ভারতীয় গণমাধ্যম ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

গভীর বোঝাপড়া ছাড়া টেকসই সম্পর্ক সম্ভব নয়

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, 'বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গভীর ও বহুমুখী। আমাদের মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু সেটা আমাদের সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করবে না।'

আমরা বহুবার বলেছি এবং আবারও বলছি, আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নীতি এমন হওয়া উচিত যা 'উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক', যেখানে কারো আধিপত্য থাকবে না, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে এবং পরস্পরের সমৃদ্ধি ও গভীর বোঝাপড়া বাড়বে। দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরুর দিনগুলোতে আমি লিখেছিলাম, 'প্রকৃতপক্ষে ভারতের প্রতিবেশী দুটি—চীন ও পাকিস্তান। আমরা বাকিরা কেবল ভৌগোলিক সত্তা, যাদেরকে পরিস্থিতি অনুযায়ী কেবল প্রশংসা, তোষামোদ, ভর্ৎসনা বা শাস্তি দেওয়া হয়।'

২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার মেয়াদকালটিকে দেখা যায় প্রশংসার সময় হিসেবে। তবে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেই সরকার পতনের পর ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি শক্তিশালী অংশ এখন বাংলাদেশকে পুরোপুরি ভর্ৎসনা করছে এবং তাদের অনেকে আবার শাস্তির প্রস্তাব দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি অংশও সেটা সমর্থন করছে।

আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, সংখ্যালঘুদের ওপর যেকোনো ধরনের নিপীড়ন নিন্দনীয়—সেটা আমার দেশেই হোক কিংবা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায়। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা উচিত এবং এমন কোনো ঘটনা আর কখনো ঘটতে দেওয়া উচিত নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত দীর্ঘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক 'বিভাজন ও শাসন' নীতির ফল। দুঃখজনক হলো, ব্রিটিশরা বিদায় নেওয়ার ৭৭ বছর পরও আমরা এটা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারিনি।

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর ভারতীয় গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রচারিত খবরগুলো আমার মতে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

১. শেখ হাসিনার সরকার পতনের ঘটনাটিকে পাকিস্তানের আইএসআই, বাংলাদেশের ইসলামপন্থী গোষ্ঠী বা চীনপন্থি শক্তির কাজ বলে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাদের লক্ষ্য ছিল 'ভারতবান্ধব' সরকারকে হটিয়ে 'ভারতবিরোধী' সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সাধারণ মানুষ বা ছাত্রদের ভূমিকা, ছাত্র-জনতা হত্যা—এসব কোনো প্রসঙ্গ তাদের প্রতিবেদনে নেই। এই আন্দোলনের পেছনে বিদেশিদের হাত থাকার প্রমাণ কোথায়? এসব দাবির উৎস কী? অথচ, দোষারোপ থেমে নেই।

২. নতুন সরকার হিন্দুদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে এবং এমনকি 'গণহত্যা' করছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে। বিবিসিসহ বিভিন্ন ফ্যাক্ট-চেকাররা এসব আখ্যানের অনেকগুলোই ভুল বলে প্রমাণ করেছে। তারপরও সেগুলোর প্রচার বন্ধ হয়নি, এমনকি কমেওনি।

৩. শেখ হাসিনা সরকার পতনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার বিষয়টিও বলা হয়েছে। তারা এর সঙ্গে পাকিস্তানের ঘটনাগুলোর তুলনা করে দাবি করছে, ইমরান খানের সরকার পতন করার পর যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার সরকারেরও পতন ঘটিয়েছে।

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন:

১. ছাত্র-জনতার উত্তাল এই আন্দোলন বৃহৎ পরিসরে এড়িয়ে গেছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বগুড়া ও খুলনার রাস্তায় নেমেছিল লাখো মানুষ—এই সত্য তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। বরং তারা কেবল সরকার পতনের ঠিক পরপরই সংঘটিত হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলোই দেখেছে। অথচ, এসব ঘটনা এমন এক সময় ঘটেছিল যখন দেশে কোনো সরকার ছিল না এবং পুলিশও ছিল অনুপস্থিত।

২. নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ৭০০ জনকে হত্যা করা হলো, সেটা তাদের কোনো গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে নেই বললেই চলে। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর এমন বর্বর হত্যাযজ্ঞ বিরল। তারপরও ভারতীয় গণমাধ্যমে এটা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয়নি। ভারতের মূলধারার ছয়টি গণমাধ্যমে আমি সাক্ষাৎকার দিয়েছি, যেখানে তারা আন্দোলনের ব্যাপকতা বা বেসামরিক মানুষকে হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করেনি, বরং শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা বা সরকারি সম্পত্তিতে হামলার মতো ঘটনাই তুলে ধরেছে।

৩. এমনকি আন্দোলনের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও ছাত্র-জনতার ওপর চালানো নির্মম নির্যাতন নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে কোনো বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। আন্দোলনের একপর্যায়ে শেখ হাসিনার সরকার আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আকাশ থেকে গুলি চালিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সাংবাদিকদের ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুততর করেছে। কিন্তু, বাংলাদেশ সফরকারী ভারতীয় সাংবাদিকরা কেবল হিন্দুদের ওপর হামলার বিষয়টি নিয়েই প্রতিবেদন করেছে, উপেক্ষা করেছে শেখ হাসিনা সরকারের এত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো। এর ফলে বাংলাদেশি পাঠকদের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

৪. ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা কেবল বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আগ্রহী, পুরো দেশের মানুষের প্রতি নয়। তাহলে কি দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক এগিয়ে যেতে পারবে? আগেও বলেছি এবং আবারও বলছি, ভারতের উচিত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে শেখ হাসিনার চোখে না দেখে গণতন্ত্রের চোখে দেখা।

৫. সম্প্রতি ভারতের সুপরিচিত একটি গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টের প্রকাশিত ভিডিওতে বিজেপি নেত্রী ও আইনজীবী মীনাক্ষী লেখি বলেছেন, 'প্রধান উপদেষ্টা … (বাংলা)দেশের নাম ইসলামিক রিপাবলিক অব ইস্ট পাকিস্তান করতে চান …।' তিনি এ তথ্য কোথায় পেলেন? তার এই বক্তব্যের উৎস কী? তার এই দাবি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং অপপ্রচারমূলক। শেখ হাসিনার বড় সাফল্যগুলো তুলে ধরার সময় তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে কারচুপির মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ দিয়েছিলেন—অথচ এগুলোই শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভের মূল কারণ।

দ্য ডেইলি স্টারে আমার টিমের সঙ্গে ৯ জুলাই থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় গণমাধ্যমে—প্রিন্ট ও অনলাইন—প্রকাশিত ৫৬টি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছি। এর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া সবই 'মতামতভিত্তিক প্রতিবেদন', 'সংবাদ প্রতিবেদন' নয়। অনেক শিরোনামের মধ্যে রয়েছে—'নির্বাচন এড়ানোর কৌশল হিসেবে সংস্কারের অজুহাত দিচ্ছেন ইউনূস'; 'প্রতিশোধের রাজনীতি—মন্ত্রীসহ ১৩ জন বিচারের সম্মুখীন'; 'বাংলাদেশে কি গণতন্ত্র ফিরবে?'; 'বাংলাদেশে ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পেছনে চীন, আইএসআই'; এবং 'শেখ হাসিনাকে সরিয়ে ভারতবিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠায় আইএসআইয়ের ষড়যন্ত্র'। এমনকি কিছু টেলিভিশন সংবাদে এটাকে 'ইসলামপন্থীদের দখল' বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এর কোনোটিতেই বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণ করার কোনো চেষ্টাও ছিল না।

এসব সংবাদের উৎস, উপস্থাপনা, শিরোনাম ও প্রতিবেদনের ভাষা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, ভারতীয় জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি গভীর ঘৃণা সৃষ্টি করতেই এই আখ্যান ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে বাংলাদেশে হিন্দুরা নিরাপদ নয়।

