বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল: রক্ষক কি ‘ভক্ষকে’ পরিণত হচ্ছে

২০২২ সালের ২০ জুন একটি সংবাদ সম্মেলনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে ধন্যবাদ। যার মাধ্যমে আমরা একটি রূঢ় বাস্তবতার সম্মুখীন হই যে— প্রেস কাউন্সিল (সংশোধিত) আইনটি মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ প্রাথমিক বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘন, জনসম্প্রীতি বিনষ্ট ও অপসাংবাদিকতার দায়ে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধানটি বাতিল করেছে। খসড়ায় ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের দায়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের বাকি অংশের বিষয়ে শুধু গণমাধ্যমই নয়, প্রেস কাউন্সিল নিজেও কিছু জানে না।

২০২২ সালের ২০ জুন একটি সংবাদ সম্মেলনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে ধন্যবাদ। যার মাধ্যমে আমরা একটি রূঢ় বাস্তবতার সম্মুখীন হই যে— প্রেস কাউন্সিল (সংশোধিত) আইনটি মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ প্রাথমিক বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘন, জনসম্প্রীতি বিনষ্ট ও অপসাংবাদিকতার দায়ে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধানটি বাতিল করেছে। খসড়ায় ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের দায়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের বাকি অংশের বিষয়ে শুধু গণমাধ্যমই নয়, প্রেস কাউন্সিল নিজেও কিছু জানে না।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুসারে, মন্ত্রিপরিষদ জরিমানার পরিমাণ আইন থেকে বাদ দিয়ে কাউন্সিলের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত খসড়া আইনে কাউন্সিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে— যেখানে কোনো সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থার প্রকাশিত সংবাদ, সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ও কার্টুন প্রেস কাউন্সিলের আচরণবিধির বিরুদ্ধে গিয়ে দেশের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ করলে তারা নিজেরাই সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারবে। প্রিন্ট ও ডিজিটাল গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যেও আইনটি প্রযোজ্য হবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেছেন, 'শুধু প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এটি আবারও মন্ত্রিপরিষদে উত্থাপন করা হবে।'

আবারও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করতে আরও একটি আইন তৈরি হচ্ছে। আবারও সেখানে 'জনসম্প্রীতি বিনষ্ট' ও 'রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার' মতো অস্পষ্ট শব্দ রাখা হচ্ছে। ধারণা করা যায়, আইনটি নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করা হবে এবং শুধু সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ভিন্নমত দমনে যথেচ্ছা ব্যবহার হবে।

এ মুহূর্তে দেশে ৯টি আইন আছে, যেগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করতে পারে। তার মধ্যে ৩টি খসড়া পর্যায়ে আছে। চতুর্থটি হচ্ছে প্রেস কাউন্সিল আইন, যেটি অনুমোদন পাওয়ার পথে। সব মিলিয়ে মোট ১৩টি আইন আছে। এখানে দ্রুত পর্যবেক্ষণের জন্য এ ধরনের আইনের তালিকা দেওয়া হলো— ১. পেনাল কোড, ১৮৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি); ২. ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪); ৩. অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩; ৪. আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩; ৫. প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৩; ৬. প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; ৭. সংবাদপত্র কর্মচারী (পরিষেবার শর্ত) আইন, ১৯৭৪; ৮. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ৯. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮; ১০. ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন, ২০২১; ১১. ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্ট বেজড সার্ভিস প্রভাইডিং অ্যান্ড অপারেশন পলিসি, ২০২১ (আইসিটি বিভাগ দ্বারা); এবং ১২. (খসড়া) ম্যাস মিডিয়া কর্মচারী (পরিষেবার শর্তাবলি) আইন ২০২২।

যদি বলা হয়, আজকের বাংলাদেশে সন্ত্রাস, চোরাকারবার, অর্থ পাচার, খাদ্যে ভেজাল, নকল ওষুধ বিক্রির মতো অপরাধ দমনে যতগুলো আইন আছে, সাংবাদিকতা ও বাকস্বাধীনতা রোধে তার চেয়ে বেশি আইন আছে, তাহলে ভুল হবে না।

সত্য এই যে, সাংবাদিক প্রতিনিধিরাই প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। তারা একটি অর্ধ-বিচারিক সংস্থা চেয়েছিলেন, যেটি একইসঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি পেশাগত নৈতিকতা বজায় রাখার বাধ্যবাধকতাকে আরও কঠোর করবে এবং মানহীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে জনমানুষের ক্ষোভ দূর করবে। উদ্দেশ্য ছিল, একজন জ্যেষ্ঠ বিচারকের নেতৃত্বে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে, যার সাধারণ পর্ষদে থাকবেন এ পেশার সঙ্গে জড়িত সম্পাদক, সাংবাদিক, গণমাধ্যম কর্মীরা। এবং গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সংসদ সদস্যরা সুরক্ষা বলয় হিসেবে কাজ করবেন। সংবিধানের মূলনীতি রক্ষায় সেখানে স্পষ্টভাবে যৌক্তিক সীমাবদ্ধতা সাপেক্ষে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।

সাংবাদিকতার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য সাংবাদিক নেতারা যে উদ্যোগ ‍নিয়েছিলেন, সেটি আজ তাদের শাস্তি প্রদানের অস্ত্রে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান বিতর্কটি ২০০৫ সালে শুরু হওয়া এই প্রক্রিয়া নিয়ে নয়, বরং কীভাবে এই আইনের চূড়ান্ত খসড়াটি অনুমোদন পেলো এবং যেসব সাংবাদিক ও সম্পাদক আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন, আমলাতন্ত্রের রুদ্ধ দ্বারে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সবশেষ সংস্করণের সঙ্গে তারা তাল মিলিয়ে চলতে পেরেছিলেন কি না? এ ক্ষেত্রে যা হয়েছে, সাধারণত নতুন কোনো আইনের খসড়া তৈরির সময় এ ধরনের প্রক্রিয়াই অবলম্বন করা হয়; বিশেষত, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে এরকম আইনের ক্ষেত্রে। আলোচনায় অংশীজনদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, কিন্তু আইনের খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া থেকে তাদের বাইরে রাখা হয়। যেহেতু খসড়া কখনো দেখানো হয় না, তাই প্রস্তাবিত আইনে আলোচনার প্রতিফলন ঘটেছে কি না, সে বিষয়ে জানার কোনো উপায় থাকে না। প্রেস কাউন্সিলের দাবি, ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খসড়া আইনটি দেওয়া হয়েছে এবং এটি এখনো সেখানে রয়েছে। তবে, এই দাবির কোনো ভিত্তি নেই— তার কারণ এই কলামটি লেখার সময়ও আমরা সেটি খুঁজে পাইনি।

২০২২ সালের ২০ জুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে যে খসড়ার কথা উল্লেখ করেন, সেটি কখনোই অংশীজনদের দেখানো হয়নি, বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সাংবাদিক ইউনিয়নের কাউকে।

আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুতর ও উদ্বেগের বিষয়টি হলো— কাজটি করার জন্য প্রেস কাউন্সিল যে কঠিন গোপনীয়তা রক্ষা করেছে। সম্পাদক পরিষদ প্রেস কাউন্সিলের কাছে মন্ত্রিপরিষদে বিবেচিত খসড়াটির অনুলিপি চেয়েছিল। তাদের উত্তর ছিল, কাউন্সিলের পাঠানো খসড়া বেশ কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে এবং তাদের কাছে সবশেষ খসড়াটি নেই। যখন মূল খসড়া চাওয়া হলো, তখন তারা জানালেন, তাদের কাছে কোনো অনুলিপি নেই। আমাদের আমলাতন্ত্রের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে একটি ফাইল হারিয়ে ফেলা বা কোনো আইনের আনুষ্ঠানিক খসড়ার অনুলিপি খুঁজে না পাওয়া তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয় (প্রেস কাউন্সিল সচিবালয়ের প্রধান হলেন একজন অতিরিক্ত সচিবের সম পর্যায়ের কর্মকর্তা)।

তাহলে এত গোপনীয়তা কেনো? সাংবাদিক ও সম্পাদকদের মধ্যে যারা কাউন্সিলের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের বেশিরভাগকেই আমি এই প্রশ্নটি করেছি এবং তাদের কেউই মন্ত্রিপরিষদের কোনো এক বৈঠকে চূড়ান্ত হতে যাওয়া এই খসড়া আইনটি দেখেননি বলে জানিয়েছেন।

তাহলে, এই খসড়াটি কে বা কারা প্রণয়ন করলেন? চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, এটি আগের কমিটি তৈরি করেছে। বর্তমান কাউন্সিলের সদস্যরা এটি দেখেননি এবং এতে কী কী বিধান রয়েছে, সে ব্যাপারে তারা খুব বেশি জানেন না। এর আগে সম্ভবত কোনো না কোনো উপায়ে অংশীজনদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু তাদের কাউকেই কি মন্ত্রিপরিষদের বিবেচনায় থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ খসড়ার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানানো হয়নি? তাহলে কে বা কারা আসলে এই খসড়াটি তৈরি করলেন? আমাদের আশঙ্কা, তারা এ পেশার প্রতিনিধি নন, বরং আমলারাই এটি প্রণয়ন করেছেন— যারা কখনোই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার সুযোগ ছাড়েন না।

আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করছি, তারা অত্যন্ত বিনয় ও আন্তরিকতার সঙ্গে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, গণমাধ্যম সংগঠন ও সাংবাদিক ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া যেন এই খসড়াটি চূড়ান্ত করা না হয়। আমরা যদি আমাদের সংবিধানের প্রতি সম্মান রেখে, মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রয়োজন থেকে, বাকস্বাধীনতার প্রতি সম্মান জানিয়ে ও জনস্বার্থে প্রেস কাউন্সিল আইন তৈরি করি, তাহলে আমরা বিশ্বাস করি, প্রেস কাউন্সিলকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যেতে পারে। যা একইসঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়ার পাশাপাশি জনস্বার্থ রক্ষা করবে।

অতি দ্রুত প্রেস কাউন্সিল আইনের খসড়াটি প্রকাশের উদ্যোগ নিন।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments