আবুল মনসুর আহমদের আয়না ও তার প্রাসঙ্গিকতা
‘এতভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা’ বাঙলার লোকসাহিত্য নিয়ে এ উক্তি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের অধিকাংশ সাহিত্যে কম করে হলেও একটি চরিত্র থাকতো যার মাধ্যমে রঙ্গ-ব্যঙ্গাত্মক পরিবেশে আসর জমানো হতো। সে চরিত্র কখনো নিজে হাসতো আবার কখনো অন্যকে হাসাতো। এ ধারা রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন থেকে শুরু করে যাত্রা ও কবিগান পর্যন্ত দেখা যায়। সময়ের বাঁকবদলে ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত থেকে রবীন্দ্রনাথ,নজরুল এবং তাদের পরেও অনেক লেখকের মাধ্যমে রঙ্গ-ব্যঙ্গ পরিবেশিত হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও এ ধারার শক্তিমান লেখক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন অনেকে। এঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, প্রমথ চৌধুরী, পরশুরাম, শিবরাম চক্রবর্তী, পরিমল গোস্বামী, সৈয়দ মুজতবা আলী ও আবুল মনসুর আহমদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গোঁড়া মোহাম্মদী পরিবারের সন্তান ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। লাল তুর্কী টুপি মাথায় মোহাম্মদীর পক্ষে তর্কেও যেতেন। ঘটনাক্রমে একদিন তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের হেড মৌলভী আলী নেওয়াজ ও শিক্ষক মৌলভী শেখ আবদুল মজিদের সংস্পর্শে আসেন। এঁদের সাহচর্যে আবুল মনসুর প্রথম উদারতার পাঠ গ্রহণ করেন। তার এই উদারতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি। ১৯১৮-১৯ সাল থেকে তিনি কবর পূজা এবং পীর পূজাসহ হিন্দু-মুসলিম সমাজের সকল কুসংস্কারের সরাসরি বিরোধিতা শুরু করেন (আত্মকথা, পৃ ১৮০-৮১)। এ বিষয়টি ছাড়াও দেখি তিনি কলকাতা যাবার পর নতুন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হন। সেখানে বাল্যবন্ধু আবুল কালাম শামসুদ্দীনসহ ইয়াকুব আলী চৌধুরী, ডা. লুৎফুর রহমান, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে কাছে পান। এরা সকলেই বাংলাসাহিত্যের মুক্ত চিন্তার লেখক হিসেবে পরিচিত। সওগাতকে কেন্দ্র করে সকলের সাথে আবুল মনসুর আহমদ বু্দ্ধির মুক্তির পক্ষে লিখে চলেন। কিছুদিন পর মৌলভী মুজিবুর রহমানকে সভাপতি করে ‘লীগ এগেইনস্ট মোল্লাইজম’ গঠন করেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল, মোল্লাগিরি (১২তকবীর বনাম ৬ তকবির, জোরে বা আস্তে কথা বলা, তহরিম নিয়ে মারামারি, নামাজ না পড়েও কবর জেয়ারতসহ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি) খতম করা। কারণ, মুসলমানদের কিছু বাড়াবাড়ি লেখককে ব্যথিত করেছিল। আর সহনশীলতাকে এ বিষয়ের প্রতিকার হিসেবে ভাবছেন। সহনশীলতা ছাড়া সমাজ জীবনে শান্তি অসম্ভব।
এই সময়ে আবুল মনসুর আহমদ ৭টি গল্প নিয়ে প্রথম বই প্রকাশ করেন ‘আয়না’ শিরোনামে। উদারতার কারণেই ‘আয়না’য় অন্তর্ভুক্ত ‘মুজাহেদীন’, ‘নায়েবে নবী’ ও ‘হুজুর কেবলা’র মতো শ্রেষ্ঠগল্পতে বাস্তব ছবি ফুটে উঠে। ‘গো দেওতা কা দেশ’,‘লীডরে কওম’,‘বিদ্রোহী সংঘ’ ও ‘ধর্মরাজ্য’এই চারটি গল্পও অত্যন্ত উন্নত শিল্পমানের। গল্পগুলো ১৯২২-২৯ সালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় সওগাত পত্রিকায়। বই হিসেবে পাঠকের কাছে আসে ১৯৩৫ সালে।
