'সেই মানুষের কী-ই বা দাম, যার কোনো স্বদেশভূমি নেই'

শরণার্থী মানুষের আত্মপরিচয়ের সংকটকে নিজের ও স্বজাতির প্রত্যেকের মধ্য দিয়ে প্রতীকায়িত করা ফিলিস্তিনের চিরনির্বাসিত কবি মাহমুদ দারবিশ লিখেছিলেন, 'সেই মানুষের কী-ই বা দাম–/যার কোনো স্বদেশভূমি নেই,/নেই কোনো পতাকা/কোনো ঠিকানা-/এরকম মানুষের কী দাম, বলো?'
মৃত্যুর আগে ২৫ বছরের নির্বাসিত জীবনে বিভিন্ন সময়ে দারবিশ ছিলেন মস্কো, কায়রো, বৈরুত, তিউনিস ও প্যারিসের মতো শহরে। তারপরেও তার উপলব্ধি ছিল, 'আমি না আছি এখানে, না আছি সেখানে।'
আর ফিলিস্তিনিরা কীভাবে শরণার্থী নামটি পেল তার একটি জবাবও পাওয়া যায় দারবিশের কবিতায়—'তার মুখমণ্ডল শেকলে বেঁধেছিল ওরা/দুই হাতে বাঁধা ছিল মৃত্যুর পাথর।/তুমি খুনি, এই বলে ওরা কেড়ে নিল/তার রুটি, জামা আর ব্যানার।/মৃত্যুর কূপের ভেতর ছুড়ে দেওয়া হলো তাকে।/ওরা বলল, তুমি আসলে চোর,/আর তাকে নিক্ষিপ্ত করা হলো/সমস্ত বন্দরের বাইরে।/তরুণী প্রেমিকাকেও নিয়ে গেল ওরা।/অবশেষে ওরা বলল/তুমি একজন শরণার্থী।'

এই ২০২৫ সালে পৌঁছেও মানব অস্তিত্বের যে ট্র্যাজেডি ফিলিস্তিনিদের ভোগ করতে হচ্ছে, পৃথিবীর আরও অনেক মানুষের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) বার্ষিক প্রতিবেদন 'গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্ট'ও বলছে, বিশ্বে গত এক দশকে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এর মূল কারণ যুদ্ধ, সহিংসতা ও নিপীড়ন। এর বিপরীতে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তার তহবিলও দ্রুত কমছে।
ওই রিপোর্টের তথ্য অনুসারে, বিশ্বের প্রতি ৬৭ জন মানুষের ভেতর একজন বাস্তুচ্যুত।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ২০ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এবার এই দিবসে জোর দেওয়া হয়েছে শরণার্থীদের প্রতি সংহতির ওপর।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইউএনএইচসিআর বলছে—সংহতি মানে কেবল কথায় নয়, কাজের মাধ্যমেও শরণার্থীদের সম্মান জানানো। এর অর্থ হলো তাদের কথা শোনা এবং তাদের গল্পগুলো বলার সুযোগ করে দেওয়া। তাদের নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকারকে রক্ষা করা এবং দুর্দশার সমাধান খুঁজে বের করা। আর যাতে তারা নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে সেজন্য সংঘাতের অবসান ঘটানো। সেইসঙ্গে এটাও স্পষ্ট ও সাহসের সঙ্গে বলা যে, শরণার্থীরা একা নয় এবং আমরা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব না।

