এ যেন এক চলমান আন্দোলন

উদ্যোক্তা, টাঙ্গাইল শাড়ী কুটির

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লা শহরে। পরীক্ষা শেষ হলেই আমাদের সব ভাইবোনকে আব্বা গাড়ি ভরে দিয়ে আসতেন  চৌদ্দগ্রামে, দাদীর কাছে। আম্মা খুব আপত্তি করতেন এভাবে দলেবলে বাড়ি যাওয়া নিয়ে। তখন বুঝতাম না কেন। এখন বুঝি। কতবার পুকুরে ডুবতে ডুবতে বেঁচে গেছি। কিন্তু গ্রাম সবসময়ই টানত। তার ওপর দাদীর প্রচ- পক্ষপাতিত্ব ছিল আমাদের ব্যাপারে। ওটা বেশ উপভোগ করতাম।
এই ক’টা দিন শেষেই আবার শহরে ফেরা। পড়তাম ফরিদা বিদ্যায়তনে। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করলাম সায়েন্স থেকে, হতে চেয়েছিলাম ডাক্তার। কিন্তু কলেজে যাওয়ার পরেই আর সেটা হতে দেননি আম্মা। উইমেন্স কলেজে যে যে সাবজেক্ট ছিল, সেটাই পড়তে হবে। ডাক্তার হওয়ার জন্য অন্য কলেজে যাওয়ার অনুমতি পাইনি। তবে ছোটবেলায় কচিকাঁচায় যেতাম, গার্লস গাইড করতাম। কোথাও বন্যা হলে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ডাব্বা ভরে খাবার সংগ্রহ করতে বের হতাম আমরা দলেবলে। ছোটবেলার এই স্মৃতিগুলো খুব মনে পড়ে।


বিএ পাস করি বিয়ে হওয়ার পরে। স্বামী ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, খুবই উদারমনের মানুষ ছিলেন। তার আগ্রহেই ইউএনডিপি আইএলও’র একটা ট্রাভেল এজেন্সির ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করি। ভয়েজার ট্রাভেলস নামে নিজেই একটা ট্রাভেল এজেন্সি শুরু করি ১৯৮১ সালে। কিন্তু কাজটা আমার ভালো লাগত না। তখন মানুষ অত বাইরেও যেত না। একঘেয়েমি কাটাতেই একদিন টাঙ্গাইল ঘুরতে যাওয়া, ছোটবোনের শ্বশুর বাড়িতে। ঘুরতে ঘুরতেই দেখি একদিন পাত্রাইল গ্রাম, ওখানে প্রথম তাঁতিদের কাজ দেখি। খুবই সম্ভাবনাময় একটা শিল্প, কিন্তু ওদের বানানো শাড়ি ঠিক শহুরে নারীদের উপযোগী ছিল না। প্রচুর রঙ, হিজিবিজি নকশা আর সাড়ে দশ হাতের খাটো খাটো শাড়ি। তখনই বুদ্ধিটা মাথায় আসে। নিজেই রঙ আর ডিজাইন পছন্দ করে দিয়ে কিছু শাড়ি বানাতে দিলাম। একটা অতিরিক্ত শাড়ি কেটে, জুড়ে লম্বায় বাড়ানো হলো। বাসায় নিয়ে এলাম, আত্মীয়-স্বজনরা দেখল আর খুবই পছন্দ করল শাড়িগুলো।


তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এ নিয়েই কাজ করব। স্বামীকে জানালাম, ভয়েজার বন্ধ করে এ নিয়েই কাজ করতে চাই। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি পারব। মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতেই দোকানিরা কাপড় নিয়ে আসতেন। আম্মাকে কাপড় পছন্দ করে দিতাম আমি। ছোট ছিলাম, এদিক-ওদিক খেলছি, কাপড়ওয়ালা এলেই আম্মা ডাকতেন। আমার পছন্দের ওপরে ভীষণ ভরসা ছিল তার। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতাম ভালো, রঙের কাজও ধরতে পারতাম। স্কুলে সব সময়ই পেইন্টিংয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেতাম। সম্ভবত সেই অভ্যাসটাই আমাকে রঙ আর ডিজাইন বুঝতে সাহায্য করেছিল।


এভাবেই ১৯৮২ সালে টাঙ্গাইল শাড়ী কুটিরের যাত্রা শুরু। ছোট্ট একটা ছাপড়া দোকানে। ৩০ হাজার টাকার মূলধন দিলেন আমার হাজব্যান্ড, তিনজন তাঁতির সঙ্গে চুক্তি করে ৩২টি শাড়ি নিয়ে প্রথম শো-রুম। কোনোরকমে একটা সাইনবোর্ড। সবকিছু টাঙ্গাইল কেন্দ্রিক বলে নাম রাখা হলো টাঙ্গাইল শাড়ী কুটির। আসবাব বলতে ছিল শুধু একটা রোলার আর কিছু হ্যাঙ্গার। শান্তিনগর থেকে একটা কাঠের মিস্ত্রি ডেকে এমন একটা ক্রস করালাম যেটাতে শাড়ি পরিয়ে দেখানো যায়। আমার মেয়েটা ভিকারুন্নেসায় পড়ত বলে চলে এসেছিলাম বেইলি রোডের এদিকটায়। ততদিন আবার আমার ছোট ছেলেটাও স্কুলে ভর্তি হয়েছে। প্রতিদিন স্কুলে মা গিয়ে না আনলে অসম্ভব মন খারাপ করে থাকত। তাই তাকেও আনতে যেতে হতো। সংসার, সন্তান আর দোকানের ব্যস্ততা, সবই সামলাতে হয়েছে সমানতালে।


কিন্তু ক্রেতার পছন্দে ভাটা পড়েনি কোনোদিন। মহিলারা প্রচুর কিনতে আসতেন টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। এরই মাঝে একদিন এক বিপদ হলো। রাতের বেলা এক ট্রাকের ড্রাইভার ট্রাক থামিয়ে দোকানের সবগুলো জামদানি শাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। মনে আছে, মাঝরাতে খবরটা শুনেই আলুথালু হয়ে দৌড়ে চলে এসেছিলাম দোকানে। পরে সেই ড্রাইভার ধরা পড়ে টঙ্গীর কাছাকাছি এক জায়গায়। লোকটা কারণ হিসেবে বলেছিল এই শাড়িগুলো সে ভারতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তাও কি না নির্বাচন করবে বলে। ওই ঘটনা মনে করে আমি এখনো হাসি। এরপরেই আমরা পাকা দালানের শো-রুমে উঠে যাই। এমন আরো অনেক ঘটনা জড়িয়ে আছে টাঙ্গাইল শাড়ী কুটিরে। মনে পড়ে, রওশন এরশাদ আসতেন, কালে কালে আশা ভোঁসলে, শাবানা আজমি, ফারুক শেখ এমনকি  রবিশঙ্করও এসেছিলেন আমার ছোট্ট দোকানটায়। বিচিত্রায় সেরা শাড়ির ক্যাটাগরিতে চিকন সোনালি পাড়ের লাল-কালো একটা শাড়ি পুরস্কার পেয়েছিল। সেই শাড়ি নিয়ে মহিলাদের কাড়াকাড়ি মনে পড়লে এখনো ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে টাঙ্গাইল থেকে ফেরার একরাতের কথা। গিয়েছিলাম শাড়ি আনতে। পথে গাড়িতে ব্যাটারির সমস্যা হলো। হেডলাইট জ্বালালে গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। অতএব লাইট বন্ধ করেই গাড়ি চালালাম আমরা। চাঁদনী রাত। চলতে চলতে একটি মোড়ে এসে থেমে গেলাম। দেখলাম, হাজার হাজার জোনাকি পোকা। রাতের কালো চাদরে তারা ফুটিয়ে জ্বলছে আর নিভছে। বিস্ময়ের একটি শব্দ প্রকাশের শক্তিও ছিল না সেদিন।
তিন দশকেরও বেশি সময়ে পরিস্থিতির যে কতখানি পরিবর্তন হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। আমার এই প্রয়াস দেশি শাড়িকে স্বমহিমায় ফেরানোর আন্দোলন বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। আর এই উদ্যোগে নিজেকে সক্রিয় একজন সদস্য ভেবে থাকি। ফলে শাড়িবিষয়ক ভাবনা থেকে নিজেকে আজো বিমুক্ত করতে পারিনি। সম্ভবও নয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়নের প্রভাবে মহিলাদের বিকল্পধারার পোশাকের প্রতি আকর্ষণ যৌক্তিক ও স্বাভাবিক। এজন্য মোকাবেলা করতে হয়েছে শাড়ির প্রতি ভোক্তাদের বিপ্রতীপ মানসিকতা। সেই প্রতিকূলতাও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে আমার প্রাণপ্রিয় তাঁতিদের অক্লান্ত সহযোগিতায়। আমার স্বপ্ন সাফল্য তথা টাঙ্গাইল শাড়ী কুটিরের আজকের অবস্থানের নেপথ্যে নিঃসন্দেহে রয়েছে আমার স্বামীর প্রেরণা। তবে দীর্ঘসময়ের উৎসাহদাতা ক্রেতাদের সাহচর্য, পৃষ্ঠপোষকতাকেইবা অস্বীকার করি কীভাবে! তাদের ভালোবাসা আর ক্রমাগত পৃষ্ঠপোষকতায় বেইলি রোড ছেড়ে নগরীর নানা জায়গায় শাখা ছড়াতে হয়েছে। এক সময় তাদেরকে আরো আন্তরিক সেবা নিশ্চিত করতে বেইলি রোডেই শুরু করি ‘বৈঠকখানা’।
এভাবেই নানা রঙের স্মৃতি জড়িয়ে আছে টাঙ্গাইল শাড়ী কুটিরের সঙ্গে। সততার কিছু অসম্ভব নিদর্শন দেখেছি আমার সঙ্গে কাজ করা তাঁতিদের মাঝে। যেগুলো এখনো আশা জাগায়। প্রতিদিন নতুন কিছু করার ইচ্ছা জাগিয়ে রাখে মনে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at Secretariat building no 7

A fire broke out at the Secretariat building number 7 in the capital's Segunbagicha area early today. ..At least 11 firefighting units are working to control the fire. ..According to Prothom ALo, fire service received information about the fire at 1:52am. Firefighters arr

4h ago