রাজনীতির সংস্কারে প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক উদ্যোক্তা

'হোয়াই নেশনস ফেল' বইয়ে লেখকদ্বয় জানার চেষ্টা করেছেন, কী কারণে একটি রাষ্ট্র কেবলই উন্নতির পথে এগিয়ে চলে, অথচ সকল দিক থেকে প্রায় একই উপাদান বিশিষ্ট অন্য আরেকটি রাষ্ট্র একান্ত প্রচেষ্টার পরও বারবার ব্যর্থ হয়।

ইতিহাস থেকে বিভিন্ন উদাহরণ টেনে তারা ব্যাখ্যা করেছেন যে উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে বহুমতের সুযোগ রয়েছে। সেখানে সব স্তরের জনগণের সম্পৃক্ততা রাষ্ট্র পরিচালনায় ও দেশের অন্য সব ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা হয়।

কিন্তু ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোতে বহুমতের সুযোগ নেই এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো নিপীড়ন ও শোষণমূলক। একটি উদার গণতন্ত্রই পারে জনগণের সর্ববিষয়ে সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে।

'ফিউচার অব ফ্রিডম' বইয়ের লেখক উদার গণতন্ত্রের সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন, 'এটি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা কেবল স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভোটের নিশ্চয়তাই প্রদান করে না সেই সঙ্গে এটি আইনের শাসন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, কথা বালার স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।'

ড. আকবর আলি খান তার একটি লেখায় ব্যক্ত করেছেন, বাংলাদেশে উদার গণতন্ত্রের উপাদানগুলো অনুপস্থিত। আমাদের প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানো, যা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। লেখাটিতে আমাদের সমস্যার মূল কারণ ও তা থেকে উত্তরণের একটি পথ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।

গণতন্ত্রের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা। কিন্তু কেবল এটাই যথেষ্ট নয়। সক্রেটিস বলেছিলেন, 'নির্বাচনে সঠিকভাবে ভোট প্রদান করা একটি দক্ষতা, যা অন্যান্য বিদ্যার মতোই আয়ত্ত করতে হয়। একজন অন্ধ ব্যক্তিকে যদি ঝড়ে কবলিত সাগরে জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে যে অবস্থার উদ্ভব হবে, জনগণের উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া ভোট প্রদানের ক্ষমতায় দেশের অবস্থা হয় ঠিক তেমনই।'

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লেখক ও চিন্তাবিদ আহমদ সফা একই কথা ভিন্নভাবে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, 'যে নিজের বিষয় নিজে চিন্তা করতে জানে না, নিজের ভাল-মন্দ নিরূপণ করতে অক্ষম, অপরের পরামর্শ এবং শোনা কথায় যার সমস্ত কাজ-কারবার চলে, তাকে খোলা থেকে আগুনে, কিংবা আগুন থেকে খোলায়, এইভাবে পর্যায়ক্রমে লাফ দিতেই হয়।'

জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করাই হলো একটি কার্যকারী গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত—এই বক্তব্য যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে কেন আমাদের নেতারা এ ব্যাপারে এ যাবৎ কোনো কার্যকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেননি?

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতা, যারা এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশের সূচনা করেছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন জমিদার শ্রেণির। তাদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের হয় কোনো যোগাযোগই ছিল না, অথবা তারা কখনই জনগণকে ক্ষমতায়ন করতে চাননি নিজেদের স্বার্থেই। স্বাধীনতার পর এই নেতৃত্ব শিক্ষিত মধ্যম শ্রেণির হাতে চলে যায়, যারা ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাবে জনগণের সেবক না হয়ে প্রভু বনে যান। ব্রিটিশদের প্রস্থানের পর প্রয়োজন ছিল উপনিবেশ ধারার সম্পূর্ণ বিনাশ, কিন্তু তা কখনোই হয়নি। স্বল্প কথায় এটিই দেশের রাজনীতি ও দেশ পরিচালনার অন্য সব প্রতিষ্ঠানের বিচ্যুতির মূল কারণ।

এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে অনেক রাজনৈতিক দল ওপর থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। এটি সাময়িক সমাধান হতে পারে, কারণ কোনো কিছুই একটি দুর্বল ভিতের ওপর বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি হলো জনগণ। তাদের সমন্বিত চাপই পারে রাজনীতি ও দেশ পরিচালনার সংস্থাগুলোকে জনবান্ধব রাখতে। তাই স্থায়ী সমাধান আসতে হবে নীচ থেকে—তৃণমূল মানুষকে সচেতন ও সামাজিক-রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার মাধ্যমে। জাতিসংঘ যাকে 'নাগরিক শিক্ষা' বলে আখ্যায়িত করেছে। এটি এমন এক শিক্ষা, যা জনগণকে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সরকারের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করবে; গণতন্ত্র, সাম্য ও নারী পুরুষের সমান অধিকার এবং জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক ধারনা দেবে।

আগের কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি এই কাজে উদ্যোগী হয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের জন বিচ্ছিন্নতার কারণে। তাই এটি অত্যন্ত জরুরি, যারা নাগরিক শিক্ষা সম্প্রসারণের গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিবেন, তারা তা করবেন জনগণের ভাষায় এবং তাদের সঙ্গে থেকে।

বর্তমানে রাজনীতির ক্ষেত্রটি দুর্নীতি, অপরাধ, পেশি শক্তি ও সহিংসতায় এতটাই নিমজ্জিত হয়ে পরেছে যে, কোনো সৎ ও দেশপ্রেমিক তরুণ এখানে প্রবেশের যৌক্তিকতা খুঁজে পান না। রাজনীতি আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি বিষয় প্রভাবিত করে বলেই এটাকে আপদমুক্ত ও আকর্ষণীয় করা অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি রাজনীতিকে যদি সর্বকালীন পেশা হিসেবে গ্রহণ উপযোগী করে তোলা যায়, যা থেকে আর্থিক নিরাপত্তা, সম্মান ও দেশ সেবার সুযোগ পাওয়া যাবে, তা হলে প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে অনেক মেধাবী তরুণ বা তরুণী এতে আকৃষ্ট হবেন। কোন কৌশল প্রয়োগে এটি সম্ভব?

'পলিটিকাল এন্ট্রিপ্রিনিউরশিপ' বইটির লেখক জসেফ লেনটেজ 'রাজনৈতিক উদ্যোক্তা' বলতে বুঝিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের, যারা নতুন কৌশল অবলম্বনে নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করেন। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাজনৈতিক উদ্যোক্তারা প্রয়োজনে দেশের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রণালী বদলে দেন। তাদের উদ্দেশ্য কেবল সংগ্রাম করে ক্ষমতায় যাওয়া নয়, তাদের লক্ষ্য হবে রাজনৈতিক ক্রীড়াঙ্গনের সম্পূর্ণ পুনর্ঘটন।

আমাদের দেশে এখন প্রয়োজন ওই ধরনের 'রাজনৈতিক উদ্যোক্তা'। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে যেখানে রাজনীতির মাঠ দুর্নীতির টাকা, দুর্বৃত্তায়ণ ও পেশী শক্তিতে দখল হয়ে গেছে, সেখানে শূন্য থেকে কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য সম্পূর্ণ নতুন কৌশল প্রয়োজন। এমন এক কৌশল, যা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সফল হবে।

রাজনীতির জন্য প্রয়োজন প্রচুর টাকা ও সময়। অর্থ সংগ্রহের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে রাজনৈতিক দলগুলো সদস্যদের চাঁদা, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অনুদান, দল থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে এসেছে। বড় কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য এই অর্থ যথেষ্ট নয়। তাছাড়া কোনো ধনী ব্যক্তি বা সংস্থার অনুদান এক ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, যা মোটেও কাম্য নয়। তাই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য অর্থের উৎস হিসেবে রাজনৈতিক উদ্যোক্তাদের নিজস্ব ব্যবসা থাকতে হবে।

একজন রাজনৈতিক উদ্যোক্তার প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জটি হলো একটি লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত করা, যার অবস্থান হবে তৃণমূল মানুষের কাছে। গ্রামে স্থাপনযোগ্য এমন ৩টি ক্ষেত্র রয়েছে, যা বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত ও তা দেশে-বিদেশে বাজারজাত। দ্বিতীয়টি পরিবেশবান্ধব পাটের তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি। তৃতীয়টি হালকা শিল্প স্থাপনা।

