রহিমা বেগমের ঘটনা কি সব গুম ও নিখোঁজকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে

মাঝে মধ্যেই নিখোঁজ বা গুমের অভিযোগ ওঠে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধেও। বিশেষ করে সরকার রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক মনে করে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের এমন নেতাকর্মী কিংবা বড় কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে কিন্তু তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা ও প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় তার শাস্তি নিশ্চিত করা জটিল বা অসম্ভব অথবা যার কাছে অনেক গোপন তথ্য থাকতে পারে যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি— এমন অনেককে রাষ্ট্রীয় বাহিনী তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুচলেকা নিয়ে; কথা না বলার শর্তে; কথা বললে তার পরিবার-পরিজনের জীবন বিপন্ন হবে, এমন ভয় দেখিয়ে সাধারণত তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। যে কারণে দেখা যায়, দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পরে যারা ফিরে আসেন বা যাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তারা চুপ থাকেন। এ বিষয় নিয়ে খুব বেশি কথা বলেন না। সম্ভব হলে পুরোপুরি আড়ালে চলে যান। অনেককে হয়তো ধরে নেওয়ার কিছুদিন পরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। অনেককে দীর্ঘদিন গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়। অনেককে হত্যার পরে লাশ গুম করে ফেলা হয়।

এসব ঘটনা বা অভিযোগ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই হয়। তবে রাষ্ট্র কখনোই নাগরিকদের এভাবে ধরে নিয়ে গুম বা নিখোঁজ করে ফেলা অথবা কাউকে গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখার কথা স্বীকার করে না। বরং যাদের সন্ধানে তাদের পরিবার দিনের পর দিন এখানে-ওখানে ধর্ণা দেয় বা যাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না, তাদের অনেকেই গ্রেপ্তারের ভয়ে অথবা ব্যক্তিগত কারণে পালিয়ে আছেন বলে সরকারের তরফে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অপরাধ, বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে গুম নিয়েও নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করে। প্রতি বছর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতো দেশীয় সংগঠনগুলো যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানেও বাংলাদেশের গুম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ নাকচ করে এবং তাদের দাবি, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কাউকে ধরে নিয়ে গোপনে আটকে রাখে না।

এমন বাস্তবতায় সামনে এলো রহিমা বেগম নামে খুলনার একজন নারীর ঘটনা।

শুরুতে রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নান দাবি করেছিলেন, তার মা নিখোঁজ। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এই ঘটনাকে অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনার মতো 'গুম' বলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দিকে আঙুল তুলেছিলেন। মরিয়ম মান্নান যেহেতু একসময় সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এবং তখনও তিনি নানা জায়গা থেকে হুমকি-ধমকি পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে, ফলে ওইসব ঘটনার রেশে তার মাকে গুম করা হয়ে থাকতে পারে— এমন কথাও অনেকে বলেছেন।

কিন্তু দেখা গেলো, কথিত 'গুম' হওয়ার ২৯ দিন পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার মাকে আটক করেছে। পুলিশ বলছে, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন। অবশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, রহিমা বেগম দাবি করেছেন, ২৭ আগস্ট রাতে নিজ বাসা থেকে পানি নিতে নেমে অপহৃত হন তিনি। ৪ জন তাকে জাপটে ধরার পর নাকে রুমাল ধরলে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তার কিছু মনে নেই।

ফলে প্রশ্ন উঠেছে, রহিমা বেগমের এই ঘটনাটি কি গুম ও নিখোঁজ নিয়ে এ পর্যন্ত যত অভিযোগ উঠেছিল এবং এখনও সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের যেসব মানুষ নিখোঁজ আছেন বলে তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে এবং প্রতি বছর গুম প্রতিরোধ দিবসে যেসব মানুষ তাদের স্বজনদের সন্ধান দাবিতে রাস্তায় নামেন, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন, তাদের ঘটনাগুলো কি দুর্বল হয়ে গেলো? এক রহিমা বেগমের ঘটনা কি সব গুম ও নিখোঁজের ঘটনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো?

স্মরণ করা যেতে পারে, মা নিখোঁজ হওয়ার পরে মরিয়ম মান্নানের কান্না ও আজাহারির বেশ কিছু ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ময়মনসিংহে একজন নারীর মরদেহ উদ্ধার হলে মরিয়ম মান্নান তাকে নিজের মা বলে দাবি করে মরদেহ নিয়ে যেতে চান। কিন্তু পুলিশ পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার আগে মরদেহ হস্তান্তরে সম্মত হয়নি।

এরইমধ্যে রহিমা বেগমকে জীবিত উদ্ধার করে পুলিশ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ময়মনসিংহে যে নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হলো, তিনি কে? রহিমা বেগম কিংবা মরিয়ম মান্নান ইস্যুতে এই মৃত্যু বা হত্যার ঘটনাটি কি চাপা পড়ে যাবে? তিনিও নিশ্চয়ই কারো মা, কারো স্ত্রী, কারো সন্তান। তিনি কি খুন হয়েছেন? যদি তা-ই হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া এবং তার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করছে?

