‘ভারতের চেয়ে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেশের আলোকচিত্রীরা পাচ্ছেন’

Kanak
আলোকচিত্রী মোঃ জাকিরুল মাজেদ কনক। ছবি: সংগৃহীত

এবছর বিপিএস-পেপার ওয়ার্ল্ড আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় মোঃ জাকিরুল মাজেদ কনক পেয়েছেন গোল্ড ট্রফি। এ প্রতিযোগিতায় মোট ১৬৪ পুরস্কারের মধ্যে বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের অর্জন ছিল ৩২টি পুরস্কার। তাঁদের মধ্যে কনক সর্বোচ্চ পাঁচটি পুরস্কার লাভ করেন। দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেন:

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: বিপিএস-পেপার ওয়ার্ল্ড ৩য় আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ফটোগ্রাফারদের মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচটি পুরস্কার আপনি জিতে নিলেন। কেমন লাগছে?

মোঃ জাকিরুল মাজেদ কনক: পুরস্কার আসলে একটা স্বীকৃতি। এটা পেলে ভালো লাগে। কিন্তু এটা দিয়ে আপনি ভালো-খারাপের বিচার করতে পারবেন না। অনেক ভালো ভালো আলোকচিত্রী রয়েছেন যাঁদের পুরস্কারের দিক থেকে খুব বড় কোন অর্জন নেই। অথচ তাঁরা খুবই ভালোমানের আলোকচিত্রী।

পুরস্কারের আশায় ভালো আলোকচিত্রীরা কাজ করেন না। তাঁরা তাঁদের ভালোবাসা থেকেই কাজ করেন। পুরস্কার শুধু তাঁদের উৎসাহের গাছের গোড়ায় সারের মতো কাজ করে। এই প্রতিযোগিতায় ন্যাশনাল ক্যাটাগরিতে গোল্ডসহ মোট পাঁচটি পুরস্কার পাওয়াটা আমার জন্য অনেক আনন্দের বিষয়। আনন্দ তো আর মুখের ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ছবির ভাষায় হয়তো বোঝাতে পারতাম, কিন্তু কথায় সাজিয়ে প্রকাশ করতে পারছি না।

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: এবারের ইন্টারন্যাশনাল ক্যাটাগরিতে গ্র্যান্ড পুরস্কার বাংলাদেশ পেল না, আপনার মতে বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের ছবিতে কমতি কোথায় ছিল?

কনক: পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই এখানে ছবি জমা দেওয়া হয়েছে। আমি যতদূর জানি এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ছবির সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত বড় বড় আলোকচিত্রীদের অনেকেই এখানে নিজেদের ছবি জমা দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিযোগিতাটি খুবই কঠিন ছিল। আমি ঠিক এভাবে বলব না যে বাংলাদেশের আলোচিত্রীদের ছবিতে কোন কমতি ছিল, হয়তো পুরস্কার বিজয়ীদের ছবিতে বাড়তি কিছু ছিল যার জন্য তাঁরা পুরস্কৃত হয়েছেন। তবে একজন বাংলাদেশি হিসাবে এটা বলবো যে, ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যান্ডটা যদি আমাদের দেশের কেউ পেতেন তবে নিজের পাঁচটি পুরস্কার পাওয়া থেকেও আমার কাছে অনেক বেশি আনন্দের হতো সেটা।

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: এই প্রতিযোগিতায় ছয়টি বিষয় ছিল। প্রতিটিতেই বাংলাদেশের একাধিক পুরস্কার রয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের মধ্যে শুধুমাত্র আপনিই ন্যাচার ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছেন। এখানে এমন অবস্থা হওয়ার কারণ কি?

