অবহেলার এই দৃশ্যগুলো অচেনা নয়

এই দৃশ্যগুলো যেমন আমাদের কাছে খুব অচেনা নয়, তেমনি এগুলো নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশও নেই ব্যস্ত নগরবাসীর। অথবা জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত মানুষ এগুলোকে স্বাভাবিক বলেই মনে করছে। দৃশ্যগুলো এমন, একজন নারী শ্রমিক ইট ভাঙছেন, পাশে চাদরের ওপর শুয়ে আছে তার এক বছর বয়সী শিশু। আরেকজন পুরুষ শ্রমিককে দেখলাম ফার্মগেটে ফুটপাতে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছেন তার মাল বহনকারী ডালিটার মধ্যেই। হয়তো সকালে উঠেই আবার কাজের জন্য দৌড়াতে হবে, হয়তো এই শহরে তার মাথা গোঁজার মতো কোনো ঘরবাড়ি নেই।

গভীর রাতে বাসার সামনে একদল শ্রমিক কাজ করছেন, তাদের কথাবার্তার আওয়াজ শুনে উঁকি দিয়ে দেখলাম সেখানে প্রায় অর্ধেকই নারী শ্রমিক। সারারাত পুরুষদের সঙ্গে কাজ করছেন শুধু দুমুঠো খাবার জোগাড়ের জন্য। ৭০ বছর বয়সী রিকশাচালক হামিদ আলী যখন বলেন, রিকশা চালাতে না পারলে তার পরিবারের খাওয়া জোটে না, তখন বোঝা যায় জীবন হামিদ আলীকে বিশ্রাম দেবে না। এভাবে কাজ করতে করতেই একদিন চলে যাবেন।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় অসংখ্য নারী-পুরুষ হাতে কুড়াল, লাঠি ও ডালি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নগরীর মোড়ে মোড়ে দিনমজুরির জন্য। তারা সবাই শ্রমিক। কাজ জুটলে টাকা পাবেন, নয়তো পরিবার নিয়ে একবেলা খেয়ে বা অনাহারে থাকবেন। এই দৃশ্যগুলো আমাদের অচেনা নয় ঠিকই, আবার খুব চেনাও নয়।

এই দেশে শ্রমিকের জীবন এতটাই মূল্যহীন যে তাদের নিরাপত্তা, সন্তানের যত্ন বা আরাম-আয়েশ সবই গৌণ, সেখানে তাদের দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য। অথচ এই দুমুঠো খাবার জোগাড় করাটাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে শ্রমিকদের কাছে। করোনাকালের কঠোর দারিদ্র্য মোকাবিলা করে এখনো যারা কাজ করে যেতে পারছেন, তাদেরও জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৪ জন শ্রমিক নিহত এবং ১ হাজার ৩৭ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। নিহত শ্রমিকের মধ্যে ১ হাজার ২৭ জন পুরুষ ও ৭ জন নারী।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) জরিপে এসব তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি 'বাংলাদেশের শ্রম ও কর্মক্ষেত্র পরিস্থিতি বিষয়ে সংবাদপত্র ভিত্তিক বিলস জরিপ-২০২২' প্রকাশ করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে এই জরিপ করেছে সংস্থাটি।

জরিপ অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে মারা গেছেন ও আহত হয়েছেন। গত বছর নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হন ১৩৫ জন, আর আহত হন ১৫৫ জন। নির্যাতনের ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, ছুরিকাঘাত, খুন, রহস্যজনক মৃত্যু, অপহরণ, মারধর ইত্যাদি।

২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রের বাইরে নির্যাতনের শিকার হন ৩৩০ জন শ্রমিক। ৪৯৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষিখাতে।

এ ছাড়া দিনমজুর ৪৬ জন, কনটেইনার ডিপোতে ৪৪ জন, মৎস্য শ্রমিক ৪৩ জন, ইলেক্ট্রিক শ্রমিক ২২ জন, নৌপরিবহন খাতে ১৫ জন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিক ১২ জন, ইটভাটা শ্রমিক ১০ জন, জাহাজ ভাঙা শিল্পে শ্রমিক ৭ জন, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি শ্রমিক ৬ জন এবং অন্যান্য খাতে ১০০ জন শ্রমিক নিহত হন।

আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য আইন আছে, শ্রমিকের জীবনের মূল্যও আছে, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তাদের মজুরি দেওয়ার কথা ধর্মে বলা আছে, শ্রমিকদের ভালোমন্দ দেখার জন্য বিভিন্ন বোর্ড ও সংগঠন আছে, সরকার শ্রমিকদের কল্যাণ দেখার জন্য একটি মন্ত্রণালয় রেখেছেন, প্রবাসী অভিবাসী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা দেখার জন্যও আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। কিন্তু এরপরেও শ্রমিকরা অবহেলিত গোষ্ঠী।

বাংলাদেশে যারা নির্মাণশ্রমিক, যারা সুইপার, যারা দাহ্য পদার্থের গুদামে কাজ করেন এবং গাড়ির গ্যারাজে ওয়েল্ডিং কাজ করেন, তাদের নিরাপত্তা প্রায় শূন্যের কোঠায়। আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও শুধু টাকা বাঁচানোর জন্য মালিকরা শ্রমিকদের নিরাপত্তার ইস্যুটি গণনার মধ্যে আনেন না।

দেখা গেছে, অনেক কারখানায় শ্রমিকদের প্রায় বন্দি করে রাখা হয়। বিপদ এলে তারা পালিয়েও বাঁচতে পারেন না। কেমিক্যাল সংরক্ষণে অদক্ষতা ও অবহেলা, ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, কারখানার ভবনে জরুরি বহির্গমন পথ না থাকা, বহির্গমন পথ তালাবদ্ধ করে দেওয়া, কারখানা নির্মাণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমতি না নেওয়া, নিরাপত্তার বিষয়ে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ না দেওয়া, নিয়মিত অগ্নিনির্বাপণ মহড়া না করা ইত্যাদি কারণে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটলে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে না। মালিক কর্তৃপক্ষের কাছে শ্রমিকের জীবনের চাইতে সম্পদের নিরাপত্তা বেশি জরুরি।

আমরা যখন শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে কথা বলি, তাদের দাবি আদায়ের কথা বলি, তখন তা শুধু আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কথা বলি। কারণ তাদের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন ও অধিকার রয়েছে। কিন্তু, যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, তাদের কথা তো কেউ ভাবেও না, কোথাও লেখাও নেই।

তাদের মধ্যে আছেন ছাড়া কামার, কুমার, জেলে, মাঝি, তাঁতি, বিদ্যুৎ শ্রমিক, চা-শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, রাসায়নিক দ্রব্য বা সেপটিক ট্যাংক বা পানির ট্যাংকের বিষাক্ত গ্যাস সরানোর কাজসহ পরিবহনের নানান কাজে নিয়োজিত আছেন লাখো শ্রমিক। আছেন কৃষি শ্রমিক ও গৃহকর্মীও।

দেশে কৃষিখাতে কাজ করছেন অসংখ্য নারী শ্রমিক। নারী শ্রমিক, যারা চাতালে কাজ করেন, যারা বীজ বপন, ধান কাটা, মাড়াই, এমনকি জমিতে হাল দেন, তাদের জন্য নেই ন্যূনতম কোনো সুবিধা। এই শ্রমিকরা প্রায় সারা দিন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারেন না। গ্রামে যারা জমিতে কাজ করেন, তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশে মোট ৫ কোটি ৬৭ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে শতকরা ৪৭ দশমিক ৬ জন কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। আবার এদের মধ্যে শতকরা ৬৪ দশমিক ৮ জন নারী।

বাংলাদেশের উন্নয়নে অনেক সেক্টরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন শ্রমিকরা। এই কথা সবাই বলে ও জানে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির জন্য ন্যূনতম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আমাদের অনেকের মধ্যেই নেই। বিশেষ করে মালিক গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ শ্রমিকদের আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু তাদের ভালো মন্দের দায়িত্ব নিতে চান না। আর দায়িত্ব নেন না বলেই এতজন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যা তো শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য, অপ্রকাশিত তথ্য হয়তো আরও অনেক বেশি।

একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মজুর, মুটে বা কুলি আহত বা নিহত হলে কী এসে যায় রাষ্ট্রের বা মালিকের বা আমাদের মতো কর্মজীবীদের? আমরা দেখেছি শ্রমিকরা যখন তাদের বেতন ভাতার দাবিতে আন্দোলন করেন, তখন কেউই তাদের পক্ষে থাকে না।

মালিকের পেটোয়া বাহিনীর মার খেয়ে পথ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। শুধু মে দিবস কেন্দ্রিক সংগ্রামী চেতনার কোনো মূল্য নেই শ্রমিকদের কাছে। যারা প্রতিদিন রুটি-রুজির জন্য সংগ্রাম করছেন, তারা চান সঠিক মজুরি, যথাসময়ে মজুরি, সম্মান, নিরাপত্তা ও একটু ভালোবাসা।

শ্রমিকরা যতক্ষণ না নিজেরা পথে নামেন, স্লোগান দেন, রাস্তায় বিক্ষোভ করেন, ততক্ষণ তাদের কথা আমরা ভুলেই থাকি। এমনকি এই শহরে আসলে কতজন শ্রমিক আছেন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে, এরও কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

২০১৩ সালে যখন সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক, আহত হয়ে চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন আরও অনেকে, তখন আমরা সবাই সম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আওয়াজ তুলেছিলাম শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে।

কিন্তু এরপর ঘটে গেল জুস বানানোর কারখানায় হত্যাযজ্ঞ। অসংখ্য শিশু শ্রমিকের লাশ বের হয়ে এলো। ঘটে গেল চট্টগ্রামের ডিপোতে বিস্ফোরণ, আগুনে পুড়ে গেল অসংখ্য শ্রমিক। এর ফাঁকে আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, এতে শ্রমিক নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারগুলো ডুবে গেছে, সন্তান এতিম হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজনই বোধ করি না। কারণ এই মানুষগুলোর প্রাণের কোনো দাম নেই।

শ্রমিকরা এখন অধিকারের দাবি তুলতে ভয় পান। কারণ তারা লক্ষ্য করেছেন, যে যাই বলুক, আসলে তাদের পাশে কেউ নেই। শক্তির ভারসাম্যে শ্রমিকরা দুর্বল হয়ে পিছিয়ে পড়েছেন বলে তাদের অধিকারের দাবিও সংকুচিত হয়েছে।

সরকার সবসময় মালিকের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করে বলে এদেশের মালিকরা নগদ মুনাফার লোভ ছাড়তে পারে না। নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না নিয়েই গড়ে উঠছে শত শত কারখানা এবং শ্রমিকদের নিয়োগদান। অবশ্য এর বাইরেও অসংখ্য শ্রমিক আছেন, যারা সামাজিক সুরক্ষারও বাইরে অবস্থান করছেন।

যেমন আমাদের পাশে যে হকার, মিস্ত্রি, কুলি, ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, চা-ওয়ালা, বাদামওয়ালা, সবজি বিক্রেতা, ক্ষুদে দোকানদাররা আছেন, তারা কেউই শ্রমিক পরিচয়ে পরিচিত নয়। তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় নেই বলে প্রতিদিনই নানারকম অমর্যাদা, চাঁদাবাজি ও হয়রানির মধ্যে দিয়ে তাদের বাঁচতে হয়। অবশ্য তাদের বাঁচা-মরার বিষয়টি নিয়ে কারো কিছু যায় আসে না।

এরপরও প্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকদের আয়ে যারা লাভের মুখ দেখছেন, তারা কিন্তু চাইলেই শ্রমিকদের জন্য কিছু সুবিধার ব্যবস্থা করতে পারেন। এতে তাদের উৎপাদন কমবে না, বরং বাড়বে। শ্রমিক ভালো থাকলে মালিকও যে আরও ভালো থাকবেন, এই সহজ কথাটা কবে বুঝবেন আমাদের দেশের মালিকপক্ষ?

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Admin getting even heavier at the top

After the interim government took over, the number of officials in the upper echelon of the civil administration has become over three times the posts.

8h ago