বাঁশি আমার পরম মিতা:রাহুল আনন্দ
নিতান্ত ক্ষুদ্র বলে দাবি করেন নিজেকে আমাদের ভালোবাসার গানওয়ালা, রাহুল আনন্দ। শুধু সংগীতের জগতেই নয়, অভিনয় এবং চিত্রশিল্পেও রয়েছে তার অবাধ বিচরণ। ‘জলের গান’-এর জলজ এ প্রাণের দারুণ ব্যস্ত সময় কাটছে সাত বছরের পুত্র তোতা এবং স্ত্রী চিত্রশিল্পী উর্মিলা শুক্লাকে নিয়ে। সবসময় নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে সবাইকে চমকে দেয়া যেন রীতিমতো তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পী তার ব্যক্তিগত ভাবনা ও ভালোলাগার কথাগুলো খুব সাবলীলভাবে ব্যক্ত করলেন আনন্দধারার সঙ্গে তার কথোপকথনে।
আনন্দধারা : গানওয়ালা হয়ে ওঠার পেছনে আপনার অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানতে চাই।
রাহুল আনন্দ : আমার শৈশব কেটেছে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে। উল্লেখযোগ্যভাবে শৈশবের ৫টি বছর আমি কাটিয়েছি মামাবাড়ি হবিগঞ্জে এবং সেই বাড়িটিই আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। দ্বিতীয়ত, আমার মা সর্বদাই আমাকে যে কোনো ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করতেন। আমার বিনম্র শ্রদ্ধা আমার সব শিক্ষকের প্রতি, যারা চলার পথে আজীবন আমাকে অনুপ্রাণিত করে আসছেন। শ্রদ্ধেয় প্রিয়লাল দাসের অনুপ্রেরণা ছিল আমার জন্য আশীর্বাদ, যিনি ছিলেন একইসঙ্গে আমার বাবার বন্ধু এবং আমার স্কুলের শিক্ষক। পরবর্তীতে অনেকের কাছ থেকে অনেক কিছু বিভিন্নভাবে শিখেছি। শিক্ষাকে আমি সারাজীবনই স্বাগত জানাই; যে ব্যক্তি আমার চেয়ে কোনো বিষয়ে সামান্য বেশি জেনে থাকেন, তার কাছ থেকেও শেখার চেষ্টা করেছি।
আনন্দধারা : আপনার জীবন দর্শন নিয়ে কিছু জানতে চাই।
রাহুল আনন্দ : জীবন একটি চলমান নদীর মতো, যার বাঁক আছে। এর শুরুটা হয়তো এক টুকরো মেঘ থেকে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে। এরপর ধারাবাহিকভাবে পাহাড়ের চূড়ায় থাকলে ঝরনা হয়ে, ক্রমেই তা নদী হয়ে বিভিন্ন আঁকাবাঁকা পথ ধরে শত শত ঘাট, নানারকম মানুষ আর নানা বর্ণিল ঘটনা পেরিয়ে সমুদ্রে মিশে যায়। আরেকভাবে দেখলে বলা যায়, জীবন একটি ভ্রমণ, যার শুরু এবং শেষ দুটোই রয়েছে। আমরা হয়তো বুঝে ওঠার আগেই এপার থেকে এ যাত্রা শুরু হয়ে যায়, কিন্তু একটা সময় আমরা যখন তা উপলব্ধি করি, তখন আর ফেরত আসার কোনো উপায় থাকে না। সব পেরিয়ে জীবনের অপর প্রান্তে যখন কেঊ পৌঁছে যাবে, সেখানেই হয়তো এ যাত্রার সমাপ্তি ঘটবে। এ যাত্রায় কেউ সফল হয়, আবার কেউবা অতলে হারায়।
আনন্দধারা : সংগীতকে আপনি কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