রাজনৈতিক উদ্যোক্তারা ড. ইউনুসের 'সামাজিক ব্যবসার' মডেল অনুসরণ করতে পারেন, যা সম্পূর্ণ লাভজনক ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। কিন্তু মুনাফার একটি অংশ রাজনৈতিক শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য ব্যয় করা হবে। ব্যবসার ধরন এমন হতে হবে, যা সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারে এবং এলাকার বেকারত্ব ও দারিদ্র দূরীকরণের সহায়ক হয়।

আর্থিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও এলাকায় সুপরিচিতির পর রাজনৈতিক উদ্যোক্তারা তরুণ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের সংগঠিত করে জনকল্যাণমূলক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে নিয়োজিত করে তার মাধ্যমেই রাজনৈতিক শিক্ষা দিতে পারেন। এই প্রক্রিয়াটি প্রবীণদের বিজ্ঞতা ও তরুণদের তেজস্বীয়তার মিথস্ক্রিয়ায় তৃণমূলে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করবে।

এলাকায় পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চয়ের আগে সম্পূর্ণ প্রোগ্রামটি এমন সুকৌশলে পরিচালিত করতে হবে, যাতে এটি সমাজসেবামূলক কাজ বলেই মনে হয়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়।

রাজনৈতিক উদ্যোক্তারা তাদের উদ্যোগের প্রাথমিক অর্থ অন্যান্য ব্যবসার ক্ষেত্রে যেভাবে যোগাড় করেন, ঠিক সেভাবেই সংগ্রহ করতে পারেন। যেমন: ব্যক্তিগত সঞ্চয়, বিনিয়োগ বা অংশীদারিত্বের মাধ্যমে।

যেহেতু সংগঠনের রাজনৈতিক দিকটি প্রাথমিক পর্যায় গোপন থাকবে, তাই ব্যাংক, এনজিও ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা নিতেও উদ্যোক্তাদের কোনো বাধা নেই। বিভিন্ন এলাকায় এই উদ্যোগের সফলতার পর রাজনীতিতে ইচ্ছুক অনেকেই এতে আকৃষ্ট হবেন। তাই আশা করা যায় অল্প দিনেই দেশব্যাপী এ ধরনের উদ্যোগের সংখ্যা  বৃদ্ধি পাবে।

সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ও জনসম্পৃক্ত একদল নেতা তৃণমূল থেকে আবির্ভূত হবে। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় সরকারগুলোর নেতৃত্ব গ্রহণ করে চূড়ান্ত পর্যায় তারা সংসদ জয় করে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্রটি স্থায়ীভাবে পাল্টে দেবেন।

এমন ব্যাপক পরিসরের একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য কত সময় ও অর্থের প্রয়োজন?

যেকোনো আন্দাজে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যার জন্য ২০ থেকে ২৫ বসর লেগে যেতে পারে। সেইসঙ্গে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ অর্থ। এতে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্র্যাক, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য এনজিও বিগত ২০ থেকে ৩০ বছর নিরক্ষরতা দূরীকরণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, কৃষি উন্নয়ন এবং দারিদ্রতা নিরসনের মতো বড় বড় কাজে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। এই প্রক্রিয়ায় তাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে, যার বড় অংশ তারা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমেই আয় করেছে। রাজনৈতিক উদ্যোক্তারা একই কৌশল অবলম্বন করবেন, তবে ভিন্ন একটি সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে।

বিখ্যাত ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্থনি গিডিন্স বলেছেন, 'চেষ্টা ছড়া কোনো কিছু্‌ই পাওয়া যায় না, তবে সর্বস্তরে গণতন্ত্র সম্প্রসারণের জন্য যেকোনো সংগ্রামই মূল্যবান এবং এতে সফলকাম হওয়া খুবই সম্ভব।'

সাইফুর রহমান: জ্যেষ্ঠ তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সার্টিফাইড প্রফেশনাল অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Polythene ban: A litmus test for will and eco-innovation

Although Bangladesh became the first country in the world to announce a complete ban on the use of polythene bags in 2002, strict enforcement of the much-lauded initiative has only started taking shape recently.

15h ago