ডিজিটাল মানহানি

Section 57

একটা সময় ছিল যখন মানি লোকদের সম্মানহানি হলে তাঁরা মামলা করতেন; মামলায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ চাইতেন। দিন বদলে গেছে। এখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোন প্রতিবেদন অথবা ফেসবুকে প্রকাশিত কারো মন্তব্যে অথবা ফেসবুকে কোন কিছু শেয়ার করার ফলে মানি ম্যান অর্থাৎ টাকা পয়সাওয়ালাদের মানহানি হলে তাঁরা মামলা করেন ঠিকই, কিন্তু মামলায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ চান না। তাঁদের হয়তো সম্মানহানির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন টাকা পয়সার দরকার নেই।

মানিদের তাহলে কি অনেক টাকা? অনেক টাকার মালিক যারা তাঁরা ভাবতেই পারেন যে, মাথা যাদের গোবরে ভরা তাঁরাই মানিদের মান নিয়ে অহেতুক টানাটানি করেন। মানি লোকেরা জ্ঞানী ও বিচক্ষণও বটে। তাঁরা ভালো করেই জানেন, যারা তাঁদের মানে নুন ছিটিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা ছাপোষা কেরানী গোত্রের মানুষ। অর্থ-বিত্তের দিক থেকে তাঁদের সমকক্ষ নয়। আবার যুক্তি প্রমাণ দিয়ে মানহানি হয়েছে প্রমাণ করে আদালতে জেতা যেমন কঠিন, তেমনি জিতলেও অল্প-স্বল্প টাকাওয়ালাদের কাছ থেকে কত টাকাই বা আদায় করা সম্ভব। অত অল্প অর্থের দিকে হয়ত তাঁদের নজর নেই। বরং মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা এরকম অল্প বিত্তের লোকদের শাস্তি হিসেবে আদালত প্রাঙ্গণে ব্যস্ত রাখা বা বিনা বিচারে কিছু দিনের জন্য কারাগারে পাঠানোকে তাঁরা অতি উত্তম পন্থা মনে করছেন। এতে করে অন্যরাও ভয় পাবে; মানি লোকদের মান নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলতে সাহস পাবে না।

এটা ঠিক মানি [টাকা] না থাকলে এ হুজুগের যুগে মানিলোক হওয়া যায় না। মানিতেই এখন সব হানি [মধু]। যত বেশি মানি তত বেশি হানি, তত বেশি মান। আবার মানি নিয়েই যতো সব হানাহানি এবং মানহানি।

আগে যারা মানহানির মামলায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ চাইতেন তাঁদের কি টাকা পয়সার কমতি ছিল? তাঁরা উপনিবেশিক আমলে প্রণীত আইনের বিধান অনুসরণ করে মামলা করতেন। এখন ডিজিটাল যুগ; শত বছর আগের বিধান এখন প্রায় অচল। মানহানির মামলা এখন হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে। সেখানে যে ৫৭ ধারা আছে; তা উপনিবেশিক আমলে প্রণীত বিধানের চেয়ে অনেক ভয়ংকর।

অন্য আরেকটি আইনি বিধান দিয়ে ব্রিটিশরা তাঁদের আমলে প্রণীত আইনে মানহানি সংক্রান্ত মামলা করার বেলাতেও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। সে বিধান অনুসারে যে কেউ চাওয়া-মাত্র মামলা করতে পারেন না। যার মানহানি হয়েছে শুধু মাত্র সেই ব্যক্তি মামলা করতে পারেন। আদালতের অনুমতি নিয়ে কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্রে প্রক্সি মামলা করা যেতে পারে। কিন্তু ৫৭ ধারা অবারিত সুযোগ এনে দিয়েছে মানি লোকদের এবং তাঁদের অনুসারী বাহিনীদেরকে। মানি লোক নিজে মামলা না করে তার আত্মীয়-স্বজন, পাড়া পড়শি, দলের নেতা কর্মী যে কাউকে দিয়ে মামলা ঠুকে দিতে পারেন।

উপনিবেশিক আমলে প্রণীত আইনে মামলা হলে আদালতের অনুমতি ছাড়া পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না। কিন্তু ৫৭ ধারায় মামলা হলে পুলিশ নিজেই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পুরতে পারে। আদালতে জামিন পেলে তবেই মুক্তি। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক জন সাংবাদিক ভয়ংকর ৫৭ ধারার শিকার হয়ে কারাগারে গেছেন। কেউ কেউ ফেসবুকে মন্তব্য করে ফেঁসে গেছেন। কেউ বা অন্য কারো মন্তব্য বা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ার করে ৫৭ ধারার জালে আটকে গেছেন। ৫৭ ধারা এখন ভুক্তভোগীদের কাছে এক আতঙ্কের নাম।

ভুক্তভোগী ছাড়াও যে কেউ এখন ফেসবুকে কিছু লেখার আগে বা কিছু শেয়ার করার আগে দশবার ভাবেন কাজটা করবে কি না। আইনের দ্বারা আরোপিত যৌক্তিক বিধি নিষেধ সাপেক্ষে সংবিধান মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা দিয়েছে তা আজ ৫৭ এর কাছে অসহায়! ধারা ৫৭ কি যৌক্তিক বিধিনিষেধ? গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে ৫৭ সহায়ক না প্রতিবন্ধক?

এমন একটা বিধান ভারতের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে রাখা হয়েছিল। সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট বিধানটিকে অসাংবিধানিক এবং অগণতান্ত্রিক হিসাবে ঘোষণা করেছে।

তবে ৫৭ ধারার খড়গ থেকে সরকার আমদের সহজে মুক্তি দিবে বলে মনে হয় না। সে জন্য নিজেদেরকেই পথ বের করে নিতে হবে। সম্ভাব্য কী কী পথ থাকতে পারে? এক হতে পারে, সরকার যতই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলুক না কেন নিজেকে ডিজিটাল থেকে এনালগ যুগে নিয়ে যান। মতপ্রকাশ করুন ছাপার অক্ষরে, বই লিখুন; তবে ভুলেও লেখা বই অনলাইনে দিবেন না। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন, মতামত ছাপা আকারেই রাখুন, সে সব অনলাইনে দিবেন না। অনলাইনে গেলেই ৫৭ ধারা। নিউজ পোর্টাল আপনারাও কিছু কিছু আইটেম অনলাইনে না দিয়ে কাগজে মুদ্রণ করুন। ৫৭ ধারা থেকে নিরাপদ থাকুন।

Comments

The Daily Star  | English

Exports under strain as India slaps more restrictions

Industry insiders say the new restrictions could deepen Bangladesh's export woes at a time when global demand remains fragile and other sectors—from garments to processed foods—also face trade hurdles

58m ago