নৌকা আর ধানশালিকের দেশে

১৯৭০ এর দশকের বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের রেশ কাটতে না কাটতেই দেশটি মুখোমুখি হয় আরেকটি কালো অধ্যায়ের। এ দশকেরই মাঝামাঝিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশের শাসনভার চলে যায় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কাছে, যারা শাসন মানেই মনে করত শুধু দমিয়ে রাখা আর যাদের মূল লক্ষ্য ছিল বন্ধবন্ধু ও তাঁর চেতনাকে গলা টিপে হত্যা করা।
Shomi Kaiser
অভিনেত্রী শমী কায়সার। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭০ এর দশকের বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের রেশ কাটতে না কাটতেই দেশটি মুখোমুখি হয় আরেকটি কালো অধ্যায়ের। এ দশকেরই মাঝামাঝিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশের শাসনভার চলে যায় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কাছে, যারা শাসন মানেই মনে করত শুধু দমিয়ে রাখা আর যাদের মূল লক্ষ্য ছিল বন্ধবন্ধু ও তাঁর চেতনাকে গলা টিপে হত্যা করা।

এমনই এক সময়ে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হওয়া পত্রিকা ‘ধানশালিকের দেশে’-তে সাত বছর বয়সী মিষ্টি এক মেয়ের আঁকা একটি ছবি ছাপানো হয়। ছবিটির পটভূমি ছিল ছয়টি নৌকা, যার মধ্যে একটা নৌকা ছিল পালতোলা। ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর মেয়েটির খুশি আর ধরে না! কিন্তু এই খুশিতে বাধা দিতে হঠাৎ একদিন মেয়েটির বাসায় কয়েকজন সাফারি-পরা ওয়াকিটকি হাতে ভয়ালদর্শন লোক এসে উপস্থিত। লোকগুলো এসেই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করল, ‘নৌকার ছবি তুমি কেন এঁকেছো? কে আঁকতে বলেছে তোমায়?’ মেয়েটি ভয়ে আধমরা। সে বুঝেই পারে না নৌকা এঁকেছে বলে সে কী এমন অপরাধ করে ফেলল! তার মানে নৌকা আঁকা কি অন্যায়? কোনো মতে সে উত্তর দিলো, ‘কেউ আঁকতে বলেনি, এমনি এঁকেছি।’

তারা তো আর জানত না যে মেয়েটা যখন ছবি আঁকে তখন নদী, নীল আকাশ, নয়তো গ্রাম, এছাড়া আর কিছু আঁকতেই চায় না। এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর আওয়ামী লীগের নৌকার কোনো সম্পর্ক নেই। বাবুল ভাই এসে মেয়েটিকে ছবি আঁকা শিখিয়ে যান, আর সংগীতশিল্পী কলিম শরাফী এসে শেখান গান। মেয়েটির মায়ের ইচ্ছা সে যেন হয় চিত্রশিল্পী, নয়তো সংগীতশিল্পী হয়; শিল্পী তাকে হতেই হবে। তাদের বাসায় প্রায়ই কবিতার আসর বসে। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরও কত কবিরা আসেন এখানে! এই ছোট্ট মেয়েটির বাবা নেই। বাবা কোথায় জিজ্ঞেস করলে তাকে বলা হয় তিনি বিদেশে থাকেন। বড় হয়ে মেয়েটা জানতে পারে, আসলে তার বাবাকে ১৯৭১ সালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি।

১৯৮৯ সালে মেয়েটা তখন কলেজে পড়ে। প্রখ্যাত নাট্যপরিচালক আতিকুল হক চৌধুরী এক গানের আসরে কলেজপড়ুয়া মেয়েটিকে দেখে মেয়ের মাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এত মিষ্টি দেখতে মেয়েটা! ও কি অভিনয় করবে?’ তিনি তখন তাঁর এক নাটকের জন্য নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারে এমন মেয়ে খুঁজছেন। মেয়েটির দাদির বাড়ি ফেনীতে, সেই সূত্রে সে খানিকটা নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলতে শিখেছে। চৌধুরী সাহেব একের পর এক লাইন বলে যাচ্ছেন আর মেয়েটিকে বলছেন নোয়াখালীর ভাষায় সেগুলো বলতে। প্রত্যেকটি লাইন শোনার পরপরই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলেন তিনি।

ড. এনামুল হকের রচনায় ‘কে বা আপন কে বা পর’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সেই মিষ্টি মেয়েটির অভিনয়ে পদার্পণ। তারপর কতো যে নাটকে সে অভিনয় করেছে! ইমদাদুল হক মিলনের গল্প আর ফখরুল আবেদীনের পরিচালনায় নাটক ‘যত দূরে যাই’ দিয়ে মেয়েটির সত্যিকার অর্থে খ্যাতি অর্জন। বিটিভি অনেকদিন পর এ নাটকটা দিয়ে আবার রোম্যান্টিক কিছু প্রচার করে। ১৯৯০ সালে মেয়েটি থিয়েটারে যোগ দেয়। হুমায়ুন ফরীদির পরিচালনায় সে থিয়েটারে প্রথম অভিনয় করে, সেই অভিজ্ঞতা কি ভোলার মতো! বারো বছর কাজ করে যায় সে থিয়েটারে। এর মধ্যে তার মাস্টার্স পরীক্ষার সময় বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদ তাকে নিয়ে তৈরি করেন ‘নক্ষত্রের রাত’।

এতো সফলতার মাঝে আবার আসে সেই কালো ছায়া। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনার অনুসারী হওয়ার অপরাধে ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে মেয়েটিকে ‘ব্ল্যাকলিস্টেড’ করা হয়, অর্থাৎ সে আর অভিনয় করতে পারবে না। হঠাৎ এ খবরে মেয়েটি যেন আকাশ থেকে পড়ে, এখন কী করবে সে! কিন্তু সুশিক্ষা এবং বিচক্ষণতা যার মাঝে আছে, তাকে দমিয়ে রাখে কার সাধ্য! ২০০৪ সালে মেয়েটি ‘ধানসিঁড়ি কমিউনিকেশন্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে, যার লক্ষ্য হলো ডিজিটাল মার্কেটিং মিডিয়া এবং অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি হিসেবে কাজ করা। অভিনয়ের মতো এখানেও মেয়েটি তার সুনিপুণ ছোঁয়ায় আকাশচুম্বী সফলতার মুখ দেখে।

বাবাকে নিয়ে মেয়েটির কিছুই মনে পড়ে না, তার সবটুকুই জুড়ে রয়েছেন মা। কিন্তু তবুও প্রতিটি মুহূর্তে বাবাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নেয় মেয়েটি। প্রতি রাতেই বাবার একটি কবিতা পড়ে আর বাবাকে নিয়ে ভাবে। না থেকেও বাবা রয়ে গেছেন সবটুকু জুড়ে, মধ্যবয়সে পৌঁছানো ছোট্ট সেই মেয়েটি শহীদুল্লা কায়সারের সন্তান হিসেবে ভীষণ গর্ব অনুভব করে।

এতক্ষণে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কে সেই ছোটবেলায় নৌকার ছবি আঁকা অভিনেত্রী? তিনি আপনাদেরই প্রিয়মুখ শমী কায়সার। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যিনি অর্জন করেছেন খ্যাতির সোনালি মুকুট।

অনুলিখনে জোবায়ের আহমেদ

Comments

The Daily Star  | English

Army chief pledges support for Yunus' interim government 'come what may'

He vowed to support the interim government in completing reforms and holding elections within next 18 months

1h ago