২০১৮ সালে আয়না প্রকাশের ৯০ বছরের ঘরে এসেও তার আবেদন বিন্দুমাত্র ফুরায়নি, বরং বেড়েই চলছে। প্রথম গ্রন্থ দিয়েই আবুল মনসুর আহমদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গস্রষ্টা হিসেবে খ্যাতি পান। ‘আয়না’ ছাড়াও রয়েছে তার তিনটি ব্যঙ্গরচনা ‘ফুডকনফারেন্স’, আসমানি পর্দা ও‘গালিভরের সফরনামা’। প্রতিটি গ্রন্থে অতুলনীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সমাজসচেতন আবুল মনসুর আহমেদ।
‘আয়না’র প্রথম গল্প ‘হুযুর কেবলা’, গল্পে এমদাদ নামের এক কলেজ ছাত্র কথিত হুজুরের খপ্পরে পড়েন। সে পীর সাহেবের সান্নিধ্যে গিয়ে কিভাবে নিজের অস্তিত্ব হারায় অর্থাৎ হুজুর তার মুরিদের স্ত্রীকে তালাকের মাধ্যমে বিবাহ করে এবং তার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পীরের মুরিদদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়, সেই বিষয়টি উন্মোচিত হয়। ‘হুযুর কেবলা’ ধর্ম ব্যবসায়ীদের লোভ ও লালসা চরিতার্থ করার বাস্তব ঘটনা, যা অশিক্ষা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন দরিদ্র বাঙালি মুসলমান সমাজের বাস্তব দলিল। আবুল মনসুর আহমদ ধর্মের নামে ভণ্ডামীর এক অসাধারণ চিত্র নিপুণতা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে চিত্রিত করে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। এই মিথ্যাচার, ভণ্ডামী থেকে মুক্ত হয়নি সমাজ। তাই তো পরবর্তীতে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহকে লিখতে হয়েছে ‘লালসালু’। ‘হুজুরে কেবলা’-র এমদাদের মতোই দেখা যায় ‘লালসালু’র মজিদের দশা।
‘নায়েবে-নবী’ গল্পে দেখা যায়, গ্রামের সরদার মৌলভী সুধারানী সাহেব এবং প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলভী গরিবুল্লার প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব- সংঘাতের চিত্র। সেই সঙ্গে স্কুলের ছাত্রদের তুর্কি টুপি পোড়ানোর ঘটনা, মৌলবির ইতিহাস জ্ঞানের অভাব, একজনের মৃত্যুতে কিভাবে জানাজা পড়া হবে তা নিয়ে দুই মৌলভীর বাহাস, জুতা পেটাপেটি, ইমামতি নিয়ে কাড়াকাড়ি, ধাক্কাধাক্কি, পরে মাতব্বরের মধ্যস্থতায় জানাজা। গল্পটি রঙ্গরসপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও গ্রাম বাংলার এক আর্থ-সামাজিক বাস্তবতারই আলেখ্য।
‘লীডারে-কওম’ বর্ণিত হয় একাধারে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভণ্ডামির কাহিনী, আহলে-হাদীস ও হানাফিদের বিবাদ, হানাফি-মোহাম্মদীর বাহাস। ওই সুযোগে ইসমাইল সাহেবের ‘আহলে-হাদিস-গুর্য’ নামক পত্রিকা প্রকাশ, হানাফি-নিন্দার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ইংরেজ নিন্দা ও ইসমাইল সাহেব কর্তৃক পত্রিকার মালিকানা গ্রহণ, মজহাবি-ঝগড়া বিবাদের নিন্দা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে ‘মুসলমান সম্প্রদায়ের তুলনা, এহ্তেকাফের সাহায্যে ‘মুসলিম বঙ্গের’ অদ্বিতীয় নেতা হযরত মওলানা সাহেবের ‘অঞ্জুমান-তবলিগুল-ইসলাম’ নামক আঞ্জুমান কায়েম, সর্বত্র শাখা স্থাপন, চাঁদা আদায়, বন্যায় রিলিফের জন্যে টাকা সংগ্রহ, খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ, আহলে হাদিস