তারুণ্যের সংকট, তারুণ্যের জয়

'ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখীর ঝড়!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!'

'প্রলয়োল্লাস' কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এইভাবে নতুনকে কেতন ওড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু নজরুল নয়, সুকান্ত ভট্টাচার্য তার 'তারুণ্য' কবিতায় লিখেছেন—

'তারুণ্যের প্রত্যেক আঘাতে কম্পমান
উর্বর-উচ্ছেদ। অশরীরী আমি আজ
তারুণ্যের তরঙ্গের তলে সমাহিত
উত্তপ্ত শয্যায়। ক্রমাগত শতাব্দীর
বন্দী আমি অন্ধকারে যেন খুঁজে ফিরি
অদৃশ্য সূর্যের দীপ্তি উচ্ছিষ্ট অন্তরে।'

গদ্য, পদ্য, ছন্দ-গীতিতে তারুণ্যকে এইভাবেই বর্ণনা করেছেন কবি-সাহিত্যিকেরা। সাহিত্য, সংগ্রামে তারুণ্যের জয়ধ্বনি নিশ্চিত। নিশ্চিত জেনেও আমাদের দেশে তারুণ্য কেন জানি উপেক্ষিত। কারণ কি জানা?

উদ্যোক্তা থেকে উদ্যম, সাহস থেকে সংগ্রাম, উল্লাস থেকে উদ্ভব, রাজপথ থেকে রাজনীতি, উচ্চারণ থেকে উত্তোলন সবকিছুতে এখন তারুণ্যই মুখ্য। শুধু মুখ্য নয় নেতৃত্ব এখন তরুণদের হাতে। কাজী নজরুলের মতো বলতে হয়, "শির নেহারি' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির।"

চারদিকে যখন তারুণ্যের এত উৎসব তখন আমাদের তরুণেরা কী করছে। গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার বিষয় এখন তরুণদের বিপথে যাওয়া, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া। এই আলোচনা একদিনে তৈরি হয়নি বা ঘুম থেকে উঠেই কেউ দেখিনি যে, তরুণেরা বিপথে যাচ্ছে। তাদের বিপথে যাওয়ার জন্য আমাদের সমাজ, পরিবেশ, শিক্ষা, প্রশাসন, রাজনীতি, সংস্কৃতি অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। দ্বিমত করবেন? সেই সুযোগও নেই। যুক্তি এবং বাস্তবতা আপনাকে মানতেই হবে।

উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে সমস্যা এবং সংকট ভুরি ভুরি। কিন্তু সেই সংকট বা সমস্যা নিরসনে রাষ্ট্রের ভূমিকা বা রাষ্ট্রের আগ্রহ কতখানি সেই প্রশ্ন বারবার আসে। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ মানেই কিন্তু সুখের স্বর্গ নয়। নিজ দেশ মানেই কিন্তু ঘৃণা বা হতাশার কেন্দ্রবিন্দু নয়। পরিবেশ এবং সমাজ ধাপে ধাপে সেই সংকট বা সমস্যাকে বড় করে তোলে।

'তালেবান' ফ্যান্টাসিতে আফগানিস্তানে রাজ্জাক [ঢাকা পোস্ট, মনি আচার্য্য, ১৫ আগস্ট ২০২১], জঙ্গিবাদে জড়িয়ে 'হিজরত', ঘর ছেড়েছেন সাত তরুণ [প্রথম আলো, টিপু সুলতান ও গাজীউল হক, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২], সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে গঠিত হয় নতুন 'জঙ্গি মঞ্চ' [ঢাকা পোস্ট, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, ০৬ অক্টোবর ২০২২], সিলেটের 'উধাও' হয়ে যাওয়া পাঁচ তরুণ কোথায়, জানেন না স্বজনেরা [প্রথম আলো, সুমনকুমার দাশ, ১১ অক্টোবর ২০২২], জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল, নেতৃত্ব-উদ্দেশ্য-অস্তিত্ব, সব নিয়েই ধোঁয়াশা [ঢাকা পোস্ট, মনি আচার্য্য, ১৯ অক্টোবর ২০২২], 'হিজরত করা তরুণদের পাহাড়ে ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো' [বাংলা ট্রিবিউন, বান্দরবান প্রতিনিধি, ২১ অক্টোবর ২০২২], বান্দরবানে মাসিক ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয় কেএনএফ [প্রথম আলো, বান্দরবান প্রতিনিধি, ২১ অক্টোবর ২০২২]।

