ভিআইপি রাষ্ট্রে ক্ষমতার বিকার

বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ঘটনাটি দেখে মনে হলো, এটা নিয়েও লেখা দরকার। কারণ প্রতিনিয়ত এই দৃশ্য দেখতে হয়।

রাজধানীর গ্রিন রোডে অবস্থিত একটি স্কুল। স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মূল সড়কে রিকশায় নেমে গলির ভেতরের পথটুকু হেঁটে যান। মূল সড়কে, অর্থাৎ স্কুলের প্রবেশ পথে যে নিরাপত্তারক্ষীরা দায়িত্ব পালন করেন, তারা শিক্ষার্থীদের বহনকারী কোনো গাড়িকেই ভেতরে ঢুকতে দেন না। কিন্তু প্রতিদিনই লক্ষ্য করি, ২-৩টি গাড়ি এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভেতরে যায়। যেহেতু রাস্তাটি সরু এবং স্কুল শুরু ও ছুটি হলে একসঙ্গে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের হাত ধরে হাঁটতে থাকেন, ওই ভিড়ের মধ্যে উল্লিখিত গাড়িগুলো সাইড দেওয়ার জন্য হর্ন বাজাতে থাকে।

এই স্কুলে পড়েন এমন অসংখ্য শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের এক বা একাধিক গাড়ি আছে। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অনেকেরই সন্তান এখানে পড়াশোনা করে। কিন্তু তাদের কাউকে দেখি না যে গাড়ি নিয়ে স্কুলের গেট পর্যন্ত যান। কিন্তু ২-৩টি গাড়ি প্রতিদিন ভেতরে ঢুকে যায়। নিরাপত্তা প্রহরীদের প্রশ্ন করলে তারা বলেন, 'কথা শোনে না। ধমক দেয়।' অল্প বেতনে চাকরি করে প্রতিদিন এরকম ধমক খেতে কে চায়? ফলে তারাও এখন আর এসব গাড়ি প্রবেশে বাধা দেন না।

অনেক দিন ধরে বিষয়টা লক্ষ্য করার পরে দুটি গাড়ির ছবি তুললাম। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সাদা রঙের মিৎসুবিশি পাজেরো ও সাদা রঙের হোন্ডা গাড়িতে পুলিশের স্টিকার লাগানো। গাড়ির মডেল দেখে ধারণা করা যায়, এগুলো পুলিশের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গাড়ি। প্রশ্ন হলো, এই স্কুলে আমলা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদেরও সন্তানরাও পড়াশোনা করেন। তাদের সন্তানকে বহনকারী গাড়ি ভেতরে ঢোকার অনুমতি না পেলে 'পুলিশ' লেখা গাড়ি কেন ঢুকবে? পুলিশ কি এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যায়?

ক্লাসরুমে একজন পুলিশ কর্মকর্তার সন্তানের যে অবস্থান, একজন ব্যবসায়ী বা বেসরকারি চাকরিজীবীর সন্তানেরও তা-ই হওয়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সে কথা বলে না। বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় গণ্ডির বাইরে এখন শিশুদের স্কুলের ভেতরেও চলে গেছে ভিআইপি কালচার। যার সবশেষ উদাহরণ বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, এই স্কুলের নিয়ম হচ্ছে সব শিক্ষার্থী পালাক্রমে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেবে। কিন্তু বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রুবাইয়া ইয়াসমিনের মেয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী কখনো ঝাড়ু দেয় না। পরিবারে সে বোধ হয় এই শিক্ষা পেয়েছে বা অভিভাবককে দেখে হয়তো তার মনে হয়েছে যে, সে যেহেতু বিচারকের মেয়ে, অতএব ক্লাসরুম ঝাড়ু দেওয়া তার কাজ নয়। সে অন্যদের চেয়ে আলাদা। সে 'প্রিভিলেজড' বা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত।

ক্লাসরুম ঝাড়ু দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হলে বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মাকে ওই বিচারক তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় স্কুলের সামনের রাস্তায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেহেতু অনেক বড় বড় ঘটনার জন্ম দিতে পারে, সে কারণে সরকারও তটস্থ থাকে যাতে কোনো ঘটনা খুব বেশি দূর না গড়ায়। সম্ভবত সেই ভয় থেকেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওই বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

ঘটনাটির আরও তদন্ত হবে কি না এবং তদন্তে ওই বিচারক দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, সেটি ভবিষ্যতই বলে দেবে। কিন্তু তার যে মেয়েটিকে এরকম একটি বাজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হলো; যার সামনে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে; কৈশোরের শুরুতেই সে যেভাবে সহপাঠীদের কাছে ভিলেন হয়ে গেল; যেভাবে সে নিজেকে তার সহপাঠীদের তুলনায় আলাদা বা সুপিরিয়র ভাবতে শুরু করল; সহপাঠীদের বস্তির মেয়ে বলার মতো ধৃষ্টতা শিখল—এসবের জন্য দায়ী কে? নিশ্চয়ই তার পরিবার। তার অভিভাবকের মধ্যে যে ক্ষমতার বিকার তৈরি হয়েছে, এই মেয়েটি সেই বিকারের নিরীহ ভুক্তভোগী।