কনফারেন্স, স্বরাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, টাকা পয়সার হিসাবে গোলমাল তবলিগ, আঞ্জুমান ও খেলাফত নেতা মওলানার কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতায় উন্নতি, গ্রেফতার, কারাদণ্ড কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে তিন মাসের মধ্যে মুক্তি এবং স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্যে রাঁচি গমন। ‘লিডারে কওম’কে অবিভক্ত বাংলার একজন স্বনামধন্য মুসলমান নেতার ‘জীবনপঞ্জী’ বললে ভুল হবে না। আবুল মনসুর আহমদ ওই মওলানা সাহেবে সংবাদপত্রে চাকরি করেছেন সুতরাং তার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন, স্বাভাবিকভাবেই ‘লিডার কওম’-এর চরিত্র বুননে মুন্সিয়ানার পরিচয় মিলে।
‘মুজাহেদিন’ ধর্মীয় ভণ্ডামির কাহিনী, কিভাবে এক অঞ্চলের মধ্যে হানাফি ও মোহাম্মদী উভয় সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ বসবাসকে এক বহিরাগত মওলানা বাহাসের মাধ্যমে সাস্প্রদায়িক সংঘাতে পরিণত করে এবং উভয়পক্ষে সংঘর্ষ ও গ্রেপ্তার, পুলিশি তদন্ত, পরিণামে গ্রামের প্রায় সকলের জেল জরিমানা। আর ওদিকে উভয় সম্প্রদায়ের মওলানার বাহাস সভার বিবরণ সম্বলিত দুইটি পৃথক পুস্তিকায় উভয় পক্ষের জয় দাবি। ‘মুজাহেদিন’রা খেলাফত আন্দোলন আর পরবর্তী সময়ে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক ইংরেজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, দেশ ছেড়ে আফগানিস্তানে আর বাংলার মুসলমান সমাজে হানাফি-ওয়াহাবি, সংঘাত বাধিয়ে মুসলমানরা হয় সর্বস্বান্ত।
‘বিদ্রোহী’ ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী দলের কর্মী ও নেতার স্ববিরোধীতার স্যাটায়ার। ‘ধর্ম-রাজ্য’ হিন্দু ও মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ইংরেজের ভূমিকার আক্ষরিক চিত্র। দেখা যাচ্ছে ‘আয়না’ গ্রন্থে তিনি যেমন ধর্ম ব্যবসায়ী ফতোয়াবাজ মৌলবাদী ও স্বার্থপর, সুবিধাবাদী রাজনীতিক তেমন বাংলার দুই প্রধান সস্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সাম্প্রদায়িকতাকে সমান তীব্রতার সঙ্গে ব্যঙ্গ, পরিহাস, সমালোচনা করেছেন। ‘আয়না’ সমালোচনায় তাঁকে দুর্ধর্ষ বলতেই হবে। সেই সাথে আর একটি বিষয় আবুল মনসুর আহমদ তাঁর রচনায় বিষয় অনুযায়ী প্রচুর আরবি-ফারসি-ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করায় ভাষার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। রচনার ফর্ম শিল্পবোধকে করেছে তীক্ষ্ণ।
রচনাগুলি আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা হাসির সৃষ্টি করলেও লেখকের মর্মভেদী কান্না, কখনো স্পষ্ট, কখনও প্রচ্ছন্ন থেকে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তিনি হেসেছেন, হাসিয়েছেন, কিন্তু হৃদয় নিংড়ানো কান্নাও কেঁদেছেন প্রচুর। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার চরণের সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতির কিছুটা মিল তাঁর রচনায় দেখা যায়। ‘বাইরে রবে হাসির ছটা, ভিতরে থাকে অশ্রুজল’।
আয়না বইটি আগাগোড়াই অতি উচ্চমানের সুস্মিত রচনা। এতে লেখকের লেখনিশক্তি ও দূর দৃষ্টিতে কাহিনী নির্মাণে ফেঁদেছেন তাঁর নিজস্বে ঢঙে। সরল কথকের মুন্সিয়ানাসহ গুণাবলির সমাহার আয়না গ্রন্থটিতে।
