ঈদের আতিথেয়তা
ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো আতিথেয়তা। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঐতিহ্যভেদে উৎসবের আমেজ বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রকমারী খাবারের আয়োজনের পাশাপাশি অতিথি আপ্যায়নের জন্য আনুষঙ্গিক সব ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত নগরবাসী, পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও ঈদের আমেজ লক্ষ করা যায়। শহরে ঈদের আতিথেয়তা ঈদকে উপলক্ষ করে শহুরে জীবন হয়ে ওঠে রঙিন; কেউ হয়তো বিখ্যাত কোনো স্থানে ভ্রমণকে বেছে নেয়, তবে বেশিরভাগ মানুষই প্রচলিত ধারা অনুযায়ী অতিথি আপ্যায়ন এবং এর পূর্বপ্রস্তুতিতে ব্যস্ত।
শহরে ঈদের আতিথেয়তা
অভ্যর্থনা : ঈদে বাড়িতে অতিথি এলে অভ্যর্থনা জানানো আজকাল শহরে বেশ প্রচলিত। অতিথি বাড়িতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই কুশল বিনিময় করে সাদরে বসার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকের বাড়িতে বসার ঘরে রঙিন বাতি ও মিউজিকের মাধ্যমে অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানো হয়ে থাকে।
খাবার : অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে ঈদের বিশেষ খাবার হলো সেমাই, পায়েস, জর্দা ও অন্যান্য মিষ্টি খাবার। ঝাল ও মচমচে খাবারের প্রচলনও দেখা যায়। কোরবানির ঈদের বিশেষ আকর্ষণ হলো গরুর মাংসের বিভিন্ন রেসিপি। এছাড়া পোলাও, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, কোরমা, কাবাব তো রয়েছেই। তবে আজকাল শহরগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে ভিন্ন স্বাদের বিদেশি বিভিন্ন রান্না, ডেজার্ট আইটেম এবং জুস কিংবা কোমল পানীয় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
গৃহসজ্জা : শহরে উৎসব মানেই সাজসজ্জা। সেটি পোশাকের ক্ষেত্রেই হোক বা গৃহের ক্ষেত্রেই হোক। ঈদে অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে গৃহ পরিবেশ সুন্দর ও মনোরম রাখার দায়িত্ব পরিবারের সব সদস্যের ওপর বর্তায়। অনেকে নিজের বাড়ি ফুল দিয়ে সাজিয়ে থাকেন, ফলে গৃহ পরিবেশ খুব স্নিগ্ধ মনে হয়। সাধারণত হালকা রঙের পর্দা, রঙিন বাতি, নকশা আঁকা মাটির পাত্র ইত্যাদি দ্বারা ঘরকে সাজানো হয়ে থাকে।
পোশাক : ঈদে ট্রেন্ডি পোশাক নিয়ে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের বেশ উত্তেজনা দেখা যায়। অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো হয় নতুন পোশাক পরে। তবে প্রবীণ ও গৃহের কর্তা-কর্ত্রীদের অতিথি আপ্যায়ন ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। গৃহের কর্তা-কর্ত্রীরা অনেক সময় অতিথিদের পোশাক ও অন্যান্য উপহার দিয়ে থাকেন।
সালামি : আমাদের দেশে ঈদের আরেকটি চমক হলো পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা ছোটদেরকে সালামি দেয়ার রীতি। অতিথি বয়সে ছোট হলে যেমন সালামি দেয়া হয়, তেমনি বয়সে বড় হলেও তিনি বাড়ির ছোট সদস্যদের সালামি দিয়ে থাকেন।
কোরবানির পশুর মাংস বিতরণ : পবিত্র ঈদুল ফিতরে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও গরিবদের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ করা হয়ে থাকে। ঈদে কেউ বাড়িতে বেড়াতে এলে তাকে যথাসম্ভব সমাদর করা হয় এবং আত্মীয়দের মাঝে কোরবানির মাংস বিতরণ করা হয়ে থাকে।
গ্রামাঞ্চলে ঈদের আতিথেয়তা
ঈদ আসন্ন হলেই আমাদের দেশের গ্রামগুলোতে সাড়া পড়ে যায়। গ্রামীণ জীবন তুলনামূলকভাবে সাদাসিধে হলেও বিভিন্ন উৎসব উদযাপন ও রীতি-রেওয়াজে অঞ্চলভেদে রয়েছে বৈচিত্র্য। তবে আজকাল প্রযুক্তির কল্যাণে গ্রামেও আধুনিকতার ছোঁয়া লক্ষণীয়, যা অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে থাকে।