এবার আরও পেছনে ফেরা যাক। ১ জুলাই, ২০১৬। হলি আর্টিজানের ভয়াবহ হামলা গোটা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। পাঁচ তরুণের অস্ত্রসহ হাস্যোজ্জ্বল ছবি আমাদের ভাবিয়েছে। স্তব্ধ করে দিয়েছে সব চিন্তা। কেন এমন হলো? এমন কি হওয়ার কথা ছিল? না। কিন্তু কেন হলো? অভাবে। ক্ষুধায়? না। সাংস্কৃতিক চর্চা, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, সাংস্কৃতিক জোয়ারের অভাবে। একটু বিশদে বলি। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন প্রোগ্রাম ২০২২-এ আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তরুণদের নিয়ে তাদের আগ্রহ এবং পরিকল্পনা সত্যিই বিস্মিত করেছে আমাকে। দেশের সাথে দেশের তুলনা নয়, অভিজ্ঞতা জানানোই জরুরি।

তরুণদের কথা মাথায় রেখে তারা দারুণ সব পরিকল্পনা করেছে যা সত্যিই বিস্ময়কর। প্রধানমন্ত্রীর সংগ্রহালয়, ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ, তাজমহল, আগ্রা রেড ফোর্ড, ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি), ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দিল্লি গেট, ওয়ার মিউজিয়াম, ব্যাঙ্গালোর রাজভবন, কর্নাটক গভর্নরের সাথে সাক্ষাৎ, কর্নাটক বিধানসভা, গুরুদেব শ্রী শ্রী রবিশঙ্করের বক্তৃতা, আর্ট অব লিভিং, ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, ইনফোসিস, মাইসোর প্যালেস, কৃষ্ণরাজা সাগর বাঁধ, বৃন্দাবন গার্ডেন, মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষ্ণ রাজেন্দ্র হসপিটাল, ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক ও ভারতের ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ স্মরণে রাখার মতো।

১২ অক্টোবর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত এই গোটা সময়ে তারা ভারতকে আমাদের সামনে এনে হাজির করেছে। আমরা জেনেছি তাদের সংস্কৃতি, আচার, খাবার, ব্যবহার, পোশাক, চলন-বলন সম্পর্কে।

এইরকম সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের উদ্যোগ কি আমরা নিতে পেরেছি? আমরা কি আমাদের তরুণদের নিয়ে আলাদা করে ভাবি? যেখানে কলাবাগানের একটা খেলার মাঠ উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার অপেক্ষা করতে হয় সেখানে আমাদের শিশুরা খেলবে কোথায়? আর তাদের মানসিক বিকাশ হবে কীভাবে? কলাবাগানের মাঠ একটা প্রতীক মাত্র। দেশের অসংখ্য মাঠ এখনো প্রভাবশালী রাজনৈতিকদের দখলে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।

আমি সেইসব তরুণদের কথা ভাবি যাদের মুখের কথা দিয়ে, ধর্মের ভয় দেখিয়ে, প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে বিপথে নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। তাদের যদি সাংস্কৃতিক চর্চা বা সাংস্কৃতিক আবহে রাখা যেত তারা কি বিপথে যেত? তাদের যদি শিশুকাল থেকেই খেলাধুলা, বইপাঠ বা সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে তোলা যেত তবে কি তারা বিপথে যেত? যেত না। বিপথে যাওয়া তরুণদের সুপথে আনার পথ বা প্রক্রিয়া আমরা জানি কিন্তু কেন জানি আমাদের বা সরকারের বা রাষ্ট্রের সেদিকে মনোযোগ কম। আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাই শিশু, তরুণ, শিক্ষা, সংস্কৃতি বাদ দিয়ে।

সাড়ে চার কোটি তরুণের দেশ [প্রথম আলো, আরিফুর রহমান, ২৯ জুলাই ২০২২]। এই সাড়ে কোটি তরুণকে আমরা চাইলেই শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারি। কেন আমরা সেদিকে মনযোগী না? কেন তাদের সংকটকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি না তা আমাকে বারবার ভাবায়।

বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন প্রোগ্রামে যেসব তরুণ গিয়েছে তারাই কিন্তু বাংলাদেশ। এইখানে চা বাগান থেকে উঠে আসা মুক্তা দোষাদের গল্প জেনেছি। যে মুক্তা সংগ্রাম করে উঠে এসেছে। খাবারের টাকা ছিল না সেখানে পড়াশোনা করা তো দূর পাহাড়ের গল্প। তারপরও মুক্তা ভয়ানক প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে শিক্ষিত করে তুলেছে।