সামাজিক বিত্তে নিম্নশ্রেণির এবং মানবিক বৃত্তিতে গরু, মহিষ, সিংহ ও শিয়াল প্রভৃতি অবলার মাধ্যমে লেখক কেবল মনুষ্য সমাজের লোভ, লালসা, অনাচার, অবিচার প্রতিকৃতি আঁকেননি, জীব জগতের অন্তরের আর্তির প্রতিধ্বনিও শুনিয়েছেন।
এক কথায় আবুল মনসুর আহমদের প্রতিভার আঁচড়ে দৈনন্দিনের যন্ত্রণা, গঞ্জনাই অথবা সাদামাটা ঘটনাপ্রবাহও লক্ষ্যভেদী রম্য হয়ে উঠতে পারে তা তাঁর রচনা না পড়লে বুঝা যাবে না।
অনায়াসেই বলা যায়- আবুল মনসুর আহমদ সমকাল, সমাজ, জনগণ ও রাজনীতি সচেতন গল্পকার। সমাজের অতি-নিকটে কথকের বসবাস। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় পায় হেঁটে চলায় নানা অণুঘটনা ভীড় করেছে তার অভিজ্ঞতার ডালিতে। আর খোলা চোখে দেখা ঘটনাপুঞ্জ ও চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে তাঁর সাহিত্য কর্মে, তার মধ্যে ‘আয়না’ গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য। ‘আয়নার ফ্রেম’ নামক ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন- “এমনি আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায়। কিন্তু আমার বন্ধু শিল্পী আবুল মনসুর যে আয়না তৈরি করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। যে সমস্ত মানুষ হরেক রকমের মুখোস পরে আমাদের সমাজে অবাধে বিচরণ করছে আবুল মনসুরের আয়নার ভেতরে তাদের স্বরূপ মূর্তি বণ্য মন্দিরে, মসিজিদে, বক্তৃতার মঞ্চে, পলিটিকসের আখড়ায়, সাহিত্য সমাজে বহুবার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।”
আবুল মনসুর আহমদ, বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ের অকুতোভয় এক যোদ্ধার নাম। এ নামটির সাথে প্রায় সকলেই পরিচিত। এই উপমহাদেশে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে আবুল মনসুর আহমদের নাম এবং স্বতন্ত্রতা নিয়ে বিরাজিত এই নাম এসেছে নানাভাবে আমাদের কাছে। কখনো রাজনীতির মঞ্চে, কখনো সংবাদপত্রে, কখনো সাহিত্যে-স্যাটায়ারিস্ট ও প্রবন্ধের চিন্তানায়ক হিসেবে, এমনকি আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিয় নাম। তাঁর জীবনের শুরুতে বাঙালি মুসলমানের চেতনায় উন্মেষযুগলকে দেখেছেন, যৌবনে উপমহাদেশের স্মরণীয় আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থেকেছেন, পূর্ণজীবনে সংবাদপত্রের সাথে নানা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সর্বোপরি একজন জীবনশিল্পীর চোখে চারপাশ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।
সম্ভবত অন্য সব পরিচিত ডিঙ্গিয়ে একমাত্র সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদই যেন সর্বোপরি অধিষ্ঠিত নাম, আজকের যেমন তেমনি অনাগত কালের জন্যেও। মননশীলতার বিচারে দেখলে আবুল মনসুর আহমদ নামের যে বটবৃক্ষ- সময়ের মধ্যে থেকে সব সহজযোগ নাগালে থাকা স্বত্তেও, সময়ের অনাচারের বিরুদ্ধে, অবিচল বটের মতো স্থির ছিলেন। সম্প্রদায়ের প্রতি; প্রত্যক্ষ ও উচ্চকিত হৃদ্যতা থাকা সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রসঙ্গে এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্যটি উল্লেখযোগ্য: ‘পরশুরাম হিন্দু দেবদেবী নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায় তা সহ্য করেছে। আবুল