২০০১ সালের ২০ জুন প্রথম বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালিত হয়। ২০০০ সালের ডিসেম্বরের আগে দিবসটি আফ্রিকা শরণার্থী দিবস হিসেবে পালিত হতো। ১৯৫১ সালে শরণার্থীদের স্বীকৃতির বিষয়ে জাতিসংঘের সনদটি গৃহীত হয়।
ইউএনএইচসিআর'র 'গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্ট' অনুসারে—চলতি বছরের এপ্রিলের শেষ নাগাদ বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা পৌঁছেছে ১২ কোটি ২১ লাখে। গত বছর একই সময়ে যা ছিল ১২ কোটি। এই বাস্তুচ্যুতির প্রধান কারণ হলো সুদান, মিয়ানমার ও ইউক্রেনের মতো বড় সংঘাত এবং যুদ্ধ থামাতে ধারাবাহিক ব্যর্থতা।
এতে আরও বলা হয়েছে—বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের মধ্যে নিজ দেশের অভ্যন্তরে সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ৬৩ লাখ বেড়ে সাত কোটি ৩৫ লাখে দাঁড়িয়েছে। আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে শরণার্থী হয়েছে চার কোটি ২৭ লাখ মানুষ।
জাতিসংঘের হিসাবে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ আছে সুদানে। দেশটিতে শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৪৩ লাখ। এর আগে এক কোটি ৩৫ লাখ মানুষ নিয়ে এ অবস্থানে ছিল সিরিয়া। এরপরের অবস্থানে আছে আফগানিস্তান। সেখানে বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থীদের সংখ্যা এক কোটি তিন লাখ। তারপরের অবস্থানে থাকা ইউক্রেনে এই সংখ্যা ৮৮ লাখ।
বিষয়টি নিয়ে গত ১২ জুন জেনেভা থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, 'আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক তীব্র অস্থিরতার সময়ে বাস করছি; যেখানে আধুনিক যুদ্ধবিগ্রহ এক ভঙ্গুর, মর্মন্তুদ পরিস্থিতি তৈরি করেছে—তীব্র মানবিক দুর্ভোগ যার সাক্ষ্য দেয়।'
এ পর্যায়ে শরণার্থী ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য শান্তি ও টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে সবার প্রচেষ্টা আরও জোরদার করার তাগিদ দেন ফিলিপ্পো গ্রান্ডি।
'গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্ট'র তথ্য বলছে—শরণার্থীরা বেশি আশ্রয় নেন ধনী অঞ্চলে। প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রয় নেন ৬৭ শতাংশ শরণার্থী। বিশ্বজুড়ে ৭৩ শতাংশ শরণার্থী এই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেই আছেন। আর বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে ৬০ শতাংশ নিজ দেশেই থেকে যান।
কমেছে মানবিক সহায়তা

ইউএনএইচসিআর বলছে, গত এক দশকে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হলেও তাদের তহবিল এখনো ২০১৫ সালের সমানই থেকে গেছে। মানবিক সহায়তায় চলমান কঠোর কাটছাঁটের কারণে শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুতরা আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়েছেন।
বাংলাদেশেও তহবিল সংকটের কারণে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু খাদ্যসহায়তা সাড়ে ১২ ডলার থেকে ছয় ডলারে কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিল জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।
এরপর ১৪ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেন। এ সময় তার কাছে তুলে ধরা হয় ছয় ডলারে একজন আসলে কী পরিমাণ খাবার পাবেন। এ সংক্রান্ত এক ভিডিওতে গুতেরেসকে বিষ্ময় প্রকাশ করতেও দেখা যায়।
পরে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় আশ্রয়শিবিরে স্বস্তি ফেরে।
তহবিল নিয়ে শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, 'তহবিল কাটছাঁটের এমন পরিস্থিতির মধ্যেও গত ছয় মাসে আশার আলো দেখেছি। সিরিয়ার প্রায় ২০ লাখ মানুষ এক দশকের বেশি সময় বাস্তুচ্যুত থাকার পর দেশে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন।'
এক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার মতো আরও একটি তথ্যের কথাও জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। বলছে, ২০২৪ সালে মোট ৯৮ লাখ জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত মানুষ দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে ১৬ লাখ শরণার্থী। এই সংখ্যা গত দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ।

তবে এ প্রত্যাবর্তনের অনেকগুলোই প্রতিকূল রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা পরিস্থিতির মধ্যে ঘটেছে বলে জানায় শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন। বলা হয়, ২০২৪ সালে বিপুলসংখ্যক আফগানকে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় আফগানিস্তানে ফিরতে বাধ্য করা হয়েছিল। এছাড়া গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, মিয়ানমার ও দক্ষিণ সুদানের মতো দেশগুলোতে শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতরা নিজ দেশে ফিরে গেলেও নতুন করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির ঘটনাও ঘটেছে।
এক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক মাহমুদ দারবিশ। এক কবিতায় তিনি লেখেন, 'এই যে আমরা হেঁটে যাই বোমার ভেতর দিয়ে/এতে কী তুমি মৃত্যুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ?/আমার তো এখনো জীবনের অভিলাষ আছে,/আর আছে অনিঃশেষ বাসনা/মৃতদের চেন কি তুমি?/আমি তাদের চিনেছি আর/তা কেবল ভালোবাসার মধ্য দিয়ে।'
এবারের শরণার্থী দিবসে বাস্তুচ্যুতদের প্রতি সংহতি জানানোর যে আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর, এর অর্থ হয়তো এই ভালোবাসাই।
Comments