই টাকা লুটপাট হচ্ছে না বা এই টাকা কোনো অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীর বেতন ও পেনশনে যাচ্ছে না—ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার আয় গোপন রাখবেই এবং যতদিন সম্ভব সে করযোগ্য আয় করলেও বছর শেষে আয়কর বিবরণী জমা না দেওয়ার চেষ্টা করবে।
কিন্তু মানুষ যদি বিশ্বাস করে, তার করের পয়সায় সত্যিই তার উন্নয়ন হচ্ছে এবং তার মৌলিক অধিকারগুলো রাষ্ট্র নিশ্চিত করছে; থানা-আদালতসহ সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে সে বিনা হয়রানি ও বিনা ঘুষে সেবা পাচ্ছে—তখন মানুষ স্বপ্রণোদিতভাবেই কর দিতে উৎসাহী হবে কিংবা কর দিতে বাধ্য হলেও তার মনে এ নিয়ে কোনো দ্বিধা থাকবে না। সে তখন নিজেই উপলব্ধি করবে যে তার কর দেওয়া উচিত। যখন সে দেখবে ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর দিতে গিয়ে তার ২ হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে না; তাকে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে না, বরং সে ঘরে বসেই টাকাটা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিতে পারছে, তখন সে এই টাকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না এবং ধীরে ধীরে রাষ্ট্রে কর দেওয়ার একটি সুন্দর সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments