ঈদের সন্ধ্যায় পঙ্গু হাসপাতাল: জরুরি বিভাগে উপচে পড়া ভিড়, রোগীদের দীর্ঘ অপেক্ষা

পঙ্গু হাসপাতাল
ছবি: শাহীন মোল্লা

ঈদের দিন বিকেল ৪টার দিকে ডান হাতে মারাত্মক আঘাত পান মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা সুফিয়া বেগম (৫৫)। নিজ বাড়ির কাছে হেঁটে সড়ক পার হওয়ার সময় একটি দ্রুতগামী মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা দেয়।

আহত সুফিয়াকে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও ঈদের ছুটির কারণে সেখানে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। সেখান থেকে সুফিয়াকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে যেতে বলা হয়।

এক হাজার শয্যার এই পঙ্গু হাসপাতালে দেশের সব জায়গা থেকেই রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ২৫০ এবং বহির্বিভাগে এক হাজার রোগী একইসঙ্গে চিকিৎসা নিতে পারেন। পাশাপাশি, হাসপাতালের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন সেখানে ১০০টিরও বেশি জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়।

সুফিয়াকে পঙ্গু হাসপাতালেই নিয়ে যান তার পরিবারের সদস্যরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদকের সঙ্গে হাসপাতালে সুফিয়ার দেখা হয়। সে সময় তিনি জনাকীর্ণ জরুরি বিভাগে স্ট্রেচারে শুয়ে ছিলেন।

সেখানে নয়টি শয্যা ছিল। তবে শয্যার তুলনায় সেখানে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। অনেকেই স্ট্রেচারে শুয়ে ছিলেন বা চেয়ারে বসে ছিলেন। কাউকে কাউকে শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়েও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

সুফিয়ার মেয়েজামাই মো. হাসান বলেন, 'আমরা আধঘণ্টা আগে টোকেন জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো চিকিৎসক তাকে দেখতে আসেননি'। সেই সময় ব্যথায় কেঁদে ওঠেন সুফিয়া।

আরও কিছু সময় পর একজন চিকিৎসক তাকে দেখতে আসেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এরপর টোকেনের সিরিয়াল অনুযায়ী ওই চিকিৎসক আরও বেশ কয়েকজন রোগীকে দেখেন।

চিকিৎসকদের কক্ষের বাইরে থেকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক দেখতে পান, চারজন চিকিৎসক নিরবচ্ছিন্নভাবে রোগীদের এক্স-রে ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার নথি দেখছেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্র লিখছেন। ওয়ার্ড বয়দের সহায়তায় নার্সরা রোগীদের ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিলেন। রোগীদের অনেকেই ব্যথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন।

রিসিপশনে থাকা এক নার্স জানান, শুক্রবার দিনগত রাত ১২টার পর থেকে শুরু করে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার মধ্যে ২৫০ জনেরও বেশি রোগী জরুরি ওয়ার্ডে এসেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্মীদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দেয় না বিধায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, 'সংখ্যাটি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।'

চিকিৎসকের কক্ষে ঝুলিয়ে রাখা ২০২৪ সালের দুইটি নোটিশে বলা হয়েছে, শুধু হাসপাতাল পরিচালকের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার এখতিয়ার রয়েছে।

ওই নার্স বলেন, 'সড়ক দুর্ঘটনা ও কোরবানির পশু কাটার সময় আঘাত পেয়েই বেশিরভাগ রোগী এসেছেন।'

আধঘণ্টার মধ্যে সেখানে আরও চার-পাঁচজন রোগী আসেন।

অপর এক নার্স জানান, ওই শিফটে জরুরি বিভাগে চারজন ডাক্তার, পাঁচ নার্স ও পাঁচ ওয়ার্ড বয় কাজ করছিলেন।

জরুরি বিভাগের বাইরে হাসপাতালের অন্যান্য অংশ তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম ছিল।

রোগীদের দুইটি ওয়ার্ডে গিয়ে বেশ কয়েকটি খালি শয্যা দেখা যায়। সেখানে এক নার্স বলেন, ৮৪ শয্যার বিপরীতে ৬৪ জন রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি জানান, এখন শুধু সাত নার্স তিন শিফটে ডিউটি করছেন, যারা মুসলিম নন। স্বাভাবিক সময়ে ওই ওয়ার্ডে ১৯ জন নার্স কাজ করেন।

রাত ৮টার দিকে জরুরি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে ১২-১৫ জনের মতো রোগী দেখা যায়। হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে কেউ কেউ মেঝেতে বসে ছিলেন। সেখানে দায়িত্বরত এক আনসার সদস্য জানান, অপারেশন থিয়েটারে তিনজন ডাক্তার কর্মরত আছেন। একটিমাত্র অপারেশন থিয়েটার কার্যকর রয়েছে।

গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় নিজ বাড়ির কাছে অটোরিকশার ধাক্কায় বাম পায়ে আঘাত পান ফাতেমা বেগম (৫০)। দুপুর ২টার দিকে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। প্রাথমিক পরীক্ষার পর জরুরি ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা তাকে অস্ত্রোপচারের জন্য পাঠান।

ফাতেমার ভাগ্নে আবদুল হান্নান রাত ৮টার দিকে বলেন, 'আমরা চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তার অপারেশনের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু এখনো আমাদের ডাকা হয়নি।'

তবে ওই আনসার সদস্য দাবি করেন, ফাতেমারা খুব বেশি হলে এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় আছেন।

অপরদিকে, ওবায়দুল ইসলাম (২৫) জানান, তিনি তার অপারেশনের জন্য প্রায় নয় ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন। ঢাকার গ্রিন রোডের বাসিন্দা ওবায়দুল জানান, গরুর ধাক্কা খেয়ে তার ডান হাতে ফ্র্যাকচার হওয়ার পর সকাল ১১টার দিকে তিনি হাসপাতালে আসেন।

হাসপাতালের ওটি কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে ওবায়দুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চিকিৎসকরা বলেছেন, আমার আঘাত অতটা গুরুতর নয়। এ কারণে এখনো আমাকে ডাকা হয়নি।'

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কেনানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সাধারণত ঈদের ছুটিতে রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে।

কেন এই রোগীর সংখ্যা বাড়ে, তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি। তবে হাসপাতালের কর্মীরা জানান, ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। ফলে রোগীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। পাশাপাশি, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে ছুটির সময়ে পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় অনেকেই রেফার্ড হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে আসেন।

অধ্যাপক কেনান বলেন, স্বাভাবিক সময়ে জরুরি ওয়ার্ডে দৈনিক ২৫০ রোগী চিকিৎসা নেন। তবে ঈদের ছুটিতে এই সংখ্যা বেড়ে ৩০০ হয়। বৃহস্পতিবার থেকে এ বছরের ঈদুল আজহার ১০ দিনের সরকারি ছুটি শুরু হয়েছে।

তিনি জানান, এই ছুটিতে জরুরি বিভাগে তিন শিফটে ৪৫ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন, যার মধ্যে অপারেশন থিয়েটারগুলোও অন্তর্ভুক্ত। তবে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদকরা জরুরি ওয়ার্ডে মাত্র চারজন চিকিৎসককে দেখতে পান। ওই আনসার সদস্য জানান, ওটির ভেতরে আরও তিনজন চিকিৎসক রয়েছেন।

আনসার সদস্য জানান, মাত্র একটি ওটি চালু রয়েছে। তবে অধ্যাপক কেনানের দাবি, তিনটি অপারেশন থিয়েটারের ছয়টি শয্যা প্রস্তুত রয়েছে।

গতকাল রাতে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আপনারা যখন হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন, তখন সম্ভবত অন্য চিকিৎসকরা বিশ্রামে ছিলেন।'

তিনি আরও বলেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কম। আমরা জরুরি সেবা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। অপারেশন থিয়েটারগুলো ২৪ ঘণ্টাই প্রস্তুত রাখা আছে।

Comments

The Daily Star  | English

Rain likely over four divisions

Weather may remain mainly dry with temporary partly cloudy sky elsewhere over the country, according to a Met Office bulletin in Dhaka.

1h ago