আমরা জেনেছি শমরিতা পাল ঐশীর কথা। যে ঐশীকে এখনো বাবা-মা দেখে রাখে। সেই ঐশী ১৮টা বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দিয়েছে একক প্রচেষ্টায়। আমরা জেনেছি নুসরাত সাবরিন চৌধুরীর কথা। যে নুসরাত আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষকে বাঁচিয়েছে। জেনেছি প্রদীপ্ত সাক্ষর জয়ের কথা। যে কি না চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ার পাশাপাশি টেন মিনিট স্কুলে পড়াচ্ছে। তরুণদের উৎসাহিত করছে। জেনেছি চন্দন কুমার পালের কথা। যে চন্দন লক্ষ বেতনের চাকরি ফেলে শুধু তরুণদের উজ্জীবিত করার জন্য মহান আদর্শের শিক্ষকতা বেছে নিয়েছে। জেনেছি নাহিদা খান সুর্মির কথা। বাচ্চা একটা মেয়ে অথচ কী দারুণ দায়বোধসম্পন্ন। এই বয়সে সে বিশেষ শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। এই বোধ বা তাড়নার কথা তাকে কেউ বলে দেয়নি। নিজ থেকেই করেছে। জেনেছি সাহস মুস্তাফিজের কথা। যে অসম্ভব মেধাবী একজন তরুণ। নিজের পেশার পাশাপাশি পিআইবিতে ফ্যাক্ট চেকের উপর কারিকুলাম তৈরি করে সাংবাদিকদের সচেতন করছে। পেয়েছি শারমিন সুপ্তাকে। জাতীয় দলের নারী ক্রিকেটার। দেশ নিয়ে তার বোধ, চিন্তা আমাদের মুগ্ধ করেছে। জেনেছি উত্তম কাব্য, ডা. অর্থি মণ্ডল, আনন্দ কুটুম, সজল দাশ, প্রকৌশলী নয়ন, সিনথি, ডা. প্রান্তি, ফারিয়া, শিউলি মণ্ডল, রাকা, সুমাইয়া ঝরা, ডা. শুভ্রদেব হালদার, বিপ্লব, ডা. সৈকত, রাজীব, অমিতসহ অসংখ্য তরুণদের কথা।

এদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমাদের তরুণেরা যখন হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটায় বা জঙ্গিবাদের উদ্দেশে 'হিজরত'-এ যুক্ত হচ্ছে বা জঙ্গিবাদে যুক্ত হবে দেখে বাড়ি ছাড়ছে তখন আমি ভাবি, চাইলেই তরুণদের এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। শুধু সদিচ্ছা প্রয়োজন। সেই সদিচ্ছা কি আমাদের আছে? রাষ্ট্রের আছে?

আমার এখনো মনে আছে, হলি আর্টিজানের ঘটনার পর সেই পাঁচ তরুণ জঙ্গির লাশ তাদের পরিবার গ্রহণ করতে চায়নি। আবার এই দৃশ্যও দেখেছি, বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন প্রোগ্রাম থেকে ফেরার পর অভিভাবকেরা গর্বিত হয়েছেন। এই অর্জন তাদের। এই অর্জন বাংলাদেশের। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। মুদ্রার দুই পিঠ দেখেও তরুণদের প্রতি মনযোগী হওয়া এখন সময়ের দাবি।

আমাদের তরুণদের ইতিহাস সমৃদ্ধ। তারা ভাষা আন্দোলন করেছে, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে হাজির হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য লড়েছে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বুক পেতে দিয়েছে, রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করেছে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাজপথে নেমেছে, করোনার সময় কারো কথা না শুনে মানুষ বাঁচানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে, সেই জায়গায় জঙ্গিবাদ কোনোভাবেই মানা যায় না।

সংকটে তরুণেরা ঝাঁপিয়ে পড়বে এইটাই সবার কাম্য। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে বাড়ি ছাড়বে এইটাই আশা। 'হিজরত'-এ যুক্ত হওয়া বা সিরিয়ায় আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য বাড়ি ছাড়া তরুণদের আমরা চাই না। এই দৃশ্য আমরা দেখতে চাই না। বিপথে যাওয়া তাদের ফিরিয়ে আনতেই হবে। আমরা একজন তরুণকেও বিপথে যেতে দিতে রাজি না। তাই সাংস্কৃতিক আন্দোলন জরুরি। শহর থেকে জেলা সব জায়গায় সাংস্কৃতিক চর্চা জরুরি। নাট্যচর্চা জরুরি। পথনাটক আন্দোলন জরুরি। পাঠাগার আন্দোলন জরুরি। সবচেয়ে বেশি জরুরি শিক্ষাব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক চর্চা বাধ্যতামূলক করা। তাতে শিশুমনে দেশপ্রেম জেগে উঠবে। জাগবে দেশের প্রতি মমত্ববোধ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আমিও বলতে চাই—

'উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,
ভয় নাই, ওরে ভয় নাই।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই, তা'র ক্ষয় নাই।'

বিনয় দত্ত: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Income inequality in Bangladesh

Growth obsession deepened rich-poor divide

Income inequality in Bangladesh has seen a steep rise over the past 12 years till 2022, according to official data, as economists blame a singular focus on growth rather than sorting out income disparities.

16h ago