বিদেশিরা কি সরকার ফেলে দিতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় চায় না। আর এ কারণেই বাংলাদেশের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
গত ১৬ মে বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের এক মাস আগেই তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পাল্টাতে পারে। যদিও তার অর্ধমাস পরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে তাদের কোনো মন্তব্য নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক। বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হোক।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে বিদেশিদের প্রভাব ও হস্তক্ষেপ নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে দেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি ইস্যুতে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা নানা সময়ে মন্তব্য করেন বা তাদের মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্র, যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ কী বলছে, সেগুলোকে নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
অনেক সময় রাজনৈতিক দলের তরফেও প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিরুদ্ধে বিদেশিদের সঙ্গে আঁতাত করে বা মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসার অভিযোগ উঠে। অনেক সময় ক্ষমতাসীনদের তরফে অভিযোগ করা হয়, বিরোধী দল বিদেশিদের সহায়তায় সরকার ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। অনেক সময়ই দেখা যায় যে বিভিন্ন দলের নেতারা বিদেশি কূটনীতিকদের বাসায় যাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
এ সম্পর্কিত কয়েকটি সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক:
১. গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি: প্রধানমন্ত্রী (কালের কণ্ঠ, ৭ এপ্রিল ২০১৭)
২. মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাই না: শেখ হাসিনা (যুগান্তর, ২১ জুলাই ২০১৮)
৩. আ. লীগকে হারাতে একজোট হয়েছিল ভারত-যুক্তরাষ্ট্র: প্রধানমন্ত্রী (প্রথম আলো, ১২ মার্চ ২০১৭)
৪. শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করেছি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১৯ আগস্ট ২০২২)
৫. ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ চাইছে আওয়ামী লীগ: রিজভি (কালের কণ্ঠ, ২১ আগস্ট ২০২২)
৬. ভারত তো আমাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না: কাদের (বাসস, ১০ জানুয়ারি ২০২৩)
৭. বিদেশি কূটনীতিকদের পক্ষে টানতে আ. লীগ-বিএনপির দৌড়ঝাঁপ (সময় টিভি অনলাইন, ২৪ মার্চ ২০২৩)
প্রশ্ন হলো, কোনো বিশেষ রাষ্ট্র কি আসলেই বাংলাদেশের কোনো সরকার ফেলে দিতে পারে বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে মুচলেকা দিয়ে কি কোনো দল ক্ষমতায় আসতে পারে? যদি মুচলেকা দিয়েই ক্ষমতায় আসা যায়; যদি কোনো বিদেশি শক্তির সহায়তায় সরকার পরিবর্তন ঘটানো যায়; যদি যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বদলে যায়—তাহলে এই প্রশ্ন তোলাই সঙ্গত, বিদেশিরা কীভাবে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে? তাদের লোক কি ভোট দেয় বা ভোটারদের ওপর তারা প্রভাব বিস্তার করে? এই যে সরকার ফেলে দেওয়া বা ক্ষমতায় আসার বিতর্ক—সেই কাজটি কীভাবে সম্পন্ন হয়? বিদেশিরা কোন প্রক্রিয়ায় কাজগুলো করে? এর বাস্তবতা কী?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে গত ১০ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'আমেরিকা চাইলে যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো আরও বেশি কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা আমাদের এখন গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী?'
যদিও গত বছরের ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'কোনো বিদেশি শক্তি বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন করতে পারে না।' কোনো বিদেশি শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়নি বলেও তিনি দাবি করেন। বিএনপি বিভিন্ন দূতাবাসে রাতবিরাতে ধরনা দেয়—এমন অভিযোগ করে হাছান মাহমুদ বলেন, 'তারা যত না জনগণের কাছে যাচ্ছে, তারচেয়ে বেশি রাতের বেলা দূতাবাসে গিয়ে ধরনা দিয়ে তাদের অনুনয় করে বলে, আপনারা কিছু বলুন।' (প্রথম আলো, ২৬ নভেম্বর ২০২২)
স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের আগস্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের একটি বক্তব্য নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হয়। চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, 'শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার অনুরোধ করেছি।' তার এই বক্তব্যের অর্থ কি এই যে বাংলাদেশের নির্বাচনে কারা জিতবে, সেটি ভারত নির্ধারণ করে?
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বৈঠক করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে। এই বৈঠকের বিষয়ে গত ১৯ এপ্রিল যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব রাজনৈতিক দলের আন্তরিক অঙ্গীকার আদায়ে তাদের কোনো প্রভাব থাকলে, তিনি ব্লিংকেনকে সেই চেষ্টা করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, 'সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়'—বাংলাদেশ এই পররাষ্ট্রনীতিতে চললেও ভূরাজনৈতিক কারণে আয়তনে ছোট্ট এই বদ্বীপ রাষ্ট্রটি বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এই অঞ্চলে বিশ্ব শক্তিগুলোর অলিখিত স্নায়ুযুদ্ধ এবং নানাবিধ বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় স্বার্থে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা যেমন তাদের কাম্য, তেমনি এই দেশটি অস্থিতিশীল থাকলেও অনেকের সুবিধা—এমন কথাও শোনা যায়। ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কোন দল থাকলো এবং তারা কোন দেশের কতটুকু স্বার্থ রক্ষা করছে বা করতে পারছে কিংবা ভবিষ্যতে করবে—সেটি বরাবরই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরাশক্তিগুলোর বিবেচনায় থাকে।
যেমন: এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য ঠেকানোর জন্য ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক ছিল, সেই রসায়ন বদলে গেছে ভারত অনেক বেশি রাশিয়াকেন্দ্রিক হওয়ায়। কেননা রাশিয়ার সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব পুরনো। আবার চীন এখন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী। বিশেষ করে দেশের অনেক বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে সরাসরি চীনের তত্ত্বাবধানে। এমনকি চীনের প্রচুর প্রকৌশলী ও শ্রমিকও এসব প্রকল্পে কাজ করছেন। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে চীন-নির্ভরতা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের জন্য দুশ্চিন্তারও কারণ হতে পারে।
পক্ষান্তরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে চীন যে ভূমিকা রাখতে পারতো, সেটি রাখছে না—এমন অভিযোগও আছে। ফলে কূটনীতিতে সব সময় দুই দুগুণে চার নাও হতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল যে মার্কিন বলয়ে নেই, সেটি প্রমাণিত। এর পেছনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান ৬ জন কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ভূমিকা কম নয়। ফলে সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কোন দল থাকলো, সেটি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন—অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও ভূরাজনৈতিকভাবে সম্পর্কিত দেশগুলোর কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র যতই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে নিজেদের উদ্বেগ জানাক না কেন, সেখানে মূল কথা বাণিজ্য ও ভূরাজনীতি।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখতেও বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখন কোনো একটি দেশ একা ভালো থাকতে পারে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে একটি দেশ আরেকটির ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের বাজারে গমের সংকট হয় এবং গমের সংকট হলে অনেক খাদ্যপণ্যের উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদন কমে গেলে দাম বেড়ে যায়। তাছাড়া, কোনো একটি দেশ অস্থিতিশীল হলে তার প্রতিবেশী দেশগুলোতেও তার ঢেউ লাগে।
কিন্তু তারপরও যে প্রশ্নটি ঘুরেফিরে সামনে আসে তা হলো, কোনো বিদেশি রাষ্ট্র কি আসলেই বাংলাদেশের সরকার ফেলে দিতে পারে বা তারা কি চাইলেই কোনো একটি দেশকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারে? যদি বিদেশিরাই বাংলাদেশের ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারে, তাহলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং জনগণের ভোটাধিকারের কি কোনো গুরুত্ব থাকে?
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments