‘ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর’

ছবি: সংগৃহীত

রাষ্ট্রীয় গুণগত সংস্কার ও প্রয়োজনীয় পুনর্গঠন কর্মযজ্ঞের মধ্যে এখন আমাদের অবস্থান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এই কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। যেসব মানুষ রাষ্ট্র ও সমাজে উপেক্ষিত ছিলো, আপন ঘরে আবদ্ধ ছিলো, ভীত-সন্ত্রস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলো দীর্ঘদিন, যারা বয়সে ছোটো বলে কখনো আলোচনায় আসেনি, তারাও এখন বেরিয়ে আসছে বা এসেছেন দেশগঠন ও মানবকল্যাণের ব্রত নিয়ে। আত্মাহুতি ও আত্মোৎসর্গের ব্রত নেয়া ছাত্র-জনতাকে আমরা বিস্ময়ের চোখে দেখলাম ও দেখছি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বুক পেতে দিতে। আবেগ আর প্রাণপ্রাচু্র্যে, সাহস আর ঔদ্ধত্যে তাদের যে গতি-প্রকৃতি, তা নির্দেশ করে তারুণ্যকে।

তারুণ্য হলো জরা-মৃত্যু-বার্ধক্য ও মায়াচ্ছন্নতার বিরুদ্ধ-শক্তি। অন্যায়ের প্রতিবাদ ও পুরনোকে আঁকড়ে ধরে বশ্যতা স্বীকারের বিরুদ্ধ-তেজই হচ্ছে তারুণ্য। শুদ্ধ প্রাণচাঞ্চল্য ও কর্মনিষ্ঠার গতিনির্দেশক হচ্ছে তারুণ্যের মূল ধর্ম। তারুণ্য সম্পর্কিত আমাদের যে জ্ঞান বা ধারণা, তার প্রায় সবটাই জুড়ে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম। যে-কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নজরুলের কবিতা ও গান হয়েছে সর্বাধিক উচ্চারিত।

'বল বীর—/ বল উন্নত মম শির!/ শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!', 'মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম/ মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল/ মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়/ মোরা প্রকৃতির মতো স্বচ্ছল', 'কারার ঐ লৌহ-কপাট/ ভেঙে ফেল্ কর্ রে লোপাট/ রক্ত-জমাট/ শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!', 'চল্ চল্ চল্!/ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,/ নিম্নে উতলা ধরণী-তল,/ অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ চল্ রে চল্ রে চল্।/ চল্ চল্ চল্।।', 'ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!' ইত্যাদি কবিতা-গান হয়েছে চলমান আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ও আন্তর্সংগীত।

নজরুল তারুণ্যের কবি। তারুণ্য প্রসঙ্গে ও তারুণ্যের স্বরূপ উন্মোচনে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ৫ ও ৬ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ নাট্যভবনে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতি-রূপে প্রদত্ত 'তরুণের সাধনা' শীর্ষক অভিভাষণে নজরুল স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন : ক. "তরুণ অরুণের মতোই, যে তারুণ্য তিমিরবিদারী সে যে আলোর দেবতা। রঙের খেলা খেলিতে খেলিতে তাহার উদয়, রঙ ছড়াইতে ছড়াইতে তাহার অস্ত।

যৌবনসূর্য যথায় অস্তমিত, দুঃখের তিমিরকুন্তলা নিশীথিনীর সেই তো লীলাভূমি।" খ. "আমাদের দলে কেহ দলপতি নাই; আজ আমরা শত দিক হইতে শত শত তরুণ মিলিয়া তারুণ্যের শতদল ফুটাইয়া তুলিয়াছি। আমরা সকলে মিলিয়া এক সিদ্ধি এক ধ্যানের মৃণাল ধরিয়া বিকশিত হইতে চাই।" গ. "তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার যাহার শক্তি অপরিমিত, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ়-মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অতল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে।"

নজরুল যে তারুণ্যের রূপ-প্রকৃতি তুলে ধরেছেন এবং যে তরুণের সাধনার কথা বলেছেন, সেখানে ক্লান্তি নেই। বার্ধক্য নেই। দেশ-কাল-জাতি-ধর্মের সীমারেখা নেই। চাকুরির মোহ, পদবির নেশা, টাইটেল বা টাই ও টেলের মায়া নেই। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। সেই তারুণ্যে রয়েছে 'আমাদের এই চিরবন্দিনী মাতা-ভগ্নিদের উদ্ধারসাধন' এবং এক লক্ষ্যে বহুমুখী পথ পাড়ি দেয়ার অনন্ত সৃজন-সাধনা। 