কনক: বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলা হয়। কারণ, আমাদের দেশ সবুজে ভরা। সুজলা-সুফলা-শস্য শ্যামলা এ দেশ। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশের আলোকচিত্রীরা ব্যতিক্রমধর্মী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরতে পারেন যেটা আমরা পারছি না। বাংলাদেশের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এখানকার দূষিত পরিবেশ। অনেক সুন্দর ফ্রেম এবং পরিবেশ পাওয়ার পরও আমরা সুন্দর একটি ছবি নিতে পারি না। এই ক্যাটাগরিতে ছবি হতে হয় একদম ঝকঝকে। কিন্তু, আমাদের দেশে যে পরিমাণ পরিবেশ-দূষণ তাতে আমরা ঝকঝকে ছবি তেমন একটা পাই না। বাতাসে ধূলিকণা আমাদের এখানে অনেক বেশি। আর বিশ্বের অনেক দেশের সৌন্দর্য আমাদের থেকেও অনেক বেশি। সেটাও আমাদের মনে রাখা দরকার। তাঁদের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতায় টেকা একটু কষ্টকর হবে এটাতো স্বাভাবিক।

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: বিশ্ব আলোকচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

কনক: দুর্দান্ত। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বিশ্ব আলোকচিত্রে চতুর্থ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের থেকে একটু এগিয়ে আছে ভারত। ভারতের থেকে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার আমাদের দেশের আলোকচিত্রীরা পাচ্ছেন। আমাদের ছবির মানও তাঁদের থেকে ভালো হচ্ছে। আশা করছি, অচিরেই তাঁদেরকে পেছনে ফেলতে পারবো এবং এক সময় পৃথিবীর আলোকচিত্রে বাংলাদেশ হবে নাম্বার ওয়ান।

তরুণ যাঁরা ছবি তুলছেন তাঁরা খুবই ভাল করছেন। তাঁদের নিয়েও আমরা খুবই আশাবাদী। আমাদের যারা পথপ্রদর্শক তাঁরাও তাঁদের অভিজ্ঞতা নতুনদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আলোচনা করে তারুণ্যের সঙ্গে অভিজ্ঞতার মেল বন্ধন ঘটিয়ে দিচ্ছেন। তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার যৌথ এই শক্তি আমাদের এগিয়ে চলার পথ সুগম করছে।

এর মধ্যে ইউসুফ তুষারের কথা না বললেই নয়। তিনি নতুনদেরকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দ্রুত লয়ে। আমরা আসলে সৌভাগ্যবান; কারণ, আমাদের সিনিয়র যাঁরা রয়েছেন তাঁরা খুবই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের হাতে কলমে শিখান, যা বাইরের দেশগুলোতে এতটা হয় না।

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: আলোকচিত্রী হওয়ার ইচ্ছা হলো কিভাবে?

কনক: ছোটবেলা থেকেই এটা আমার শখ। আমার এক ভাই কামাল মনিরুজ্জামান রূপক। তাঁর ক্যামেরা এবং ক্যামেরার অন্যান্য জিনিসপত্র দেখে আমার খু্ব ইচ্ছে হতো তাঁর মতো হতে। পরিবারের সহযোগিতা তো আর তখন পাইনি, তাই সেই সময় ইচ্ছেটিকে দমিয়েই রাখতে হয়েছে। আমাদের পাশের বাসার এক আংকেল ছিলেন, তাঁর কাছে থেকেই ক্যামেরা নিয়ে মাঝে মধ্যেই ছবি তুলতে বের হতাম। আবার ফিরে এসে তাঁকে ক্যামেরাটি ফেরত দিয়ে দিতাম। আমাকে তিনি পছন্দ করতেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। এক সময় তিনি যখন দেখলেন আমি অনেক ভালো ছবি তুলছি তখন তিনি ওই ক্যামেরাটি আমাকে গিফট করে দেন। এভাবেই শুরু।

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: আপনার কাছে অনুসরণীয় ব্যক্তি কে বা কারা?

