আকাশটা আমার
নারী হিসেবে নিজেকে আলাদাভাবে দেখতে চাইনি কখনো। আমি মনে করি, আমি একজন মানুষ। আমার কাছে মনে হয়, নারী বলে যেন আমাকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। আমি চাই, আমি যেন আমাকে একজন মানুষ হিসেবেই দেখি। আমার কাছে নারী দিবসকে অতটা গুরুত্বপূর্ণ লাগে না। নারী দিবস যদি থাকে, তাহলে কেন পুরুষ দিবস নেই?- এটা আমার প্রশ্ন। তাই আমি নারী দিবস উদযাপন করি না। যদিও এই দিবসে কেউ আমাকে উইশ করেননি, কিন্তু কেউ তা করলে আমি তেমন পছন্দ করব না। আমার কথা হচ্ছে আমি একজন মানুষ। পুরুষ দিবস যদি থাকত, তাহলে নারী দিবসকে উদযাপন করতাম।
আমার কাছে মনে হয়, নারী দিবস থাকা উচিত না। আমি মনে করি, এর মাধ্যমে নারীদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কর্মস্থলে বৈষম্যের শিকার তো সবসময়ই হয়েছি। আমি একজন নারী-শুধু এই কারণেই আমি এমন বৈষম্যের শিকার হই। যেমন ধরুন, আমার এই পেশা-একজন পাইলটতো পাইলটই। কিন্তু এখানে আমাকে কেনো নারী পাইলট হিসেবে দেখা হবে? নারী হিসেবে যে সব বাধা-বিপত্তির মধ্যে পড়ি এর একটা উদাহরণ হলো, আমি নারী বলে সবাই আমাকে দুর্বল হিসেবে দেখেন। সবাই মনে করেন বাইডিফল্ট মেয়ে হিসেবে আমি উইক। যেমন ধরুন, যদি আমি ভালো ল্যান্ড করি, সেটার কোনো অ্যাপ্রিসিয়েশন পাই না। কিন্তু যেদিন ভালো ল্যান্ডিং হয় না, সেদিন আমি ল্যান্ড না করলেও যাত্রীরা মনে করেন আমিই এমন ল্যান্ডিং করেছি।
একটি কোরীয় সংস্থা থেকে আমার পাইলটের প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে প্রাইভেট এবং কমার্শিয়াল পাইলটের লাইসেন্স নিয়েছি। কিন্তু লাইসেন্স নেওয়ার পর চাকরি হচ্ছিল না বলে ভাবলাম, বেকার বসে না থেকে কিছু একটা করি। তখন আমি ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টরের প্রশিক্ষণ নিলাম। সেটাও আমি একই প্রতিষ্ঠান থেকে করেছি। এরপর আমি বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। সেটা ছিলো ২০১৫ সাল। এরপরের বছর একজন নারী পাইলট হিসেবে আমি ইউএস বাংলাতে ড্যাশ ৮কিউ ৪০০-এর ফার্স্ট অফিসার পোস্টে যোগ দেই। এখনো সেখানে সেই পোস্টেই আছি।
কেউ যদি প্রাইভেট পাইলটের লাইসেন্স নিতে চান, তাহলে তাকে সর্বনিম্ন এসএসসি অথবা ‘ও’ লেভেল পাস হতে হবে। বিষয় হিসেবে থাকতে হবে অঙ্ক এবং পদার্থবিজ্ঞান। কমার্শিয়াল পাইলটের জন্য প্রয়োজন সর্বনিম্ন এইচএসসি বা ‘এ’ লেভেল। এখানেও বিষয় হিসেবে অঙ্ক এবং পদার্থবিজ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে।
অধিকাংশ পাইলটই বলবেন, পাইলট হওয়া আমাদের ছোটবেলার ইচ্ছা। আমার ক্ষেত্রে তাই। তবে এটা একটু আলাদা। আসলে ছোটবেলা থেকে আমি অন্যদের থেকে একটু আলাদা কিছু হওয়ার চিন্তা করতাম। তবে ঠিক ভেবে পাচ্ছিলাম না কী হলে লোকে আমাকে একটু ব্যতিক্রম বলবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এগুলো কমন। এছাড়াও এসব পেশায় আমাদের পরিবারের অনেকেই আছেন। তাই আমি ব্যতিক্রমী কিছু খুঁজতাম। ২০০৭ সালে আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন প্রথম আলোয় ‘স্বপ্ননিয়ে’ বিভাগে পাইলটদের ওপর একটি ফিচার পড়ে আমি পাইলট হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। যিনি এই ফিচারটি লিখেছেন তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি সেই লেখাটা বাবাকে দেখালাম। সেখানে একজন নারী পাইলটের ছবি ছিলো। বাবাকে বললাম, “আমি পাইলট হতে চাই।” ওদিনই আমি সংকল্প করি আমি পাইলট হবো। বাবা বললেন, “না, ওই প্রফেশন তোমার সঙ্গে যাবে না। তুমি একজন ভীতু। তার ওপর, মেয়ে মানুষ। এটা তোমার সঙ্গে যাবে না।” আমি বললাম, “না, আমি যদি পাইলট হতে না পারি তাহলে আর কিছুই হবো না।” বাবা ভেবে ছিলেন, ছোট মানুষ যা-তা বলছে। আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি পাইলটই হবো। আমি লেখাটায় পড়লাম- অঙ্ক লাগবে, পদার্থবিজ্ঞান লাগবে। তারপর আমি সেগুলোর ওপর মন দিয়ে দিলাম। কেননা, আমাকে পাইলট হতেই হবে।
