বাংলা একাডেমির ‘আদর্শ’
'আদর্শবিরোধী' বই প্রকাশের 'অপরাধে' এবার অমর একুশে বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়নি বাংলা একাডেমি—এমন অভিযোগ এখন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলা একাডেমির আদর্শ কী এবং একটি প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ায় লাভ হলো কার?
স্মরণ করা যেতে পারে, 'আদর্শবিরোধী' বই লেখার 'অপরাধে' এই বাংলা একাডেমি এলাকাতেই নৃশংস হামলার শিকার হয়েছিলেন প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এবং একাডেমির অদূরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় নৃশংস হামলায় নিহত হয়েছেন লেখক অভিজৎ রায়—যার বিরুদ্ধেও কথিত আদর্শবিরোধী লেখার অভিযোগ ছিল। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ভিন্নমত রয়েছে এমন বই প্রকাশ করায় প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক কি না?
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৫ সালে 'নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর' নামের একটি বইতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিয়েছিল বইমেলা পরিচালনা কমিটি। এর পরের বছর ২০১৬ সালে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' দিতে পারে এমন আশঙ্কায় অমর একুশে বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় লেখকসহ পাঁচ জনকে আটকও করা হয়। তার মানে কনটেন্ট পছন্দ না হলে সেই প্রকাশনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট কিংবা প্রতিবেশী কলকাতায়ও যে বইমেলা হয়, সেখানেও কনটেন্টের কারণে কোনো প্রকাশনীকে স্টল না দেওয়া বা স্টল বন্ধ করে লেখক-প্রকাশককে কি কখনো গ্রেপ্তার করা হয়েছে?
এই প্রসঙ্গে এবার বাংলা একাডেমির সচিব আবুল হাসান মো. লোকমানের বক্তব্যটি খেয়াল করা যাক। স্টল বরাদ্দের অনুষ্ঠানে তিনি প্রকাশকদের উদ্দেশে বলেছেন, 'বিশেষ বিশেষ বইয়ে কিছু কনটেন্ট আছে, খুবই নেতিবাচক। যদি কারও থাকে, আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, তারা বইগুলো এবার স্টলে তুলবেন না। সহজ কথা হচ্ছে আমরা শুদ্ধাচারী জাতি, বাঙালি জাতি। আমরা চাই একটি সুন্দর-সুখময় শান্তির স্বদেশ। আমরা চাই দূষণমুক্ত, মাদকমুক্ত, বাল্যবিবাহমুক্ত, জঙ্গিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, মিথ্যামুক্ত এবং অন্যায় অপরাধমুক্ত বাংলাদেশ।' উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের বইমেলায়ও প্রকাশকদের প্রতি এমন আহ্বান জানিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক, প্রয়াত কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী (প্রথম আলো, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।
প্রশ্ন হলো, বিতর্কিত বইয়ের মানদণ্ড কী?
শোনা যাচ্ছে, আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তিনজন লেখকের তিনটি বই নিয়েই মূলত বাংলা একাডেমির আপত্তি। এগুলো হচ্ছে ফাহাম আব্দুস সালামের 'বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে, জিয়া হাসানের 'উন্নয়ন বিভ্রম' এবং ফৈয়জ আহমদ তৈয়্যবের 'অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা'। এর মধ্যে 'বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে' বইতে বাঙালি জাতিসত্তা, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, বিচার বিভাগ, বাংলাদেশের সংবিধান, সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অশ্লীল, রুচিগর্হিত, কটাক্ষমূলক বক্তব্য রয়েছে—যা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থী। এ কারণে এই বইটি মেলায় না আনার শর্তে স্টল বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তাতে রাজি হয়নি আদর্শ প্রকাশনী। বরং তারা বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলা একাডেমির যুক্তি বিনা তর্কে খারিজ করে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা-ই বলা বা লেখা নয়। কিন্তু প্রশ্নটা অন্যখানে। সেটি হলো, উল্লিখিত বইতে যে এই ধরনের আপত্তিকর লেখা আছে, সেটি তো এই বই যারা পড়েননি বা ভবিষ্যতে যারা পড়তেন না, তারা কোনোদিনই জানতে পারতেন না। বরং এখন বাংলা একাডেমি নিজেই বিষয়টি জাতিকে জানালো। ফলে যারা বইটি পড়েননি বা পড়ার ইচ্ছে ছিল না, তারাও এখন কৌতূহলবশত বইটি কিনবেন। পড়বেন। সাথে সাথে আরও যে দুটি বই সম্পর্কে আলোচনা উঠেছে, সেই বই দুটির বিক্রিও বেড়ে যাবে এবং ধারণা করা যায় বাংলা একাডেমির বইমেলা শেষ হওয়ার আগেই বই তিনটির সবগুলো কপি বিক্রি হয়ে যাবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে সেটিই মনে হয়। অসংখ্য মানুষ লিখেছেন যে তারা বইগুলো পড়েননি বা এগুলো সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না। কিন্তু এখন কিনবেন। তার মানে বাংলা একাডেমি নিজেই বই তিনটির বিজ্ঞাপন করে দিলো। সেইসঙ্গে আদর্শ প্রকাশনীর নামও এখন সারা দেশের মানুষ জানল। তাদেরও বিজ্ঞাপন হলো। তারা বইমেলায় স্টল পাক বা না পাক; বইমেলায় অংশ নিলে তাদের যে পরিমাণ বিক্রি হতো বা না হতো—তার চেয়ে বেশি যে তারা প্রচার পেলো সেটির আর্থিক মূল্যও অনেক। এই ঘটনাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও লুফে নেবে এবং বাংলাদেশে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই এবং বাংলা একাডেমির মতো একটি সৃষ্টিশীল প্রতিষ্ঠানও যে স্বাধীন নয়, অনেকেই এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটি প্রমাণ করতে চাইবেন। এমনকি ফাহাম আবদুস সালাম, জিয়া হাসান এবং ফয়েজ তইয়্যেবের আরও কী কী বই আছে—পাঠকদের অনেকেই হয়তো সেগুলোর সন্ধান করবেন।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন: 'এবারের বইমেলায় প্রধান আকর্ষণ একটি বই, + ২টি বই + একটি প্রকাশনা সংস্থা যা কোনোটাই মেলায় থাকবে না। যেসব বই নিয়ে পাবলিক চর্চা ছিল একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেটা সবার জন্য সুপার সেলার বানাইলো বাংলা একাডেমি।'
ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আদর্শ প্রকাশনী কিংবা উল্লিখিত তিন লেখকের নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বাংলা একাডেমি নিজেই তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করল কি না এবং বাংলাদেশ সরকারকেও প্রশ্নের মুখে ফেলল কি না?
দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, কোনো একটি বইতে যদি এমন কোনো কনটেন্ট থাকে যা দেশের প্রচলিত আইনবিরোধী—তারপরও বাংলা একাডেমির মতো একটি প্রতিষ্ঠান ওই বই প্রকাশের অপরাধে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে বইমেলায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা, স্টল বরাদ্দ না দেওয়া কিংবা স্টল বন্ধ করে দিতে পারে কি না?
বই একটি সৃষ্টিশীল মাধ্যম। এই মাধ্যমে যদি আপত্তিকর কিছু থাকে, সেটির জবাব আরেকটি বই লিখেই দেওয়া যায়। তাছাড়া সব লেখকের সব লেখাই যে বাংলা একাডেমি কিংবা সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনঃপুত হবে—এমন কথা নেই। ভিন্ন মতের অনুসারী বা সরকারের কট্টর সমালোচকরা কড়া ভাষায় সমালোচনা করবেন—এই অধিকার গণতন্ত্রে স্বীকৃত। পাঠক বিচার করবে ওই লেখা বা বই তারা গ্রহণ করবে কি না।
একজন লেখক কী লিখবেন, সেটি বাংলা একাডেমি ঠিক করে দিতে পারে না। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, ভবিষ্যতে পাঠকরা কোন বই কিনবেন ও পড়বেন—সেটাও কি বাংলা একাডেমি ঠিক করে দেবে?
মোদ্দা কথা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় তর্ক-বিতর্ক থাকবে। সেজন্য বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের আয়োজন করা। বিভিন্ন মত ও আদর্শের লেখকদের এক মঞ্চে ডেকে তাদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার সৃষ্টি করা। কিন্তু সেটি না করে তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি দেশে ভিন্ন মত প্রকাশের পথকে রুদ্ধ করবে।
সাধারণত প্রথিতযশা অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখকরাই বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পান। কমিটিতেও বিশিষ্টজনরা থাকেন—যারা ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কথা বলেন। সহনশীলতার কথা বলেন। প্রশ্ন হলো, এবার আদর্শ প্রকাশনীর তিনটি বই ইস্যুতে যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, সেখানে ওই বিশিষ্ট লেখকদের অবস্থান কী? স্বয়ং একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা—যিনি নিজেও একজন খ্যাতিমান কবি, তার অবস্থানই বা কী? এই ধরনের সিদ্ধান্ত কি বাংলা একাডেমি স্বপ্রণোদিত হয়েই নেয় নাকি সিদ্ধান্তটি অন্য কোনো জায়গা থেকে হয়—বাংলা একাডেমি শুধু সেটির বাস্তবায়ন করে? রাজনৈতিক বা দলীয় আদর্শ বিবেচনায় নিয়ে লিখিত কোনো বইতে যদি সরকারের সমালোচনা থাকেও, তারপরও কি বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান ওই ধরনের বই প্রকাশের দায়ে কোনো প্রতিষ্ঠানকে মেলায় অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করতে পারে? এই ধরনের সিদ্ধান্তের পেছনে কি বাংলা একাডেমির ওপর কোনো রাজনৈতিক চাপ থাকে?
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments