অলিম্পিক
অলিম্পিক গেমস।
অসংখ্য দেশের, অগণিত ক্রীড়াবিদ আর ক্রীড়াপ্রেমীদের সম্মিলন। বিপুল এই আসরে চার চোখের আকস্মিক মিলন আর দুটি হৃদয়ের বেহিসেবি বিগলন অসম্ভব নয়। ফলে দেশ-কাল-ভাষার ঊর্ধ্বে জড়িয়ে যায় জীবন। এই সংযোগে, মধুর উপলক্ষ হয়েই থেকে যায় দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। অলিম্পিকে অঙ্কুরিত এমন প্রেমের কয়েকটি অনবদ্য কাহিনী শোনাচ্ছেন শেখ সাইফুর রহমান
চলছে অলিম্পিক। সরগরম রিও ডি জেনিরো। সেখানে কিন্তু পাখা মেলেছে প্রেম। তবে এ প্রেম অন্যরকম। স্বাগতিক ব্রাজিলের মহিলা রাগবি সেভেন দলটি নকআউট রাউন্ডে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে। তাতে কী? হৃদয় তো আর বাধা মানে না। তাই দলের খেলোয়াড় ইসাডোরা সেরুলোকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন তার গার্লফ্রেন্ড মায়োরি এনিয়া। এনিয়া আবার এই গেমসেরই ভলান্টিয়ার। ব্রাজিলে ২০০৩ সাল থেকে সমকামী বিয়ে বৈধ। তাই তাদের ঘর বাঁধতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অতএব রিও স্মরণীয় হয়ে থাকল অলিম্পিকে প্রথম সমকামী প্রেমের সফল পরিণতির সাক্ষী হিসেবে।
এই ঘটনার রেশ মেলানোর আগেই আরো এক জুটি নিশ্চিত করে ফেলল ভবিষ্যতে একসঙ্গে পথ চলার। অলিম্পিকের নবম দিনে ডাইভিং ইভেন্ট শেষের ঘটনা। মেয়েদের ৩ মিটার স্প্রিংবোর্ড ইভেন্টের পদক প্রদান অনুষ্ঠান সবে শেষ হয়েছে। রৌপ্য পেয়েছেন চীনের হে জি, তার গলায় ঝোলানো রৌপ্যখ-। জয়ের আনন্দে পোডিয়াম থেকে নামছিলেন তিনি। এমন সময় তাকে তো বটেই, উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন তার সতীর্থ এবং বয়ফ্রেন্ড কিন কাই। কাই এবার ব্রোঞ্জজয়ী ডাইভার। পঁচিশ বছরের হে জির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তাকে প্রস্তাব দেন পকেট থেকে ছোট্ট লা বাক্সে ভরা আংটি বের করে। পরে সেটা পরিয়েও দেন। হে পরে বলেন, আমাদের সম্পর্কটা ছ’বছরের। তবে ও যে আজকেই বিয়ের প্রস্তাব দেবে, ভাবতে পারিনি। বলতেই হবে প্রেমের এ এক দারুণ মধুরেণ সমাপয়েৎ। রিও ছেড়ে এবার ক্রমেই অতীতাশ্রয়ী হলে মন্দ হয় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। চারপাশে ছড়ানো ক্ষতচিহ্ন। মানুষের মনে তখনো যুদ্ধের বিভীষিকাময় স্মৃতি। এরই মধ্যে মাত্র তিন বছরের মাথায় লন্ডনে বসে অলিম্পিক গেমস। অংশ নিতে আসেন সাবেক এক ইতালিয়ান সেনা। ওক্তাভিও মিসোনি। হার্ডলার। এর কিছু আগে রোসিতা জেলমিনি এসেছিলেন লন্ডনে, ভালো করে ইংরেজিটা শিখতে।
যা হোক, ইতালির এই দলটির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ পায় সপ্তদশী ইতালিয়ান রোসিতা ও তার বন্ধুরা। ওক্তাভিও তখন ইতালির সুদর্শন আর রমণীমোহন তারকা। ফলে এভাবে তার দেখা পাওয়াটা ছিল রোসিতার স্বপ্নেরও অতীত। শুধুই কি দেখা? এক টেবিলে বসে খাওয়া আর টুকরো-টাকরা কথার মাঝে জীবনের অঙ্কই যে বদলে গেল। ওক্তাভিও-রোসিতা বাঁধা পড়েন অলক্ষ্য সুতোয়।
পরের পুরোটাই কিংবদন্তি। ৫ বছর পর বিয়ে। অলিম্পিকের আরেক বছর ওক্তাভিও একটা ট্র্যাকসুটের ফ্যাক্টরি করেছিলেন। বিয়ের পর উভয়ে মিলে এগিয়ে নেন ব্যবসা। গড়ে তোলেন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ফ্যাশন ব্র্যান্ড মিসোনি। ২০১৩ সালে ওক্তাভিওর মৃত্যু হলেও বেঁচে আছেন রোসিতা। সন্তান-সন্ততি আর ফ্যাশনের বিশ্বজোড়া সা¤্রাজ্য নিয়ে। সঙ্গে ওক্তাভিও-মিসোনির অমলিন স্মৃতি।
তদানীন্তন চেকোস্লোভাকিয়ার এই দুই অ্যাথলেটের জন্মদিনটা কাকতালীয়ভাবে এক। দূরপাল্লার দৌড়বিদ এমিল জাটোপেক। আর জ্যাভেলিন থ্রোয়ার ডানা ইনগ্রোভা। তাদের পরিচয় ১৯৪৮ সালে। লন্ডন অলিম্পিকের কোয়ালিফাইংয়ে। লন্ডন গেমস শেষেই বাগদান। পরের গেমস আসার আগেই বিয়ে। আর বাহান্নর হেলসিংকি গেমসে একই দিনে স্বর্ণজয় এই দম্পতির। কিংবদন্তি এই দম্পতি সারাটা জীবন থেকেছেন দুজনে দুজনার হয়ে।
দুটি হৃদয়ের তীব্র আকর্ষণে বাধা হতে পারেনি দেশ কিংবা ভাষা। ছাপ্পান্নর মেলবোর্ন অলিম্পিকে মনবিনিময় তদানীন্তন চেকোস্লোভাকিয়ার ডিসকাস থ্রোয়ার ওলগা ফিতিকোভা ও মার্কিন হ্যামার থ্রোয়ার হ্যারল্ড কনলির। পরে বিয়ে। প্রাগে ৪০ হাজার অতিথি তাদের বিয়ে উপভোগ করে।
ব্রিটিশ পোলভল্টার হলি বিলসডেল। ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের মূল পর্বে উঠলেও পদক জোটেনি। ষষ্ঠ হয়েছিলেন। হতাশাময় দিনটিকে উজ্জ্বল করে দেন তার বয়ফ্রেন্ড পল ব্র্যাডশ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে। আত্মহারা হলি তাই টুইট করেন : ব্যর্থতার হতাশায় ভরা দিনটিকে ঝলমলে করে দিল পল।
একই আসরে ফরাসি কেজার ইসাবেলা ইয়াকুবুকে অবাক করে দেন তার বয়ফ্রেন্ড সিমোন ফুলশিনিটি। চেক রিপাবলিকের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ শেষে গ্যালারি থেকে পোস্টার লিখে ইসাবেলাকে প্রোপোজ করে চমকে দেন তিনি। মুগ্ধ বিস্ময়ে বিমূঢ় ইসাবেলার হ্যাঁ ছাড়া আর কিইবা বলার ছিল?
মানুষের জীবনে কতই না ইচ্ছা থাকে। যার কতক পূর্ণ হয়, কতক হয় না। তা বলে অলিম্পিক ভিলেজে বিয়ে? হ্যাঁ, এই অসম্ভবকে সম্ভব করেন দুই রাশানÑ জিমন্যাস্ট নিকোলাই পেদ্রোনভ ও লংজাম্পার ডায়ানা ইওরগোভা। চৌষট্টির টোকিও গেমসের ভিলেজে ওদের বিয়ে হয়। বিয়েতে পৌরহীত্য করেন এক জাপানি শিন্টো পুরোহিত।
সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার ক্যাটেরিনা কুরকোভা। আর আমেরিকার ম্যাথিউ ইমনস। উভয়েই শুটার। আলাপ ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকে। গেমসে ইমনসের ব্যর্থতায় পাশে দাঁড়ান ক্যাটি। তাতেই হৃদয়ের একূল-ওকূল দু’কূল ভেসে যায়। দেশকালের গ-ি হয় উপেক্ষিত। ওরা গাঁটছড়া বাঁধেন ২০০৭ সালে। এর মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত হন ইমনস। সেরে উঠে আবার শুরু করেন শ্যুটিং। উভয়েই অংশ নেন বেইজিং ও লন্ডন গেমসে। এখন তারা সুখে-শান্তিতে বাস করছেন কলোরাডোয়।
ডারসি মারকোয়াড ও রিচার্ড হর্টনেস। উভয়েই কানাডার রোয়ার। বেইজিংয়ে হৃদয় বদল। কিন্তু গেমসের পর দীর্ঘ বিচ্ছেদ। ডারসি তখন কাজ করতেন ভ্যাঙ্কুভারে। আর রিচার্ড ছাত্র লস অ্যাঞ্জেলেসে। তবে হাল ছাড়েননি কেউই। পরে দুজনে চলে আসেন ওন্টারিওতে। অংশ নেন লন্ডন গেমসে। রিচার্ড মজা করে বলেছিলেন : অন্তত ১০০ বার প্রোপোজ করার পরই না রাজি হয়েছে ও।
আমেরিকান সাঁতারু মার্ক হেন্ডারসন ও সামার স্যান্ডারস এখন সুখী দম্পতি। স্যান্ডার্সের প্রেমে মার্ক পড়েছিলেন আগেই। তবে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সে কথা স্যান্ডার্সকে বলেই ফেলেন ’৯৬ সালের আটলান্টা গেমসে।
টেনিস সুপারস্টার রজার ফেদেরারও কিন্তু জীবনসঙ্গীর সন্ধান পেয়েছিলেন অলিম্পিক গেমসেই। সেটা ২০০০ সালের সিডনি গেমস। তিনি হেরেছিলেন ব্রোঞ্জ মেডেল ম্যাচে। আর মহিলা দ্বৈতের প্রথম ম্যাচেই হারেন মিরোস্লাভা ভাবরিনেচ। দুই সুইসের হতাশা কেটে যায় একে অন্যের উষ্ণ সান্নিধ্যে। উপভোগ করেন প্রথম চুম্বন। সিডনি তাদের জীবনে থেকে গেছে মধুময় স্মৃতি হয়ে।
ডাউগ আর ডায়ান ক্লেমেন্ট। উভয়েই কানাডার সাবেক অ্যাথলেট। ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে প্রেম। সেবার ডাউগ অংশ নিয়েছিলেন ৮০০ মিটার আর ১৬০০ মিটার রিলেতে। অন্যদিকে ডায়ানের ইভেন্ট ছিল ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট আর ৪০০ মিটার রিলে। পরের অলিম্পিক আসার আগেই বিয়ে সেরে ফেলেন তারা। ট্র্যাকের বাইরে ডাউগ স্পোর্টস মেডিসিনের চিকিৎসক আর ডায়ান বিখ্যাত শেফ। দাম্পত্যের ৫৬ বছর পেরিয়ে বেশ আছেন এই স্প্রিন্টার দম্পতি ফুড, ফিটনেস অ্যান্ড ফানের মোটো নিয়ে।
এবার একটু ফিরে যেতে চাই আজ থেকে ঠিক চল্লিশ বছর আগে। ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিল। ইতিহাস সৃষ্টি করলেন রোমানিয়ার ১৪ বছরের এক মিষ্টি কিশোরী। নাদিয়া কোমানেচি। দ্য পারফেক্ট টেন গার্ল। সারা বিশ্ব এক নামেই চেনে অলিম্পিকে প্রথম দশে দশ পাওয়া এই কিশোরীকে। সেই আসরেই তার প্রেমে পড়েন আমেরিকার জিমন্যাস্ট বার্ট কোনর। তবে প্রেয়সীকে পেতে কোনরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ দু’দশক। কারণ সমাজতান্ত্রিক রোমানিয়ায় কোমানেচিকে এক প্রকার গৃহবন্দি করে রাখে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী চসেস্কুর ছেলে। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে তিনি পালিয়ে আমেরিকায় চলে যান, প্রতীক্ষায় থাকা কোনরের কাছে। চসেস্কু সরকারের পতনের পর রোমানিয়ায় ফিরে ১৯৯৬ সালে বিয়ে করেন নাদিয়া ও কোনর। এখন ওকলাহোমাতেই রয়েছে এই দম্পতি।
এবার ক্রীড়াবিদ নয়, প্রেমের রাজকাহিনী। অলিম্পিক সেখানেও ম্যাচমেকার।
বাহাত্তরের মিউনিক অলিম্পিক। দোভাষী গাইড হিসেবে কাজ পান এক ব্রাজিলিও বংশোদ্ভূত জার্মান তরুণী সিলভিয়া সামারলাথ। চটপটে আর চৌকস মেয়েটি জার্মান ছাড়াও জানে একাধিক ভাষা। কিন্তু এ মেয়ে তখনো কি জানত এই গেমস তার ভাগ্যে কী পরিবর্তন আনতে চলেছে। গেমসে সিলভিয়া ছিল শীর্ষ অতিথিদের গাইড। এই তালিকায় ছিলেন সুইডেনের যুবরাজ কার্ল গুস্তাভ। তিনি পড়ে গেলেন এই সুন্দরীর প্রেমে। তো একদিন নিয়ে গেলেন ডেটে। ডিনারও হলো। যুবরাজ বাঁধা পড়ে গেলেন সিলভিয়ার দুর্বার আকর্ষণে। দাদার মৃত্যুতে পরের বছরই রাজা হন গুস্তাফ। তবুও প্রলম্বিত হয়েছে প্রেয়সীর জন্য প্রতীক্ষা। কারণ আর কিছু নয়, প্রাসাদ-অনুশাসন। দীর্ঘ প্রেম আর রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১৯৭৬ সালে রানী হিসেবে অভিষিক্ত হন সিলভিয়া। মিলন হয় নীল রক্তের সঙ্গে লাল রক্তের। পরম্পরা আর ঐতিহ্যের ব্যত্যয় ঘটিয়ে।
আরো এক যুবরাজ তার প্রেমাস্পদকে খুঁজে পেয়েছিলেন অলিম্পিকে। তবে সেটা আরো অনেক পরে। ২০০০ সালের সিডনিতে। এই প্রেমকাহিনীর নায়ক ডেনিস যুবরাজ ফ্রেদেরিক। সিডনির স্লিপ ইন পাবে তার পরিচয় বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী অজি তরুণী মেরির সঙ্গে। প্রথম দেখায় প্রেম। তবে মাকে মানাতে ফ্রেদেরিকের সময় লেগেছিল ৩ বছর। ২০০৩ সালে এনগেজমেন্ট; আর পরের বছর বিয়ে। ততদিনে অলিম্পিক কাফেলা পৌঁছে গেছে গ্রিসে। এই মিলনও ব্যতিক্রমীÑ নীল আর লাল রক্তের। নিজের ৪০তম জন্মবার্ষিকীতে প্রকাশিত বইতে ডেনমার্কের ভবিষ্যৎ স¤্রাট মেরির সঙ্গে হঠাৎ দেখায় হৃদয় উদ্বেল হওয়ার কথা অকপটে লিখেছেন। সঙ্গত কারণেই অলিম্পিককে ওদের ভোলা সম্ভব নয়। তাই স্বর্ণালি স্মৃতির রোমন্থনে প্রতি চার বছর ঠিকই হাজির হয়ে যান। এই যেমন এবারো উপস্থিত হয়েছেন রিওতে।
গল্পের নটে গাছটি মুড়োনোর সময় হলো। শেষ করব এক অব্যক্ত প্রেমকাহিনী দিয়ে। অকুস্থল রোম। ১৯৬০ সাল। বক্সিং লাইট হেভিওয়েট ক্যাটাগরিতে স্বর্ণজয়ী আমেরিকার আঠারো বছরের দুরন্ত কিশোর ক্যাসিয়াস ক্লে। যাকে সারাবিশ্ব পরে চিনেছে মোহাম্মদ আলী হিসেবে। সেই রোমেই দ্রুততম মানবী হয়ে মাত করেন তার স্বদেশি উইলমা রুডলফ। কেবল রোমের ট্র্যাক নয়, ক্যাসিয়াসের হৃদয়কেও উথাল-পাথাল করে দেন তিনি। কিন্তু হায়! লাজুক ক্যাসিয়াসের পক্ষে সেদিন কিংবা কখনই বলা হয়ে ওঠেনি সে কথা। থেকে যায় অধরা মাধুরী হয়ে। উইলমা মারা যান ১৯৯৪ সালে। আর মোহাম্মদ আলী এ বছর। কে বলতে পারে, মহাকালের মহাবাসরেই হয়তো সম্পন্ন হবে পৃথিবীর দুই কিংবদন্তির মহামিলন।
ছবি : সংগ্রহ
Comments