আসা যাক মরিয়ম মান্নান প্রসঙ্গে।

মরিয়ম মান্নানের মা নিখোঁজ হওয়ার পরে তিনি দাবি করেননি যে আইনশৃঙ্খলা বা গোয়েন্দা বাহিনী তার মাকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে অনেকেই অভিযোগের আঙুল তুলছিলেন আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর দিকে। তারা এটিকে রাজনৈতিক রঙও দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে এটা খুব অস্বাভাবিক কোনো ঘটনাও নয়। কারণ যখন অসংখ্য মানুষ দাবি করেন যে তাদের স্বজনদের সাদা পোশাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না; মানে গুম করা হয়েছে, তখন কোনো নাগরিক নিখোঁজ হয়ে গেলে এই সন্দেহ অমূলক নয়।

সুতরাং যতজন মানুষ গুম বা নিখোঁজ, তাদের মধ্যে বিরাট অংশই যে রাজনৈতিক কারণে ভুক্তোভোগী হয়েছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণের কোনো কারণ নেই। আবার এটাও ঠিক, এই নিখোঁজদের অনেকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও ব্যবসায়ীক কারণে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে আছেন। অনেকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে হয়তো দেশ ছেড়েও চলে গেছেন। কিন্তু তারপরও অনেককে সাদা পোশাকে ধরে নিয়ে গুম বা নিখোঁজ করার অভিযোগ, গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখার অভিযোগ— এই নির্মম সত্যটি কি অস্বীকার করা যাবে?

২০২০ সালে নিখোঁজ হয়েছিলেন ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। প্রায় ২ মাস পর তার সন্ধান পাওয়া যায়। সেটিও বেশ নাটকীয়। কিন্তু ফিরে আসার পরে তিনি এ বিষয়ে খুব বেশি কথা বলেননি। তার আগে আরও যারা নিখোঁজের পর ফিরে এসেছেন, তারা চুপ থেকেছেন।

২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মুবাশ্বার হাসান ও সাংবাদিক উৎপল দাসও নিখোঁজের পরে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু কারা তাদের নিয়ে গিয়েছিল, কেন নিয়েছিল এবং কেনই বা ফিরিয়ে দিলো, সেই প্রশ্নের উত্তর জানা যায়নি। এমনকি, তাদের পরিবারও এই প্রশ্ন করতে চায়নি।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা কিংবা পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিকও নিখোঁজের পরে ফিরে এসে এ নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে কোনো কথা বলেননি। তারা কোনো আইনি ব্যবস্থাও নেননি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী নূর খানের ভাষ্য, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই এই ৭ মাসে ২টি গুম বা নিখোঁজের ঘটনা তাদের নজরে এসেছে। যদিও গত ১৫ বছরে ৬১৪ জন নিখোঁজের তথ্য আছে তাদের কাছে। যাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ৭৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৯৪ জনকে, ফেরত এসেছেন ৫৭ জন। বাকিদের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি (ডয়েচেভেলে, ৩০ আগস্ট ২০২২)

সুতরাং যে রহিমা বেগম বা মরিয়ম মান্নানকে নিয়ে এত ঘটনা, সেখানেই আসলেই কী ঘটেছে, তা এখন পরিস্কার নয়। রহিমা বেগম দাবি করছেন, তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন। তার মানে এখনও সত্যিটা জানা যায়নি। এই সত্যিটা জানা দরকার এবং কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনাপ্রবাহ; সেখানে মরিয়ম মান্নান ও তার মায়ের কী দায়— সেটিও জানতে হবে।

তবে রহিমা বেগম যদি সত্যিই স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে গিয়ে থাকেন এবং তার পেছনে যদি উদ্দেশ্য থাকে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো, তারপরও কি গুম নিয়ে নাগরিকদের মনে যে প্রশ্ন ও উদ্বেগ, সেটি কর্পুরের মতো উবে যাবে? আবার গুম ইস্যুতে সরকারবিরোধী বিভিন্ন পক্ষ যেভাবে ঢালাও অভিযোগ করে এবং দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেগুলোও কতটা তথ্যনির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠ, তাও বিবেচনায় রাখা দরকার। অর্থাৎ এইসব প্রতিবেদনকেও চ্যালেঞ্জ করা দরকার, যে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে সঠিক তথ্যটি বেরিয়ে আসবে।

সর্বোপরি একটি গুমহীন মানবিক ও সহনশীল রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে লড়াই—সেটি অব্যাহত রাখাই প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের কর্তব্য।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

5h ago