রাহুল আনন্দ : অদৃশ্য যে কোনো কিছুই বিশেষ শক্তিশালী, যা আমরা জ্ঞানত এবং ধ্যানত মানি। খেয়াল করলে দেখা যায়, আমাদের চারপাশে যা কিছু মহাশক্তিধর, মহাশক্তিমান সবই অদৃশ্য। একটি চিত্রকলার রূপ রয়েছে, একটি নৃত্যকলাকে রূপায়িত করা যায়, কিন্তু সংগীতের দৃষ্টত কোনো রূপ নেই। সংগীত ও শব্দ নিয়ে এখানে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। শব্দ তৈরি করা এবং সংগীতের সূচনা কখনোই এক নয়। যে মুহূর্তে কতগুলো সুরের সফল সন্ধিতে সংগীত পূর্ণতা পায়, ঠিক তখনই তা সবার ভেতরে প্রবাহিত হয়। আমার যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া সংগীতকে ঘিরেই, সংগীতেই আমি সুখ খুঁজি, আবার আমার দুঃখগুলোও সংগীতেই মেলায়। সংগীতের ভাবটা আমার জানা আছে, কিন্তু এর ভাষা আমার জানা নেই। আমার আরাধনা, আমার নিঃশ^াস-প্রশ্বাসে সংগীত। বিশুদ্ধ বায়ু যেমন শ্বাসগ্রহণে আরাম দেয়, আবার ধোঁয়া বা ময়লা-ধুলো থাকলে যেমন কষ্ট হয় এবং নিঃশ্বাস না নিলে যেমন দম বন্ধ হয়ে আসে, ঠিক তেমনি সংগীত চর্চা ছাড়া আমার দম বন্ধ বোধ হয়। ‘ক্ষণিক থাকে শূন্যের ওপর, ক্ষণিক ভাসে নীড়ে’। অর্থাৎ, নিঃশ্বাস নেয়ার সময়টা নীড়ে ফেরা আর প্রশ্বাসের সময়টা শূন্যে ভাসার সঙ্গে তুলনা করা যায়। প্রাণের এই যাওয়া-আসার সঙ্গে আমি বাঁশির মিল খুঁজে পাই। বাঁশি আমার পরম মিতা। এই যন্ত্রের ভেতর দিয়ে যখন বায়ু প্রবাহিত হয়ে সুর তোলে তখন তা বাঁশি, আবার যখন বায়ু বইছে না তখন তাকে বলি বাঁশ। ঠিক তেমনি আমার শরীরে যখন বায়ু প্রবাহিত হয় তখন আমি মানুষ, আর যখন তা প্রবাহিত হয় না তখন আমি লাশ।
আনন্দধারা : সংগীতের সঙ্গে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
রাহুল আনন্দ : খুব বেশি পরিকল্পনা করে আমার কাজ করা হয়ে ওঠে না। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, আমার পরিকল্পনাগুলোও ক্ষুদ্র এবং সেগুলোকেই আমি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে যাই। যেমন যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয়, আগামী কয়েকদিন আমি কী নিয়ে ব্যস্ত থাকব; তখন উত্তরে আমি বলব আমার বাড়ির সামনে যে কাঠের টুকরো পড়ে আছে, আমি এ কয়দিন সে কাঠের টুকরোটি নিয়েই কাটাব। পরবর্তীতে এ কাঠের টুকরো থেকে একটি বাদ্যযন্ত্র বের হতে পারে, আবার একটি কাঠপেন্সিলও বের হতে পারে। এরই মধ্যে কলকাতার শিল্পীদের আমন্ত্রণ পেলাম। সেই ১৯৯৫ সাল থেকে সেখানে বছরে তিন-চারবার করে যাওয়া হয়ে থাকে। তবে এবারের কথা ভিন্ন। এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ছাড়া আমার কলকাতা যাওয়া, বেশ সাত-আট দিন তাদের আসরে সংগীতে আচ্ছন্ন হয়ে কাটিয়ে দেয়ার বাহানা।
আনন্দধারা : জলের গান নিয়ে কী ভাবছেন?