তারুণ্যের গতিপথ নির্ণয়ে নজরুলের শেষ কথা হলো: "আমরা যৌবনের পূজারী, নব-নব সম্ভাবনার অগ্রদূত, নব-নবীনের নিশানবরদার। আমরা বিশ্বের সর্বাগ্রে চলমান জাতির সহিত পা মিলাইয়া চলিব। ইহার প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইবে যে, বিরোধ আমাদের শুধু তাহার সাথেই। ঝঞ্ঝার নূপুর পরিয়া নৃত্যায়মান তুফানের মতো আমরা বহিয়া যাইব। যাহা থাকিবার তাহা থাকিবে, যাহা ভাঙিবার তাহা আমাদের চরণাঘাতে ভাঙিয়া পড়িবেই। দুর্যোগরাতের নীরন্ধ্র অন্ধকার ভেদ করিয়া বিচ্ছুরিত হউক আমাদের প্রাণ-প্রদীপ্তি। সকল বাধা-নিষেধের শিখরদেশে স্থাপিত আমাদের উদ্ধত বিজয়-পতাকা। প্রাণের প্রাচু্র্যে আমরা যেন সকল সঙ্কীর্ণতাকে পায়ে দলিয়া চলিয়া যাইতে পারি।"

এখন প্রশ্ন বা জিজ্ঞাস্য হলো, সত্যিই কি কোনো তরুণ বা তরুণের দল শেষ পর্যন্ত ঝঞ্ঝার নূপুর পরিয়া নৃত্যায়মান তুফানের মতো বয়ে যেতে পারে? তারুণ্যের উদ্ধত বিজয়-পতাকা একসময় কি মলিন-পুরাতন-বার্ধক্যে পতিত হয় না? তরুণরাও কি স্বার্থচিন্তা ও সংকীর্ণতায় বিপথগামী হয়ে পড়েন না? পরিস্কার উত্তর, তখন সেই জড় ও বিপথগামী তরুণ আর তরুণ থাকে না। তখন তার বিগত তারুণ্য আর তিমিরবিদারী আলোর দেবতা হয়ে ওঠে না। তখন তার পরিবর্তন বা স্থানান্তর অপরিহা‌র্য হয়ে দাঁড়ায়। তখন পুনরায় প্রয়োজন হয়ে পড়ে ভাঙাগড়ার। এবং এক্ষেত্রে তখনকার তরুণ ও তারুণ্যই পথ দেখায় নুতন কিছু করার। খুলে দেয় সম্ভাবনার নূতন দুয়ার।

বৃহত্তর অর্থে ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর সম্প্রতি এদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তারুণ্যের বিজয়-অভিযান সূচিত হয়েছে। শত শত প্রাণের বিনিময়ে আর লক্ষ লক্ষ তরুণের আত্মনিয়োগে আজ উদ্ধত হয়েছে নূতন এক বিজয়-পতাকা।

তারুণ্যের এই বিজয়-অভিযান ও বিজয়-পতাকা নিশ্চিত করতে আমাদেরকে যেমন নজরুলচেতনায় দ্বারস্থ হতে হয়েছে, তেমনি তা অক্ষয় ও সর্বজনীন করতেও আমাদেরকে নজরুলেই আশ্রয় নিয়ে হবে। দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অখণ্ড জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক নজরুলের যে জীবনদর্শন, তারই মন্ত্রবাণী ও সারবত্তা গ্রহণ করে তরুণদের চির-সুন্দর হয়ে উঠতে হবে। চিরবন্দিনী স্বদেশ-মাতা ও বিদেশ-ভগ্নিদের উদ্ধারসাধনে ব্রতী হতে হবে বারংবার।

৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী শ্রদ্ধাঞ্জলি, তরুণের সাধনাই হোক আমাদের সাধনা। জয়তু নজরুল। জয়তু তারুণ্য।

Comments

The Daily Star  | English

Trump brokered ceasefire agreement in contact with Israel, Iran: White House official

Meanwhile, fresh series of explosions were reported in the Iranian capital Tehran, as per AFP journalist

1d ago