স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা করতে হলে…
রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির বিধান রেখে সংসদে 'জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন' পাস হয়েছে। খবরটি আনন্দের। তবে কিছু শঙ্কাও রয়েছে।
আনন্দের খবর এই কারণে যে, এই আইনের আলোকে হয়তো এবার ভুয়া বা অমুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিতর্কমুক্ত তালিকা করা সম্ভব হবে— যা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সম্ভব হয়নি। দেশের সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয়তো রাষ্ট্রীয়ভাবে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে।
শঙ্কার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখা যাক আইন কী বলছে?
গত ২৯ আগস্ট জাতীয় সংসদে যে বিলটি পাস হয়, তাতে বলা হয়েছে, '১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাহারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থাকিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করিয়াছেন বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিরীহ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করিয়াছেন অথবা একক বা যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তক্রমে প্রত্যক্ষভাবে, সক্রিয়ভাবে বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করিয়াছেন, তাহাদের তালিকা প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিবে।'
প্রশ্ন হলো, পরোক্ষভাবে কারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, সেটি প্রমাণের উপায় কী? যারা সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা করেছেন, হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে, তাদের তালিকা প্রণয়ন যত সহজ— যারা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করা তত সহজ নয়। এই কাজটি নির্মোহভাবে করা খুব কঠিন।
বিলের ওপর আলোচনায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেছেন, 'স্বাধীনতার ৫০ বছরেও একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করা যায়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি তারাও এখন মুক্তিযোদ্ধা। পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, ২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার বয়স ৫০ বছর।'
অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম হয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখা দেয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হলেও তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ওঠায় শেষ পর্যন্ত সরকার সেটি স্থগিত করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ওই তালিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে তালিকাটি সরিয়ে ফেলা হয়। সুতরাং সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেজন্য সদ্য পাস হওয়া আইনে কোনো ব্যবস্থা আছে কি না— সেটিই বড় প্রশ্ন। অতএব আইনের আলোকে যে বিধিমালা হবে, সেখানে বিষয়গুলো পরিষ্কার থাকতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা নিয়ে নতুন ধরনের সংকট তৈরি হবে। সেই সংকট যতটা না রাজনৈতিক, তারচেয়ে অনেক বেশি সামাজিক।
ধরা যাক, ১৯৭১ সালে পরিস্থিতির চাপে কেউ রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। কেউ হয়তো তার পরিবার ও এলাকাবাসীকে বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সখ্যতা রেখেছেন যাতে একধরনের ক্যামোফ্লাজ তৈরি করা যায়।
প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, সাংবাদিক ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ, যাকে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও 'লিডার' বলে সম্বোধন করতেন, তিনি তার বহুল পঠিত 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' বইতে (পৃষ্ঠা ৫৭৭) লিখেছেন, 'শুধু ছোট বড় অফিসাররাই না, পাক-সরকার নিয়োজিত শান্তি কমিটি, রেযাকার ও বদর বাহিনীর বহু লোকও তলে তলে মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করিয়াছেন। বস্তুত নিজেদের স্বরূপ ঢাকিবার মতলবেই এঁদের বেশির ভাগ শান্তি কমিটি রেযাকার ও বদর বাহিনীতে নাম লেখাইয়াছেন। এমনকি পাক বাহিনীর দেওয়া অস্ত্র দিয়াই এঁদের অনেকে পাক সৈন্যকে গুলি করিয়াছেন।'
সুতরাং কাউকে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আগে তার ব্যাপারে নির্মোহ ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান জরুরি যে, তিনি কোন পরিস্থিতিতে ওইসব বাহিনীতে যুক্ত হয়েছিলেন এবং আসলেই তার কর্মকাণ্ড কী ছিল? কে তার পরিবার বা কমিউনিটির মানুষকে বাঁচানোর স্বার্থে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছেন, আর কে সত্যিই বাংলাদেশের বিরোধিতা করা তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছেন, তা প্রমাণ হবে কীভাবে? এটি প্রমাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে, যারা সক্রিয়ভাবে খুন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে এরকম সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই, কিন্তু স্থানীয়ভাবে রাজাকার, আল বদর বা শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে পরিচিত—তাদের নামও রাষ্ট্রীয় এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না?
মনে রাখা দরকার, জাতীয়ভাবে প্রণীত এই তালিকায় কারো নাম উঠে গেলে, তিনি জীবিত থাকুন বা না থাকুন, তার পরিবার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপে পড়বে। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ওই তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে— এমন দাবি করে তিনি আদালতে যেতে পারবেন কি না বা আদালতে যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তার থাকবে কি না, সেটিও বড় প্রশ্ন। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধার সঠিক তালিকা করা যতটা না ঝুঁকির, তারচেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা করা।
অভিযোগ আছে, ২০১০-১২ সালে জেলায় জেলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ স্থানীয়ভাবে রাজাকারদের একটি তালিকা করেছিল— যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অনেকের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেক জায়গায় তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের বাণিজ্য হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
প্রশ্ন হলো, যে দেশে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাই অসম্পূর্ণ; ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা অনেক; ক্ষমতাবানরা রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতার বলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজেদের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন, আবার অনেকে সেই তালিকা থেকে বাদও পড়েছেন— সেই দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঠিক তালিকা কী করে হবে? কে করবেন? বরং সেই তালিকা করতে গিয়ে নতুন কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে কি না— সেটিই শঙ্কার।
প্রতিটি উদ্যোগ হতে হবে সতর্ক
এরকম একটি অতি স্পর্শকাতর বিষয়ে যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি উদ্যোগ হতে হবে সতর্ক, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, দলীয় প্রভাবমুক্ত এবং স্থানীয় রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশ ও মারপ্যাঁচে আগের মতো কোনো ভুল মানুষ তালিকায় যুক্ত না হয়ে যান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত করার যে ফলাফল ও পরিণাম, স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকায় একজন ভুল মানুষের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া বা অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া অনেক বেশি বিপজ্জনক। কারণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও কেউ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে তিনি ও তার পরিবার কিছু রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এতে তার সামাজিকভাবে সম্মানও বাড়বে। কিন্তু যিনি স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না; যার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো অভিযোগ নেই বা হয়তো যার সম্পৃক্ততা উল্লেখ করার মতোই নয়— এমন কারো নাম স্বাধীনতাবিরোধীদের জাতীয় তালিকায় যুক্ত হয়ে গেলে তিনি নিজে এবং তার গোটা পরিবারকে সারা জীবন সমাজে অসম্মানিত হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
সুতরাং, মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনের আলোকে প্রথমেই কাজ হবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। সেখানে যাতে কোনোভাবেই রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য না পায়। কেউ যাতে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধ ও টাকা-পয়সার প্রভাব খাটাতে না পারে— সে বিষয়ে তালিকা প্রণয়ন কমিটিকে সর্বোচ্চ সতর্ক, স্বচ্ছ ও সৎ থাকতে হবে।
তবে যার চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী; ১৯৭১ সালে যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাদের শাস্তি হয়েছে; যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ও দণ্ডপ্রাপ্ত— তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে জানতে পারে, এই দেশটি স্বাধীন করতে কারা জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন আর কারা এই যুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কাজটি যাতে কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়; পরবর্তী প্রজন্ম এসে যেন সেই তালিকাটি বাতিল করতে না পারে বা ওই তালিকা নিয়ে যাতে কোনো ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments