দেখতে গিয়েছিলাম বর্ষবরণ বিজু

বিভিন্ন জাতি ও জাতিসত্তার সমন্বয়ে আমাদের বাংলাদেশ। সুতরাং, প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা উৎসব ও পালাপার্বণ। আবার জাতিভেদে রয়েছে একই উৎসবের ভিন্ন নাম ও উদযাপনের তরিকা। যেমন- বাঙালির যা পহেলা বৈশাখ, চাকমাদের তা বিজু এবং মারমাদের সাংগ্রাই। ওদিকে রাখাইনরা উদযাপন করে থাকে জলকেলির মধ্য দিয়ে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোয় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বর্ণাঢ্যতায় এসেছে নতুন নতুন সংযোজন। ফলে উৎসবে এসেছে বিচিত্র সব মাত্রা, যাতে অনুভূত হয় চিরায়ত বাংলার বুক থেকে উঠে আসা মন মাতানো মেটেল গন্ধের অভাব। সুতরাং পহেলা বৈশাখ বোধহয় এখন আর শুধুই প্রাণের পার্বণ নয় বরং অসাধারণ এক পণ্য। যাক সে কথা। ইদানীং দেশের বিভিন্ন জায়গা এমনকি বিদেশ থেকেও অনেক দর্শনার্থী বর্ষবরণের উৎসব দর্শন বা উপভোগ করতে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় গিয়ে হাজির হয়ে থাকে। শহরকেন্দ্রিক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও মঞ্চে পরিবেশিত মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা যেখানে আকর্ষণের বিষয় হিসেবে গুরুত্ব পায়।

আমরা বরং সেসব ব্যতিরেকে গ্রামের সাধারণ মানুষের বর্ষবরণ উপভোগ করায় উদ্যোগী হলাম। দেখতে চাইলাম উৎসবকে ঘিরে তাদের সংস্কার- কী খায়, কী পরে বা কী করে ইত্যাদি? ঢাকা থেকে রওনা করে রাঙামাটি শহরে না নেমে তার আগেই ভেদভেদি বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়ি। অদূরেই মনোগড়ের বড়বি আদামে (বড়বিপাড়া) অপেক্ষায় ছিল আমাদের বন্ধু অবলিকিতেশ্বর চাকমা তুখলু। পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমন দুটোই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিজু অর্থ বিশেষ সুযোগ। বিশেষ সুযোগের এই উৎসব একাধিক পর্ব বা দিনে বিভক্ত। যথা- ফুলবিজু, মূলবিজু এবং গোজ্যেপোজ্যে। চৈত্রের শেষ অর্থাৎ বছরের শেষ দিন হলো ফুলবিজু। এই দিনে পরিবারের নারী ও শিশুরা জঙ্গল থেকে ফুল তুলে আনে। সেই ফুল দিয়ে ঘরদোর সাজানো হয়। তার আগে ঘরদোর এমনকি কাপড়-চোপড় সবকিছু ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার-পরিপাটি করার নিয়ম। ফুল দিয়ে কেবল ঘরদোরই নয়, গরু-ছাগল ও অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীদেরও সাজিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও কৃষিকাজে ব্যবহৃত কোদাল,  লাঙল এবং অন্য আরও সব উপকরণকেও ফুল দিয়ে রাঙিয়ে তোলা হয়। মূলত এসব নিয়মবিধি পালনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় ফুলবিজুর দিনটি। আর মূলবিজু হলো বছরের পহেলা দিন, এই দিনে তারা সর্বাধিক আনন্দ করে থাকে। সকালবেলা পরিবারের ছোটরা বেতের তৈরি পাত্রে ধান, কুঁড়া ইত্যাদি নিয়ে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরে হাঁস, মুরগিকে খাওয়ানোর জন্য ছিটিয়ে দেয়। অতঃপর মুরব্বিদের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেয়ার পর্ব শেষে নিজেদের খাওয়ার পালা। তার আগে মুরব্বিদেরকে ভক্তি সহকারে খাওয়ানোর পর্ব সেরে নেয়ায় রয়েছে বিশেষ কঠোরতা। বেলা যখন মাথার ওপর, ঠিক সেই সময়টায় ঝরনা থেকে তুলে আনা পানিতে মুরব্বিদেরকে পরম শ্রদ্ধায় গোসল করানো হয়। এরপর বাড়ি বাড়ি ঘুরে খেয়ে বেড়ানোর পর্ব, চলে দিনব্যাপী।