যাহোক, স্কুলে ‘এইম ইন লাইফ’-এর ওপর প্যারাগ্রাফে লিখতাম, “আই ওয়ান্ট টু বি অ্যা পাইলট”, তখন টিচাররা, বন্ধুরা হাসাহাসি করত। মনে করত ফাজলামি করতেছি। এইচএসসির পর আমাকে জোর করে মেডিক্যাল কোচিংয়ে ভর্তি করানো হলো। এরপর, মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষায় আমি ৬০ নম্বরের উত্তর দিয়ে হল থেকে বের হয়ে গেলাম। ইচ্ছা করে বাকি নম্বরের উত্তর দেই নাই। যদিও সেগুলো আমার জানা ছিলো। আমার ভয় ছিলো যদি মেডিক্যালে চান্স হয়ে যায়, তাহলে তো আর পাইলট হওয়া যাবে না। কিন্তু বাবার ইচ্ছা তার মেয়েকে ডাক্তারই হতে হবে।
কোনো ভার্সিটির ফরম ফিলআপ করি নাই। আমার একটাই জেদ, আমি পাইলট হবো। এরপর, আত্মীয়রা বাবাকে বোঝালেন, “ও যেহেতু পাইলট হতেই চাচ্ছে দেখোনা ও কী করে?” এরপর, বাবা ঢাকায় এসে খোঁজ-খবর নিলেন। সবাই বললেন, “বিষয়টা খুব কঠিন। সবাই সফল হয় না।” আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যত কঠিনই হোক আমি এটাই করব।
ঢাকায় এসে ভর্তি হওয়ার পর আরো অসংখ্য বাধার মুখে পড়তে হলো। মা-বাবাকে ছেড়ে একা থাকতে হয়েছে। কারো কাছে থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাচ্ছিলাম না। সবাই ভালো করছে, কিন্তু আমি পারছি না। এখন যতো সহজ করে বলছি বিষয়টা ততো সহজ ছিল না। বাবাকে মিথ্যা বলতাম, “হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। আমি পারব।” অথচ, বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। অনেক কষ্ট হতো। খুব ভয় হতো। আমি সত্যিই পারবো তো? ট্রেনিংয়ে আমি কিছুই পারতাম না। বারবার মনে হতো, হয়তো আমাকে দিয়ে এটা হবেনা। কিন্তু মনের ভেতর সেই জেদটা ছিলো, আমাকে পারতেই হবে। এমন ‘হচ্ছে না’ অবস্থার মধ্যে ফাইনাল পরীক্ষার দিন বাবাকে ফোন দিয়ে দোয়া করতে বললাম। বললাম, “তুমি চাচ্ছনা বলেই হয়তো আমি পারছিনা। আজ আমার ফাইনাল টেস্ট। তুমি দোয়া করলে আমি পারব।” বাবা মন খুলে দোয়া করলেন। তাই প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে প্রথম যেদিন দুই সিটের একটি চেসনা ১৫২ ক্রাফট নিয়ে আকাশে একা উড়াল দিলাম, দেখলাম ক্রাফটা হালকা লাগছে। কোনো ইনস্ট্রাক্টর নেই। আমি একা। সেদিন বুঝলাম, “আকাশটা আমার।”
এরপর আকাশে আধা ঘণ্টা কাটালাম। বুঝতে পারলাম আজকের আকাশটা শুধুই আমার। আমি পারবো। আধা ঘণ্টা সময় কতো দ্রুত কেটে গেলো। সেদিনের ফিলিংসটা একেবারেই আলাদা। আকাশে যেসব ফ্লাইট ছিলো সেখান থেকে ক্যাপ্টেন স্যাররা আমাকে অভিনন্দন জানালেন। আমার ল্যান্ডিংটাও ভালো হয়েছিলো। আমাকে সবাই সেলিব্রেট করলেন। সেদিনের মতো আনন্দ-অনুভূতি আর কখনো পাইনি। এরপর রাতে যখন প্রথম একা আকাশে উড়েছি তখনো একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিলো। রাতের আকাশ অসম্ভব সুন্দর লেগেছিলো। অনেক বাধা থাকলেও আমি এই পেশাটাকে অনেক পছন্দ করি। এটা আমার প্যাশন । প্যাশনের কারণেই আমি আজ পাইলট হতে পেরেছি। যিনিই এই পেশায় আসুন না কেনো তার প্যাশন বা ধৈর্য লাগবেই।
এখন আমার অ্যাম্বিশন, আমি একজন ক্যাপ্টেন হবো।
তবে সব বাধা পেরিয়ে আজকে আমি একজন পাইলট- এটাকেই আমার জীবনে সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে আমি মনে করি। আর আমি আজকে এতো বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, যতো ধৈর্য নিয়ে আজ যে অবস্থানে এসেছি এর পেছনে মূল অবদান আমার মা-বাবার। তারা সাপোর্ট না দিলে আমি এতো দূর আসতে পারতাম না। আমি পাইলট হয়েছি, এটা আমার চেয়ে আমার মা-বাবা বেশি উপভোগ করেন। এখন তারা আমার ছোট ভাইকেও অ্যাভিয়েশনে দিয়ে দিয়েছেন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: রবাব রসাঁ
Comments