খাবার : আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের ঈদ উদযাপন অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। খাবারের বেলাতেও এর ব্যতিক্রম ঘটে না। তবে কম-বেশি সব অঞ্চলেই পিঠাপুলি ও অন্যান্য মিষ্টি খাবারের আয়োজন করা হয়। গ্রামাঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নের বিশেষ খাবার হলো ঘি বা তেলে ভাজা সেমাই এবং পায়েস। ইদানীং গ্রামেও পোলাও, কোরমা, কাবাব এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন খাবারের আয়োজন করা হয়।
গৃহসজ্জা : ঈদের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গ্রামে মানুষজন ঈদের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বুনন, কাপড়ে নকশা এঁকে সেলাই, মাটির পাত্রে ছবি আঁকা বা রঙিন নকশা করার কাজটি গ্রামগুলোতে বহুদিন আগে থেকেই বেশ জনপ্রিয়। এজন্য গ্রামে নারীরা এসব উপকরণ দিয়ে তাদের ঘর এবং ছোট ফুলের গাছ দিয়ে বাড়ির বারান্দা ও আঙিনা সাজিয়ে থাকে। ফলে এসব উপকরণ অতিথি আপ্যায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
পোশাক : গ্রামে জীবনযাপন শহরের তুলনায় খুব সাধারণ। তবে একথা অনস্বীকার্য, আজকাল শহুরে ট্রেন্ডি পোশাকের প্রভাবে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী তরুণ-তরুণীরাও বিশেষভাবে প্রভাবিত। তাই নতুন পোশাক পরে অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানো এবং আপ্যায়নের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে।
মেলা : আমাদের দেশের গ্রামগুলোতে ঈদের বিশেষ চমক হলো মেলা। এসব মেলার মাধ্যমে এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামের উৎসব উদযাপনে শামিল হয়, অতিথিরা বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। ফলে সবার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব বজায় থাকে।
কোরবানির পশুর মাংস বিতরণ : ঈদুল আজহাতে গ্রামে পশু কোরবানি এবং মাংস বিতরণের সময় পাড়া-প্রতিবেশীরা একে অপরকে সহযোগিতা করে থাকে। ঈদে অতিথি বাড়িতে এলে কোরবানির মাংসের নির্দিষ্ট অংশ অতিথির পরিবারের জন্য দেয়া হয়ে থাকে।
প্রবাসে ঈদের আতিথেয়তা
দেশীয় আতিথেয়তা প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালিদের থেকে ভিন্ন। তবে সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ঈদকে যথার্থভাবে পালন করার জন্য প্রবাসীরাও বিভিন্ন ধরনের আয়োজন করে থাকেন। অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর প্রথা দেশের চেয়ে প্রবাসেই বেশি প্রচলিত। প্রবাসে বসবাসকারীরা একে অপরকে বাড়িতে ঈদের বিশেষ নিমন্ত্রণ করে থাকেন। বাড়িতে অতিথি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ফুল, মিউজিক, রঙিন বাতি ইত্যাদির মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়। ঐতিহ্যবাহী দেশি খাবারের আয়োজন করা হয়। বাড়ি ফুল, রঙিন বাতি, পর্দা ইত্যাদি দ্বারা সাজানো হয়। অনেক সময় বসার ঘরে সুগন্ধের ব্যবস্থা করা হয়। দেয়ালচিত্র, মাটি ও বিভিন্ন ধাতুর তৈরি ছোট ছোট শিল্প-সামগ্রী দ্বারা বাড়ি সাজানো হয়। অনেকে বারান্দা ও বাড়ির আঙিনায় বাহারি ফুলের গাছ লাগিয়ে থাকেন, যা গৃহের শোভাবর্ধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। ঈদ উপলক্ষে নতুন পোশাক পরে অতিথিকে বিশেষভাবে সমাদর করা হয়। ফলে তাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠে। উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো থাকে। আতিথেয়তা আমাদের দেশি ঐতিহ্য, এটিকে বহন করার দায়িত্ব সবার। অঞ্চলভেদে এর ধরনে তারতম্য দেখা দিলেও এদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে উতসব উদযাপন করা হয়, তার পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এসব আয়োজন এবং প্রচলিত ধারা অনুযায়ী অতিথি আপ্যায়নের ফলে সমাজে মৈত্রী ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
Comments