বিশেষ এই উৎসবকে কেন্দ্র করে তাদের ভাষায় ‘উদিজগর্বা’ শব্দটায় বেশ গুরুত্ব, এর অর্থ হঠাৎ অতিথি। উৎসব চলাকালে যে কোনো বাড়িতে উদিজগর্বা এলে তারা ভীষণ খুশি হয়। আমরা একের পর এক বাড়িতে উদিজগর্বা হয়ে উপস্থিত হই। প্রথমে তুখলুর বন্ধু রাজীব চাকমার বাড়ি গেলাম; বসানোর অল্পক্ষণ বাদেই পরিবেশনের জন্য একের পর এক আসতে থাকে হরেক পদের খাবার। পাঁজন, বিরিয়ানি (মটরকলাইয়ের সঙ্গে মুরগি অথবা আলুর ছোট ছোট টুকরো সহযোগে রাঁধা), শূকরের মাংস, মুরগির মাংস, পিঠা, জিলাপি, রসগোল্লা, আচার, তরমুজ ইত্যাদি। সব খাবারই তাদের ঘরে প্রস্তুত করা। এসবের মাঝে পাঁজন হলো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী একটা পদ। নানা ধরনের শাকসবজি, যেমন- কচি কাঁঠাল, কাঁচকলা, আলু, শিমুল (স্থানীয় বিশেষ ফুল), তারা (ঘাস বা বাঁশ প্রজাতির উদ্ভিদ), মাশরুম ইত্যাদি দিয়ে তৈরি। কমপক্ষে ৫ থেকে শুরু করে ৪৫ বা আরও অধিক প্রকার সবজি দিয়ে এই খাবার প্রস্তুত করা তাদের ঐতিহ্য, যা উৎসবে সব খাবারের মধ্যে প্রধান আকর্ষণ বলে গণ্য হয়ে থাকে।

চাকমাদের ধারণা এই দিনে (মূলবিজু) স্বর্গের দুয়ার খোলা থাকে। তাই তারা বেশি বেশি পুণ্যের আশায় উদিজগর্বা দেখলেই বাড়ি নিয়ে আপ্যায়ন করতে নিমন্ত্রণ জানায়। এতসব দেখে আমরা অল্প অল্প খাচ্ছি কারণ এসে যখন পড়েছি তখন অনেক বাড়ির আতিথেয়তা গ্রহণ করতে হবে নিশ্চিত! একে একে ৪-৫ বাড়িতে উদিজগর্বা হই। ক্রমেই যুক্ত হয়ে যাই স্থানীয় ১৫-২০ জনের এক দলে, যারা ঘুরে ঘুরে একেক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত। কারো বয়স ১৫ তো কারো ৫০। জুম চাষি, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী কোনো ভেদাভেদ নেই, এই দিনের জন্য সবাই সমান। তাদের সঙ্গে একাকার হতে বেশি সময় লাগেনি। জড়তা কাটিয়ে আপন করে নিতে বয়সে সবার বড় রঞ্জদা ও শিমুলদা বলেন, এই দিনের জন্য ছোট-বড় সবাই সমান অতএব, আনন্দ কর। কয়েকটা বাড়িতে হয়ে যায় জম্পেশ গল্পের আসর। খেতে খেতে পরিস্থিতি বেগতিক, রণে ভঙ্গ দিতে চাইলে বলে, এই তো আর এক ঘরে যেতে হবে! এমনি করে এক ঘর দুই ঘর হতে হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত চলে আসে।

আরও ছবি দেখুন: বৈসাবি

মূলবিজু ও ফুলবিজুর পর তৃতীয় দিন গইজ্জা পইজ্জা, অর্থাৎ কেবলই শুয়ে-বসে দু’দিনের বেশুমার খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলা। তাদের আন্তরিক আতিথেয়তা ও আপন করে নেয়ার ঘটনা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার মতো। না আছে ভান, না আছে ভণিতা, আদিকাল থেকে পালিত হয়ে আসা ঐতিহ্য আজো তাদের মাঝে বিদ্যমান। পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে যতটুকু দরকার ঠিক যেন ততটুকুই হয়েছে। বছরে একদিন বাধ্যতামূলক ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান ও আহার-বিহারের মতো ভড়ং ধরে ঐতিহ্যের লালন বা পালন কোনোটাই তারা বোঝে না। উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবে আবিষ্কারও করে না ভিত্তিহীন কোনো বিষয়-আসয়, যা কিছুই করে তার সবটুকুই ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে ও তার প্রতি সম্মান রেখে। সব শেষে পরের বছর বিজু উৎসবে পুনরায় উপস্থিত হওয়ার কথা দেয়ার পর বিদায় নেয়া সম্ভব হয়েছে।

যেভাবে যেতে পারবেন : ঢাকার ফকিরাপুল, কলাবাগান থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত রাঙামাটির বাস পাওয়া যায়। সৌদিয়া, এস আলম, শ্যামলী বাসের ভাড়া ৬০০-৬৫০ (নন এসি), ৭৫০-৮৫০ (এসি)। থাকার জন্য রাঙামাটিতে পর্যটন করপোরেশনের মোটেলসহ রয়েছে একাধিক হোটেল ও লজ।

ছবি : কমল দাশ

Comments

The Daily Star  | English

Economic expectations: Did govt fall short?

When an interim government was sworn into office following the ouster of the Awami League regime just 100 days ago, there was an air of expectation that the Prof Muhammad Yunus-led administration would take steps to salvage a scam-ridden financial sector and rescue an ailing economy.

8h ago