গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কি উপেক্ষিত রয়ে গেছে?

মাহফুজ আনাম, মতামত, নির্বাচন, প্রধান উপদেষ্টা, বিচার বিভাগ, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস,

সৎ ও যোগ্য নেতাকে ভোট দেওয়া গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। দার্শনিক প্লেটো একসময় সতর্ক করে দিয়েছিলেন, যদি জনগণ অজ্ঞ থাকে, তাহলে গণতন্ত্র হয়ে ওঠে ভয়ংকর।

দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এখনও মাত্র এক হাজার টাকায় ভোট বিক্রি হয়। একজন সাধারণ ভোটার যদি জানতেন, তার ভোটের প্রকৃত বাজারমূল্য কত, তাহলে তিনি এত সস্তা দামে এটি বিক্রি করতেন না। ভোট কোনো নিছক প্রতীক নয়—এটি নাগরিক ও সরকারের মাঝে একটি সামাজিক চুক্তি। নির্বাচিত সরকার নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুশাসন প্রদান করবে—এই শর্তে এই চুক্তি হয়।

সমাজের প্রান্তিক কেউ—যেমন: একজন ভূমিহীন কৃষক—তার ভোটের আর্থিক মূল্য কত হতে পারে? এটি অনুমান করা যায় একটি চিন্তানির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে। যদি তিনি তার ভোট বিক্রি করে দেন, তবে কী কী ন্যায্য নাগরিক সুবিধা থেকে তিনি বঞ্চিত হতে পারেন? যেমন: সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা, কারখানায় ন্যায্য মজুরি, সন্তানের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, উৎপাদিত ফসলের সঠিক মূল্য এবং বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার। পাঁচ বছরের এক নির্বাচনী মেয়াদে এসব সুবিধার আর্থিক মূল্য হিসাব করলে তা কয়েক লাখ টাকারও বেশি হতে পারে। অথচ আমাদের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে কত অল্প মূল্যে এই মূল্যবান অধিকারটি বিক্রি হয়ে যায়!

অনেকে মনে করেন, শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়—এই ধারণা আংশিকভাবে সত্য। প্রকৃতপক্ষে, গণতন্ত্রের মর্মার্থ ভিন্ন। যখন মানুষ ক্ষণিকের লাভ, টাকার লোভ, ভবিষ্যতে সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশা, কিংবা এলাকার কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি, আত্মীয় বা পরিচিতজনের প্রভাবের কারণে ভোট দেয়, তখন সেই ভোট আর নাগরিক অধিকার বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রতিফলন থাকে না।

বাংলাদেশের আরেকটি সংকট হলো 'পৃষ্ঠপোষক-নির্ভর' নেতৃত্বের সংস্কৃতি। এখানে সচরাচর মেধা, সততা বা দক্ষতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব গড়ে ওঠে না; বরং পারিবারিক পরিচিতি, ঘনিষ্ঠতা অথবা দলীয় আনুগত্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই ধারা বারবার দুর্নীতিপরায়ণ, অযোগ্য ও দায়মুক্ত নেতৃত্বকেই প্রতিষ্ঠা করে, যার চরম মূল্য দিতে হয় সেই প্রান্তিক ও সাধারণ ভোটারদেরই।

কোনো সমাজে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হওয়া উচিত আপামর জনগণকে নাগরিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে। তা না হলে সেটি হবে ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া দেওয়ার মতো। জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব যাদের—রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, শিক্ষক ও সামাজিক সংগঠক—তাদের কেউই এই কাজটি গুরুত্ব সহকারে করেননি। অথচ স্বাধীনতার পর ৫৪ বছর পার হয়ে গেছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছেন, এবার তারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নির্বাচন উপহার দেবে। হয়তো দেবে—কিন্তু গণতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি, অর্থাৎ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়ে সরকার আদৌ কিছু করেছে কি? জনগণ যদি তাদের ভোটের প্রকৃত মূল্য বুঝতে না শেখে, তাহলে যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ভবিষ্যতে টিকে থাকার সম্ভাবনা আমি দেখি না।

এ কথা সত্য, একটি দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা একটি অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি ও বৃহৎ কাজ—যা কোনো সরকারের পক্ষেই স্বল্পমেয়াদে একা সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে একটি ব্যাপকভিত্তিক 'ভোটার শিক্ষা' কর্মসূচি চালু করতে পারে। প্রথম পর্যায়ে যা শুধুমাত্র দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তার ওপর ভিত্তি করে হতে পারে। সেগুলো হলো—

১. টাকার বিনিময়ে কখনোই ভোট দেওয়া নয়

২. দলান্ধতা বা কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেওয়া মানে 'নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা'

১৯৯৬–৯৭ সালে বাংলাদেশে 'লোকাল ডেমোক্রেসি এডুকেশন প্রোগ্রাম' নামে একটি 'ভোটার শিক্ষা' কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল। ইউএসএইড-এর অর্থায়নে এবং এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাকের সহায়তায় দেশের কয়েকটি এনজিও এই প্রকল্পে অংশ নেয়।

এই কর্মসূচির আওতায় পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ, পথনাট্য, ভোটারদের নিয়ে কর্মশালা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোটের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। ভোটারদের আহ্বান জানানো হয়েছিল—ধর্মান্ধ, চিহ্নিত অপরাধী ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থীদের পরিহার করে তারা যেন যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দেন, দলমত নির্বিশেষে। ড. কামাল সিদ্দিকী ও জামশেদ আহমদের 'লোকাল গভর্নমেন্ট ইন বাংলাদেশ' গ্রন্থে এই কার্যক্রমের বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়।