রাহুল আনন্দ : জলের গানকে আমরা প্লাটফর্ম বলি; যেখানে ট্রেন আসে, ট্রেন চলে যায়। এই ট্রেনের যাত্রীরা কেঊ আগের স্টেশনে নেমেছে, কেউ হয়তো দশ স্টেশন পরে নেমে যাবে। আপাতত, জলের গানের গাড়িটা এখন থেমে আছে; হয়তো যাত্রী ওঠার পর পুনরায় যাত্রা শুরু হবে পরবর্তী প্লাটফর্মের উদ্দেশে।
আনন্দধারা : অবসরে নিশ্চয়ই বই পড়া হয়। আপনার পছন্দের বই কোনটি?
রাহুল আনন্দ : আমি প্রতিদিন বই পড়ি। বই পড়লে যে শুধু যিনি লেখক তার অনুভূতিগুলোকেই স্পর্শ করা যায় তা না, বরং সেই গল্পটি লেখার সময় এবং পরিস্থিতি নিজের কল্পনায় অনুভব করা যায়। বই আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। কিছু বই আছে যেগুলো আমি বারবার পড়ি, তার মধ্যে একটি হচ্ছে;-জীবনানন্দের কবিতাসমগ্র। যখন আমি খুব কষ্টে থাকি তখনো তার অন্তত দুটি কবিতা পড়ি, এমনকি রাতে আমি ঘুমাতেও যাই বই পড়তে পড়তে।
আনন্দধারা : অবসরে চলচ্চিত্র দেখা হয়?
রাহুল আনন্দ : অবসরে চলচ্চিত্র সবার মতো আয়োজন করে খুব বেশি দেখা হয়ে ওঠে না, তবে তারপরও সময়-সুযোগ করে দেখার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে, বোদ্ধাজনেরা যেসব চলচ্চিত্রকে ভালো বলে গেছেন বা বলেন তার ওপর ভিত্তি করে আমি চলচ্চিত্র নির্বাচন করে থাকি।
আনন্দধারা : গানের সঙ্গে আপনার মিত্রতা তো চিরকালীন। এই মুহূর্তে আপনার প্রিয় নির্দিষ্ট কোনো গানের নাম বলতে পারছেন কি?
রাহুল আনন্দ : অসংখ্য গান আমি মনে লালন করে বেঁচে আছি। একেক সময় একেকটি গান এসে আমাকে গ্রাস করে, যেমন এই মুহূর্তে গীতিকবি অতুলপ্রসাদ সেনের একটি গান- ‘যাব না যাব না যাব না ঘরে’ আমাকে বশীভূত করে রেখেছে। তেমনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আকাশভরা সূর্য-তারা’ এবং ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে’ আমার প্রাণের গান।
আনন্দধারা : জীবনে চলার পথে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে হয়তো আপনি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, সে সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন...
রাহুল আনন্দ : আদর্শ বলতে প্রথমেই আমি প্রকৃতিকে বুঝি। পরমের এই যে লীলাভ‚মিত্র এটিই সব সুন্দরের আধার। এর মধ্যে আমি আছি, আমার গুরুরাও আছেন। সবকিছু মিলেই এ ভূমণ্ডল। তবে প্রিয় মানুষ যাকে আদর্শ হিসেবে মেনেছি, তিনি হলেন প্রিয়লাল দাস, আমার শিক্ষক। জীবনকে বিভিন্নভাবে দেখার কৌশল তার কাছ থেকেই শেখা; এমনকি তিনি যখন দূরে থাকতেন, দেখা হতো না, তখন আমরা পরস্পরকে চিঠি বিনিময় করতাম এবং চিঠিগুলোতে থাকত অদ্ভূত সুন্দর সব কথা। চিঠিগুলো আমার জীবনের অমূল্য উপহার এবং নির্দেশিকা। এছাড়া বারী সিদ্দিকী এবং আজাদ আবুল কালাম আমার গুরু, আমার আধ্যাত্মিক গুরু আছেন যাদেরকে আমি আদর্শ মানি। আমি সংগীতকে বোঝার জন্য এক ধরনের আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিচালনার চেষ্টা করছি। সেখানেই হয়তোবা আমি সংগীতের প্রকৃত রস আস্বাদন করতে সক্ষম হব।
Comments