রাজধানীর যে স্কুলের কথা লিখলাম; যে স্কুলের গেট পর্যন্ত কোনো গাড়ি না ঢুকলেও ২-৩টি বিশেষ পরিচয়ের গাড়ি প্রতিদিন ঢুকে যায়, ওইসব গাড়িতে যারা স্কুলে যাওয়া-আসা করে, তারা তাদের সহপাঠীদের সম্পর্কে, তাদের শিক্ষক সম্পর্কে, এই সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে কী ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠছে? তারাও কি নিজেদের সুপিরিয়র ভাবতে ভাবতে বেড়ে উঠছে না? এই ভাবনায় বেড়ে ওঠা শিশু ভবিষ্যতে যখন সরকারি চাকরি করবে, দেশের নীতিনির্ধারক হবে, জনপ্রতিনিধি হবে, তারা মানুষকে কি আদৌ মানুষ ভাবতে পারবে? নাকি তাদের বাবাদের মতো তারাও মানুষকে চাকরবাকর ভাববে? এই প্রজন্মের হাতে বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ থাকবে?

ভয়ংকর‌ ব্যাপার হলো, কিছু বিশেষ পেশার কিছু মানুষের মধ্যে যে ক্ষমতার বিকার তৈরি হয়েছে এবং বাড়ছে, তার বিরুদ্ধে কালেভদ্রে দুয়েকটি ঘটনার বাইরে সেভাবে কোনো প্রতিবাদ গড়ে ওঠে না। বগুড়ার এই ঘটনাটিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়লে বা সাংবাদিকরা জানতে না পারলে পুরোটাই ধামাচাপা পড়ে যেতো এবং যে অভিভাবককে বিচারকের পা ধরে মাফ চাইতে হয়েছিল, তাকেই মাথানিচু করে থাকতে হতো। একটা ভয়াবহ অন্যায় তাকে মুখ বুজে সয়ে যেতে হতো।

লজ্জার বিষয় হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে স্কুল শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই ঘটনায় স্কুলের শিক্ষকদের অনেকে ওই বিচারকের পক্ষে ওকালতি করেছেন। তারা প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীকে উল্টো শাসিয়েছেন। তার মানে, যে ক্ষমতার বিকার প্রশাসনের অনেক কর্মচারীর মধ্যে তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষমতার ভয়ে ভীত হয়ে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় শিক্ষকদের একটি অংশের ভেতরেও বিকার ছড়িয়ে পড়েছে। হয়তো তারাও নিজেদেরকে ভিআইপি ভাবতে শুরু করেছেন।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'অভিজাত সমাজ রাষ্ট্রকে কুক্ষিগত করছে। তারাই সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। মধ্যবিত্তের এখানে কোনো সুযোগ নেই। যেটা পাকিস্তানের শাসকদের সময়ও আমরা দেখিনি।'

সুতরাং প্রশ্ন হলো, জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে ভিআইপি রাষ্ট্র বানানোর এই প্রক্রিয়া কি চলতে থাকবে? ভবিষ্যৎ কী? অনেক হতাশার মধ্যেও ভবিষ্যৎ হয়তো এই বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। ক্লাসরুম ঝাড়ু দেওয়া নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির বিষয়ে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা যে ভাষায়, যেরকম সাহসী উচ্চারণে কথা বলেছেন; জেলা প্রশাসনের কর্তা এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ করে কিশোরী মেয়েরা যে শক্ত মেরুদণ্ড প্রদর্শন করলেন; যে মেধার স্বাক্ষর রাখলেন, সেটিই আমাদের আশাবাদী করে।

একজন শিক্ষার্থী জেলা প্রশাসককে বলেছেন, 'আপনি আজ এই অনুষ্ঠানে স্পেশাল গেস্ট হিসেবে এসেছেন, তাই আপনি এখন জেলা প্রশাসক। কিন্তু আপনি যখন আপনার মেয়েকে নিয়ে স্কুলের অনুষ্ঠানে আসবেন তখন আমাদের বাবা-মায়ের সাথে আপনার কোনো পার্থক্য থাকবে না। তাহলে স্কুলে মেয়েকে নিয়ে এসে বিচারক ক্ষমতা দেখান কিভাবে?' কী দুর্দান্ত যুক্তি! কী সাহস! এরাই তো বাংলাদেশ। ডিসি, জজ কিংবা প্রধান শিক্ষক এই মেয়েদের কাছ থেকে যদি কিছু শিখতে না পারেন, সেটি তাদের ব্যর্থতা।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Yunus, Tarique will decide what they'll discuss, says Shafiqul

The CA's press secretary says there is no specific format for the meeting but anything, including the current political situation, election timeline announced by the chief adviser, reforms, and July Charter can be discussed

42m ago