কনক: গুরু ছাড়া আসলে কেউই ভালো কিছু করতে পারেন না। আমি শুরুর দিকে যখন ছবির বিষয়গুলো কিছু কিছু বুঝতাম তখন ডাঃ শুভ্র ও চন্দন ভাইদের ছবি দেখতাম। তখন তাঁদের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু তাঁদের কাজ বুঝতে চেষ্টা করতাম। আমার প্রথম পুরস্কার যেবার পাই সেবার দেখা হয় ইউসুফ তুষার ভাইয়ের সঙ্গে। এরপর থেকে তিনি আমাকে হাতে কলমে সব শিখিয়েছেন। সময় এবং শেখানোর ব্যাপারে কোন ধরণের কার্পণ্য তাঁর ছিল না। সব মিলিয়ে গুরু বলতে গেলে ইউসুফ তুষার ভাইকেই বলতে হবে।

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: আগামী পাঁচ বছর পর বাংলাদেশের আলোকচিত্র কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলে আপনি মনে করেন?

কনক: ক্রিকেট বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছে বলেই আমরা সবাই জানি এবং মানি। কিন্তু আলোকচিত্রের দিকে যদি তাকান পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা দেশ বাংলাদেশকে চিনছে এই বিষয়টির জন্য। প্রায় সব দেশের আলোকচিত্র প্রতিযোগিতাতেই বাংলাদেশের আলোকচিত্রীরা অংশ নিচ্ছেন এবং পুরস্কৃত হচ্ছেন। আগামী পাঁচ বছর পর আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ বিশ্ব আলোবচিত্রে এক অথবা দুই নাম্বারে থাকবে। তরুণ ফটোগ্রাফারদের ওপর আমার সেই বিশ্বাস রয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: বিশ্বে কোন পুরস্কারটি পাওয়ার জন্য আপনার প্রবল আগ্রহ?

কনক: আমি আসলে পুরস্কার পাওয়ার জন্য ছবি তুলি না। এটা আমার আবেগ থেকে আসে। যার কারণে কোন পুরস্কার পাওয়ার প্রবল আগ্রহ আমার ভেতরে ঠিক কাজ করে না। তবে সারা পৃথিবীর সব আলোকচিত্রীরই আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দুতে থাকা হিপ্পা এবং ওয়ার্ল্ড প্রেস পেলে খুবই ভাল লাগবে। আল্লাহ যদি চান তবে একদিন হয়তো পাব। ২০১৬ সালে বাংলাদেশি হিসাবে আমি হিপ্পাতে চূড়ান্ত বাছাই পর্ব পর্যন্ত ছিলাম।

দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন: নতুন যাঁরা ফটোগ্রাফিতে আসছেন তাঁদের প্রতি কোন পরামর্শ কি?

কনক: নতুনদের জন্য প্রথমেই যেটা বলব তা হলো তোমরা টাকার পেছনে ছুটো না। নিয়মিত অনেক ছবি তুলে নিজের জন্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে যেতে থাকো। চেষ্টা করবে নিজের একটি ভাষা তৈরি করতে। বড় ভাইদের ছবি কপি করলে দিনের শেষে দেখবে আসলে কোন লাভ হচ্ছে না। সেটা তোমার সৃষ্টিশীলতায় ব্যাঘাত ঘটাবে। প্রত্যেক আলোকচিত্রীরই আসলে উচিত প্রচুর সংখ্যক ছবি তোলা এবং অন্যের ছবির সঙ্গে সেসবের তুলনা করা। সেই তুলনায় অন্যের ছবির ভুল না দেখে দেখতে হবে নিজের ছবির ভুলটা কোথায়। এতে করে তাদের ছবির মান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়বে। ছবি তোলার সময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে ছবি যাতে ত্রুটি মুক্ত থাকে। ত্রুটি মুক্তভাবে ছবি তুলতে পারলে সেই ছবি পরবর্তীতে আরও ভালো রূপে সবার সামনে আনা সম্ভব হয়।

Comments

The Daily Star  | English

2 dead, over 500 houses gutted in Rohingya refugee camp fire

Two people were burnt to death and many others injured in a devastating fire that broke out at a Rohingya refugee camp in Cox’s Bazar’s Ukhiya today

1h ago