মনসুর আহমদের দুঃসাহস সেদিন সমাজ সহ্য করেছিল। আজ কোন সম্পাদক এমন গল্প ছাপতে সাহস করবে কিনা এবং সমাজ তা সহ্য করবে কিনা, সে-সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। আবুল মনসুরের আক্রমণের লক্ষ্য কোনো ব্যক্তি, ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়। তাঁর বিদ্রোহ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। ‘আয়না’ প্রকাশের এতকাল পরেও মনে হয়, এরকম একটি গ্রন্থের প্রয়োজন আজও সমাজে রয়ে গেছে।’
তাছাড়া আবুল মনসুরের ভাবনার ফর্ম আগাগোড়াই অতি উচ্চমানের সুস্মিত রচনা। তথ্য আর তত্ত্বে সাবলীল ভাষায় ব্যঙ্গকে সংখ্যায়িত করে বলেছেন হিউমার ছাড়া স্যাটায়ার হতে পারে না। সেই সাথে স্যাটায়ারে থাকবে বটে-ত্রুটি বিচ্যুতির গায় চিনি মাখানো চাবুক। অথচ এই সময়ে তা বিরল।
আবুল মনসুর আহমদ নিজেই বলেন: আমাদের বাংলা সাহিত্যেও ঊনিশ শতকের গোঁড়া থেকেই রসরচনা-প্রাচুর্য দেখা যায়। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবু বিলাস’ প্যারিচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতুম পেঁচার নকশা’ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ ও ‘লোকরহস্য’ মীর মশাররফ হোসেনের ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ রাজশেখর বসুর ‘গড্ডলিকা’ বাংলা গদ্যসাহিত্যে ব্যঙ্গ রচনার ক্রমাগত ধারা বজায় রেখেছে। এর পিছনে আমার ‘আয়না’ ও ‘ফুড কনফারেন্সের’ নামও বলতে পারেন।
কাজী নজরুল ইসলামের এ কথাটি প্রাসঙ্গিক: ‘বাঙলা ভাষায় ব্যঙ্গ-সাহিত্য খুব উন্নত হয়নি; তার করুণ, ব্যঙ্গ-সৃষ্টিতে অসাধারণ প্রতিভার প্রয়োজন। এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা-সুরও বেরুবে, তারও ছিঁড়বে না। আমি একবার এক ওস্তাদকে লাঠি দিয়ে সরোদ বাজাতে দেখেছিলাম। সেদিন সেই ওস্তাদের হাত সাফাই দেখে তাজ্জব হয়েছিলুম। আর আজ বন্ধু আবুল মনসুরে হাত সাফাই দেখে বিস্মিত হলুম। ভাষার কান মলে রস সৃষ্টির ক্ষমতা আবুল মনসুরের অসাধারণ। এ যেন পাকা ওস্তাদী হাত।’
সত্যি আবুল মনসুর আহমদ পাকা হতের পরিচয়ই দিয়েছেন তার রচনাতে। ‘আয়না’ তাঁর সমকালকে অতিক্রম করে আগামীকালেও দীক্ষা দিচ্ছে। সাহিত্য চিরকালীন সত্যের পটভূমিতে মানবিক দর্শনের বিশুদ্ধ ক্ষেত্র, শিল্পের জায়গা থেকে, যেমন তেমনি দর্শনের জায়গা থেকে সত্য। বিশ্বাস তা হারাবে না কোনদিন চোরাবালিতে।
সাধারণ পরিবার থেকে ওঠে এসে অস্তিত্ব রক্ষার নানা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে জীবনের প্রতিষ্ঠা, তাঁর পক্ষেই সূক্ষ্ম শিল্পসাধনা কতটা পরিশ্রমের! কিন্তু এই সংগ্রমের ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন না করে, বরং জাতিসত্ত্রা ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে দিয়ে যিনি তাকে সাহিত্য-নির্মাণের উপজীব্য করে তুলেছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই কৃতিত্বের দাবিদার। সেই অর্থে বাংলা সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমদ একজন কৃতী পুরুষ। ফলত এই সময়কালে তার রচনার প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম।
(৩ সেপ্টেম্বর আবুল মনসুর আহমদের ১২০তম জন্মদিন, তিনি ১৮৯৮ সালে ময়মনসিংহের ধানীখোলায় জন্মগ্রহণ করেন)
Comments