লোকাল ডেমোক্রেসি এডুকেশন প্রোগ্রামের ফলাফল ছিল অভূতপূর্ব। কর্মসূচির আওতাভুক্ত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের অনেক স্থানে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ভোটার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়; নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় এবং অর্থ ও প্রভাব খাটানোর প্রচলিত প্রবণতা স্পষ্টভাবে হ্রাস পায়।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো—নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশ ছিলেন সৎ ও যোগ্য প্রার্থী। এই নির্বাচনকে এলাকার অনেকেই গণতন্ত্রের ইতিহাসে অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য ও স্মরণীয় নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কর্মসূচির মেয়াদ ছিল এক বছরেরও কম এবং এর কার্যক্রমের বিস্তৃতি ছিল ১২টি জেলায়।

কেনিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতেও একই ধরনের সফলতার উদাহরণ দেখা গেছে, যেখানে নির্বাচন কমিশন ও বিভিন্ন এনজিও ভোটার শিক্ষা কর্মসূচি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করেছে।

এসব উদ্যোগ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সামনে এসেছে। সেগুলো হলো—

১. অরাজনৈতিক নেতৃত্ব বজায় রাখা জনআস্থা তৈরির জন্য অত্যাবশ্যক

২. জটিল একাডেমিক ভাষার পরিবর্তে সহজ ও বোধগম্য ভাষার ব্যবহার অধিক কার্যকর

৩. রেডিও, টেলিভিশন ও এসএমএসের মতো গণমাধ্যমের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের কর্মশালাকে সমন্বয় করলে প্রচারের ব্যাপ্তি সর্বাধিক হয়

লোকাল ডেমোক্রেসি এডুকেশন প্রোগ্রামের সফলতা প্রমাণ করে, পরিকল্পিত ও তৃণমূলে বাস্তবায়িত একটি ভোটার শিক্ষা কর্মসূচি এক বছরেরও কম সময়ের বিস্ময়কর ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে ঠিক এমনই একটি ভোটার শিক্ষা কর্মসূচির নেতৃত্ব দিতে পারে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, মাঠপর্যায়ের সাধারণ প্রশাসন, ভূমি প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ ও সমবায় বিভাগসহ তৃণমূলের বিভিন্ন অবকাঠামো ও সংগঠন ব্যবহার করে ভোটারদের সচেতনতা বৃদ্ধির এই কর্মসূচির ব্যপ্তি হতে পারে সমগ্র বাংলাদেশ।

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ ভোটার শিক্ষা কর্মসূচির প্রতি সমর্থন আশা করা কঠিন। কারণ, ভোটার সচেতন হয়ে উঠলে তাদের প্রচলিত ক্লায়েন্ট-পেট্রন নেতৃত্বের মডেল ভেঙে পরবে। তাই ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের স্বার্থেই এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত, কারণ নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি বা পৃষ্ঠপোষকতা দূর না হওয়া পর্যন্ত এসব দলের নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ—নির্বাচন প্রক্রিয়া যতই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক না কেন।

ছোট দলগুলো তাদের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমের সমন্বয়ের মাধ্যমে ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় তারা শুধু গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে শক্তিশালী করবে না, বরং এটি তাদের জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির একটি কার্যকর কৌশলেও পরিণত হতে পারে।

জনগণ সচেতন হলে দেশে সব দলের জন্য একটি সমতাভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হবে—যা ভবিষ্যতে ছোট দলগুলোর গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ অথবা সংসদে শক্তিশালী প্রতিনিধিত্বের পথ সুগম করতে পারে।

গ্রামীণ পর্যায়ের এনজিওগুলোর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, কারণ এটি ছাড়া তাদের সব ধরনের সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টাই মূলত তেমন কোনো অর্থ বহন করে না। অন্তর্বর্তী সরকার এসব সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় সাধন করে তাদের বিদ্যমান কর্মসূচির সঙ্গে ভোটার শিক্ষাকে একীভূত করার জন্য উৎসাহ দিতে পারে। বহু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাও গণতন্ত্র সম্প্রসারণমূলক প্রকল্পে নিয়মিতভাবে অর্থায়ন করে থাকে।

সরকার যদি এনজিও, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণকে একটি অভিন্ন 'ভোটার শিক্ষা' কর্মসূচির আওতায় একত্রিত করতে পারে, তবে তা গণতন্ত্রের একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তি গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

মনে রাখতে হবে, সচেতন ভোটার যোগ্যতার ভিত্তিতে ভোট প্রদান করে। তাই, একটি নির্বাচিত সরকার যদি জানে যে তাকে পুনর্নির্বাচিত হতে হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে, তাহলে সে জনকল্যাণমুখী সংস্কারে বাধ্য হবে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এভাবেই ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক হয়েছে—ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়ে নয়।


সাইফুর রহমান: জ্যেষ্ঠ তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সার্টিফায়েড প্রফেশনাল অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি

Comments

The Daily Star  | English

NBR officials announce five-day protest, demand chairman’s removal

With this, the demonstration entered its sixth day, hampering trade, business operations and revenue-related activities

5h ago