সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা প্রশাসনের স্বার্থের সংঘাত

বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল এখন মুখোমুখি। বিরোধী দল পরবর্তী নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। অপর দিকে সরকারি দল কোনো অবস্থাতেই কেয়ারটেকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে।

অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, ২০২৩ সাল হবে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সময়। মাত্রই দেশ কোভিডের থাবা থেকে মুক্ত হয়েছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সামনেও এখন বিপদের হাতছানি। এমন সময় প্রয়োজন ছিল সবপক্ষের সহযোগিতা।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (প্রশাসন) সাবেক সদস্য হিসেবে নির্বাচন সংক্রান্ত কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, একটি ভোটকেন্দ্রে অনেক উপায়ে ভোট কারচুপি সম্ভব। তবে মূলত ভোট কারচুপি হয় রাজনৈতিক দলের মাস্তানদের দ্বারা ভোটকেন্দ্র দখল, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বা রিটার্নিং কর্মকর্তা পর্যায়ে ভোটের রেজাল্ট শিটে কারচুপি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় জাল ভোটের মাধ্যমে। প্রশাসন এসব কাজে সহায়তা করে, অথবা না দেখার ভান করে।

যখন কোনো মানুষের ব্যক্তি স্বার্থ তার বিচার, সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপকে প্রভাবিত করে, তখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাকে 'স্বার্থের সংঘাত' বলে। ন্যায় ও সুবিচারের স্বার্থে একজন কর্মকর্তাকে কোনো দায়িত্ব দেওয়ার আগে এ বিষয়টি বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।

নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনকারী মাঠ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার। এই ২ পদে বর্তমানে এতটাই রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে যে, নিয়োজিত কর্মকর্তারা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকলে যেকোনো বিবেচনায় তা হবে স্বার্থের সংঘাত ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম প্রধান অন্তরায়।

নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যকলাপ মোটামুটি ২ ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি নির্বাচন ব্যবস্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে ভোটগ্রহণ ও তদারকি, ভোট গণনা ও এতদসংক্রান্ত লজিস্টিকস। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সার্বিক তত্বাবধানে মাঠ প্রশাসন এই দায়িত্ব পালন করে থাকে। দ্বিতীয়টি ভোটকেন্দ্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা। জেলা পর্যায়ে এই দায়িত্বে থাকেন জেলা প্রশাসক ও জেলার পুলিশ সুপার। নির্বাচনের সময় তাত্ত্বিকভাবে তারা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, চাকরিচ্যুতি— সবই যেহেতু নিয়ন্ত্রণ করে সরকার, তাই সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের পক্ষে শুধু কঠিনই নয়, অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব।

নির্বাচন কমিশন এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিজেদের কর্মকর্তা নিয়োগের কথা ভাবছে। এটিও সঠিক সমাধান নয়। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাও সেক্ষেত্রে পক্ষ অবলম্বন করবেন, কারণ তাদের বেতনও দেওয়া হয় সরকারি কোষাগার থেকে এবং তারাও নিয়ন্ত্রিত হন সচিবালয় থেকে।

নির্বাচন কমিশনারদের পদটি উচ্চ বেতন, সামাজিক মর্যাদা ও বিভিন্ন সুবিধা সম্বলিত ৫ বৎসর মেয়াদের অতি লোভনীয় একটি পদ। এই পদে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত যেকোনো উপায়ে টিকে থাকার লোভ একজন মানুষের উদ্রেক হতেই পারে। এই স্বার্থের সংঘাত সমাধানে পদটি রিটার্নিং কর্মকর্তা পদের অনুরূপ অত্যন্ত স্বল্প মেয়াদের জন্য হতে পারে। নির্বাচনকালীন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা, ভোটগ্রহণ, ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণার সার্বিক দায়িত্বের জন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন, ঠিক ততটুকু সময়ের জন্যই নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে হবে। স্বল্প সম্মানী অথবা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবকভিত্তিতে, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই এমন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে পদটিতে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

নির্বাচনের পর এতদসংক্রান্ত নালিশ, মামলা বা আপিল ইত্যাদি নিষ্পত্তির জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্য থেকে 'যখন প্রয়োজন তখন' ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে বাছাই করা হলে, তারাও স্বার্থের সংঘাত থেকে মুক্ত থাকবেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা বর্তমানে যেভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন, সেই একই পদ্ধতি চালু থাকতে পারে। তবে, তাদের নিজস্ব কর্মস্থল এলাকায় নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত করা যাবে না।

আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর ওপর ন্যস্ত। এই বাহিনীর সব স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা পোশাকে থাকা অন্য যেকোনো বাহিনীর চেয়ে বেশি। পুলিশের জায়গায় সামরিক বাহিনী ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের সদস্যদের ভোটকেন্দ্রে মোতায়েন করা যেতে পারে। একটি ইউনিটের নেতৃত্বে থাকতে পারেন সামরিক বাহিনীর জুনিয়ার কর্মকর্তা। কয়েকটি ইউনিটের সমন্বয়ের জন্য প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় একজন করে মেজর বা সমপদমর্যাদার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সহজীকরণ এবং কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অধিক মাত্রায় নিয়োগের জন্য পুরো বাংলাদেশের নির্বাচন একইদিনে অনুষ্ঠিত না হয়ে ভাগ ভাগ করে কয়েক দিনে হতে পারে। প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রে ব্যাটারিচালিত ভ্রাম্যমাণ সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা উচিত, যাতে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা কন্ট্রোল রুম থেকে তার অধীনের কেন্দ্রগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

পরিশেষে বলা দরকার, নির্বাচনের মূল সমস্যাটি সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও তার বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন: প্রশাসন, বিচার ও আইন প্রণয়ন বিভাগের ঔপনিবেশিক আমলের রীতিনীতি জড়িত। ব্রিটিশদের প্রস্থানের পর এর আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, কিন্তু ৭৫ বৎসর পরও তার বাস্তবায়ন হয়নি।

ঔপনিবেশিক শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল জনগণকে তার অধিকার সম্পর্কে অসচেতন রেখে শোষণ করা। পরবর্তী নেতৃত্ব, যা পূর্বের জমিদার শ্রেণি থেকেই মূলত উদ্ভূত, সেই একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। মওলানা ভাসানী বিষয়টি এভাবে ব্যক্ত করেছেন, 'রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শাসন যন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে উদাসীন রাখা গেলে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ অব্যাহত রাখা সহজ হয়। কারণ কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি যদি পারিপার্শ্বিক বঞ্চনা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে তবে সম্রাজ্যবাদী শোষণ ও দেশীয় তল্পিবাহকদের শাসন ধূলিসাৎ হতে বাধ্য। আমাদের আজিকার দুর্বিষহ অবস্থার মূল এখানেই।' ভোট কারচুপি রোধের প্রধান হাতিয়ার হলো জনগণের সচেতনতা ও প্রতিরোধ। যতদিন তা না ঘটছে, ততদিন অন্য কোনো উপায় আছে কি না, তা অনুসন্ধান করা একান্ত প্রয়োজন।

সাইফুর রহমান: জ্যেষ্ঠ তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সার্টিফাইড প্রফেশনাল অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Polythene ban: A litmus test for will and eco-innovation

Although Bangladesh became the first country in the world to announce a complete ban on the use of polythene bags in 2002, strict enforcement of the much-lauded initiative has only started taking shape recently.

14h ago