‘বহুত্ববাদ’ ও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের প্রস্তাবে দলগুলোতে মতভেদ

ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও কিছু সংবেদনশীল প্রশ্নে তাদের মধ্যে এখনো ভিন্নমত রয়ে গেছে।

১৬৬ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে কমিশন সংবিধান, নির্বাচন, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ এবং জনপ্রশাসনের সংস্কার নিয়ে মতামত নিচ্ছে। এসব মতামতের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় জুলাই সনদ তৈরি হবে, যার লক্ষ্য গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

কমিশন এখন পর্যন্ত ২৩টি রাজনৈতিক দল এবং প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে বৈঠক করেছে। যার মধ্যে তিন বড় শক্তি- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)— কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছে।

সংস্কার কমিশনের সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'বহুত্ববাদ' এবং প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা— এই দুটি পদে আলাদা দায়িত্ব রাখা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।

বিএনপি প্রস্তাবনায় 'বহুত্ববাদ' যুক্ত করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এর বদলে তারা ২০১১ সালের আগে যেভাবে ছিল, সেই অনুযায়ী 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস' বাক্যটি ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছে।

জামায়াতও চায় যে সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন' কথাটি থাকুক। এছাড়াও, দলটি 'বহুত্ববাদ' সম্পর্কিত বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত, কারণ তারা বাংলাদেশে ইসলামী মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক গতিশীলতাকে আরও ভালোভাবে প্রতিফলিত করার জন্য 'বহুত্ববাদ' এর পরিবর্তে 'বহুসংস্কৃতিবাদ' অন্তর্ভুক্ত করা পছন্দ করে।

এনসিপিও কমিশনের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত হয়েছে তবে দলটির মত ইংরেজি শব্দ প্লুরালিজমের বাংলা অনুবাদ আরও স্পষ্টভাবে করা উচিত। তারা বলছে এই শব্দটি কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।

জামায়াত এবং এনসিপি প্রধানমন্ত্রী পদের দুই মেয়াদের সীমা নির্ধারণের প্রস্তাবে একমত হয়েছে। তবে বিএনপি বলেছে, টানা দুটি মেয়াদ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকা যেতে পারে, তবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য অন্তত একটি মেয়াদ বিরতি দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ পাঁচ বছর করার পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত। অন্যদিকে, এনসিপি মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে।

আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা যেন একই ব্যক্তি না হন।

বিএনপি এই প্রস্তাবে ভিন্নমত জানিয়েছে, তাদের যুক্তি—বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হওয়া একটি দীর্ঘদিনের প্রচলিত রীতি। দলটির মতে, সংসদ নেতার পদে কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই, তাই এটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।

অন্যদিকে, এনসিপি এই দুটি পদ আলাদা করার পক্ষে মত দিয়েছে। তাদের মতে, এটি সংসদীয় কাঠামোতে আরও বেশি ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।

জামায়াত জানিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের অবস্থান এখনো চূড়ান্ত হয়নি এবং তারা কমিশনের সঙ্গে আরও আলোচনা করবে।

নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ তদারকি করার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত দেখা গেছে।

বিএনপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে এটি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা হ্রাস এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করতে পারে।

অন্যদিকে জামায়াত এই কাউন্সিল গঠনকে সমর্থন জানিয়েছে। তারা মনে করে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিমুক্ত করার জন্য এটি জরুরি।

এনসিপিও এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছে যে প্রতিরক্ষা প্রধানসহ সব সাংবিধানিক পদে নিয়োগ যেন কাউন্সিলের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

তিন দলের মধ্যে ঐকমত্যের একটি প্রধান বিষয় হচ্ছে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তন।

সব দল এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। তাদের মতে, একটি উচ্চকক্ষ থাকলে দেশের বিভিন্ন এলাকা ও পেশার মানুষ বেশি সুযোগ পাবে। এতে আইন তৈরির ক্ষমতা এক জায়গায় জমা না হয়ে ভাগ হয়ে যাবে।

তবে বিএনপি একটি ব্যাপারে কমিশনের সঙ্গে একমত হয়নি। কমিশন চেয়েছিল উচ্চকক্ষে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধি রাখা হোক। কিন্তু বিএনপি বলেছে, দুটি সংসদ হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত অবশ্যই নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে নিতে হবে।

একইভাবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়টি তিন দলের সর্বসম্মত অনুমোদন পেয়েছে।

তারা একমত হয়েছে যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উপর জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অপরিহার্য।

বিচার বিভাগে সংস্কার বিষয়ে বিএনপি কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছে। কমিশন প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিকে বেছে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেও, বিএনপি বলেছে—এই পদে তিনজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত।

এ ছাড়া, বিএনপি বিচারপতি নিয়োগে একটি 'জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন' গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে তারা বলেছে, এই কমিশনের কাঠামো ও কার্যপরিধি সংসদে আলোচনা করে চূড়ান্ত করতে হবে।

এই বিষয়গুলোতে জামায়াত ও এনসিপি কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গেই একমত পোষণ করেছে।

তবে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব নিয়ে আবারও মতবিরোধ দেখা দেয়। বিএনপি সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সংবিধানের বাইরে গিয়ে বিচার বিভাগে কোনো সংস্কার আনার চেষ্টা করলে তা অবৈধ হবে।

Comments

The Daily Star  | English

FY26 Budget: Subsidy spending to hold steady

The budget for fiscal 2025-26 is likely to be smaller than the current year’s outlay, but subsidy spending is expected to remain almost unchanged at Tk 1,15,741 crore.

9h ago