আমার মতে, মূলত দুই ধরনের চিন্তাধারার মাধ্যমে ভারতীয় গণমাধ্যমের কর্মকাণ্ড প্রভাবিত—যা কিছু রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও রয়েছে। একটি হচ্ছে, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার প্রতি গভীর অসম্মান এবং অপরটি ইসলামভীতি।

প্রথম চিন্তাধারাটি হলো—ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে স্পষ্টতই ইঙ্গিত করা হয় যে আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অক্ষম; আমাদের কী করতে হবে সেটা পাকিস্তানি, চীনা বা আমেরিকানদের বলে দিতে হবে—যদিও ভারতীয়দের কথা তারা উল্লেখ করে না। এই চিন্তাধারা সেই জাতির জন্য অত্যন্ত অপমানজনক যারা পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের পরাজিত করে স্বাধীন হয়েছে—যদিও ভারতীয় সহযোগিতায়। সেই জাতির জন্য চূড়ান্ত অসম্মানের, যারা স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের চাপিয়ে দেওয়া বাকশালকে বিলুপ্ত করেছে, জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনকে পরাজিত করেছে এবং এখন অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হওয়া শেখ হাসিনার শাসনকে উৎখাত করেছে। এগুলো কেবল আমাদের প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম ও দেশটির কিছু রাজনৈতিক নেতার অবজ্ঞার প্রকাশ, যেসব নেতাদের একজন আমাদেরকে উইপোকার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো—ভারতীয় গণমাধ্যমের ইসলামভীতি এবং মুসলিম বাঙালির মানসিকতায় ইসলামের গভীরতা সম্পর্কে তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে যারা মসজিদে যান, টুপি পরেন, দাড়ি রাখেন, সালাম দেন বা পবিত্র কুরআন পাঠ করেন, তারা ভারতীয় গণমাধ্যমের চোখে চরমপন্থি বা সন্ত্রাসী।

আমি কেবল ভাবি, তারা কেন নিজেদের কাছ থেকে কোনো শিক্ষা নেয় না। যদি হিন্দু ধর্মীয় চর্চার পুনর্জাগরণ, আরও মন্দির নির্মাণ, হিন্দু সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলো সংরক্ষণ ও আরও বেশি ধর্মচর্চা বর্তমান ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ হতে পারে, তাহলে আমরা বাংলাদেশিরা আরও বেশি ইসলাম ধর্ম চর্চা করলে কীভাবে সেটা আমাদের চরমপন্থি বানাবে? যদি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, আরএসএসের মতো দলগুলো ভারতে হিন্দু ধর্ম প্রচার করতে পারে এবং বিজেপির মতো রাজনৈতিক দল—যার লক্ষ্য ভারতে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করা—তিনবার নির্বাচিত হতে পারে; তাহলে কিছু ইসলামী দলের পুনঃআবির্ভাব কীভাবে আমাদেরকে একটি মৌলবাদী দেশে পরিণত করে?

ভারতীয় গণমাধ্যম ও নেতাদের উচিত তাদের মন ও হৃদয়কে উন্মুক্ত করা, মুসলিম বাংলার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য গভীরভাবে বোঝা এবং আমরা যেমন আছি, সেভাবেই আমাদের গ্রহণ করা, যেভাবে তারা চায় সেভাবে নয়। ভারতের জনগণ যে ভারত তৈরি করবে, সেটা যেমন আমাদের মেনে নিতে হবে; একইভাবে বাংলাদেশিরা নিজের দেশকে যেভাবে তৈরি করবে, ভারতকেও সেটা মেনে নিতে হবে। এভাবেই কেবল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টেকসই সম্পর্ক তৈরি সম্ভব। ভারতের উচিত, শাসকভিত্তিক সম্পর্কের বদলে জনগণভিত্তিক সম্পর্ক তৈরি করা। এর জন্য আমাদের অবশ্যই একে অপরকে আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং সেটা হতে হবে আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments