ত্বকী হত্যার এক যুগ: আজও মেলেনি ন্যায়বিচার

ত্বকী হত্যা
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ছবি: সংগৃহীত

গণঅভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা সরকারের পতনের পর একমাসের ব্যবধানে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলায় ছয়জনের গ্রেপ্তার ন্যায়বিচারের আশা জাগিয়েছিল তার পরিবারে।

কিন্তু, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এই হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ফলে, চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিয়ে পুনরায় তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

ত্বকী হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পরেও ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় পরিবার, বিচারের দাবি নিয়ে রাজপথে নামছে সচেতন সমাজ।

ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার ১২ বছর পূর্তিতে ৬ ও ৭ মার্চ দুইদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট। এর আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিচারের দাবিতে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরের বাসা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় একটি পাঠাগারের সামনে থেকে অপহরণ হন ১৭ বছর বয়সী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। পরদিন তার 'এ' লেভেল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়। যেখানে দেখা যায় ত্বকী পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে সারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ২৯৭ পেয়েছিলেন।

তবে, অসাধারণ এই ফলাফল জানতে পারেনি ত্বকী। ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খাল থেকে অনন্য মেধাবী এই কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ত্বকী হত্যার বর্ষপূর্তির একদিন আগে ২০১৪ সালের ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব জানিয়েছিল, এই হত্যা মামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে পেরেছেন তারা। যেকোনো দিন আদালতে জমা পড়বে অভিযোগপত্র।

কিন্তু গত ১১ বছরেও সেই 'যেকোনো দিন' আর আসেনি।

ত্বকী হত্যায় প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সম্পৃক্ততা থাকায় তাদের বাঁচাতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'নির্দেশে' এই তদন্ত আটকে ছিল বলে বরাবরই অভিযোগ করেছে ত্বকীর পরিবার।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলাটি খানিকটা গতি পায়। র‌্যাব সেপ্টেম্বর জুড়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালিয়ে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে এবং জানায়, তারা সবাই আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠজন।

আজমেরী ওসমান প্রয়াত সংসদ সদস্য একেএম নাসিম ওসমানের ছেলে ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ভাতিজা।

গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনের মধ্যে আজমেরীর সহযোগী কাজল হাওলাদার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আজমেরীর গাড়িচালক মো. জামশেদ, আত্মীয় আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে জামাই মামুন, সহযোগী শাফায়েত হোসেন শিপন, মামুন মিয়া ও ইয়ার মোহাম্মদ রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পর কারাগারে আছেন।

সেপ্টেম্বরে মামলাটির অগ্রগতি নিয়ে আলাপকালে তৎকালীন র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা বলেছিলেন, 'প্রচ্ছন্ন চাপে' অনেক বছর আটকে থাকলেও তারা এখন মামলাটির তদন্ত দ্রুত শেষ করতে চান। তিন মাসের মধ্যে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি।

গত ২ মার্চ এই হত্যা মামলার নথিপত্র ৮১ বারের মতো আদালতে উঠেছে, কিন্তু অভিযোগপত্র জমা পড়েনি।

ইতোমধ্যে তদন্তকারী সংস্থাটির অধিনায়ক এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুজনই বদলি হয়েছেন।

র‌্যাবের বর্তমান অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, 'মামলাটি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি। তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। মামলার বাদী ত্বকীর বাবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে, তিনিও আমাদের সহযোগিতা করছেন। ৫ আগস্টের পর এ মামলায় আমরা ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমাদের চেষ্টা থাকবে অতিসত্বর তদন্ত শেষ করার। তদন্ত শেষ হলে প্রতিবেদন জমা দিয়ে দিবো।'

ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে এখনও আশাবাদী ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'এক বছরের মাথায় র‌্যাবের তদন্তে সব বেরিয়ে এসেছিল। ওসমান পরিবারের টর্চার সেলে ত্বকীকে কীভাবে হত্যা করে শীতলক্ষ্যায় লাশ ফেলা হলো, সবই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল র‌্যাব। কিন্তু যখনই শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেন, তখনই এই মামলার সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।'

তিনি বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এই মামলায় ছয়জন গ্রেপ্তার হয়েছেন, একজন আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে। মামলাটা এগোচ্ছে, আশা করি দ্রুতই শেষ হবে। তবে, দায়সারা নয়, দোষী সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে নির্ভুল অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিতে হবে। প্রয়োজনে সময় নিক। এতদিন যেহেতু অপেক্ষা করা গেছে, আরও কিছুদিন যাবে।'

২০১৩ সালের ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে মরদেহ উদ্ধারের পর রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন।

ওই বছরের ১৮ মার্চ শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জহিরুল ইসলাম পারভেজ ওরফে ক্যাঙারু পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমানসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৮-১০ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ সুপারের কাছে সম্পূরক অভিযোগ জমা দেন।

পরে রফিউর রাব্বির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছরের ২০ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলাটি র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করে।

ত্বকী হত্যার কয়েকমাসের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর, তায়েবউদ্দিন জ্যাকি, রিফাত বিন ওসমান ও সালেহ রহমান সীমান্ত। সবাই পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর লিটন এবং ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনা থেকে হত্যা পর্যন্ত সব ঘটনার বিবরণও দিয়েছিলেন।

ত্বকীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর কয়েক দিন আগে র‌্যাব জানিয়েছিল, তারা হত্যার রহস্য ভেদ করেছে এবং এমনকি একটি খসড়া তদন্ত প্রতিবেদনও তৈরি করেছে। ২০১৪ সালের মার্চে আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা র‌্যাবের খসড়া তদন্ত প্রতিবেদন গণমাধ্যমে ফাঁস হয়।

ত্বকীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর একদিন আগে, র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান গণমাধ্যমে বলেছিলেন, তাদের কাছে ১১ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে এবং এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র যেকোন দিন আদালতে জমা দেওয়া হবে।

এরপর ওই বছরের জুনে সংসদে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'ওসমান পরিবারের পাশে' থাকার ঘোষণা দিয়ে বক্তব্য রাখলে ত্বকী হত্যা মামলার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

র‌্যাবের ফাঁস হওয়া তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ত্বকী হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সরাসরি হত্যাকাণ্ডেও অংশ নিয়েছিলেন আজমেরী। তার নির্দেশে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ তার সহযোগীরা ত্বকীকে অপহরণ করে শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে উইনার ফ্যাশনের 'টর্চার সেলে' নিয়ে যায়।

ওই রাতেই আজমেরী ও তার সহযোগীরা ত্বকীকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর ত্বকীর মরদেহ বস্তায় ভরে আজমেরীর গাড়িতে করে চারারগোপ এলাকায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে রাত ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে নৌকায় করে মরদেহ নিয়ে কুমুদিনী জোড়াখাল এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়।

পরদিন ৮ মার্চ নদী থেকে ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

র‌্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে রফিউর রাব্বি তার সমর্থকদের নিয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালায়। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারেন শামীম ওসমান।

২০১৩ সালের ৭ আগস্ট আজমেরীর 'উইনার ফ্যাশন' অফিসে অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা জিন্স, পিস্তলের বাট ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম জব্দ করে র‌্যাব। দেয়াল, সোফা ও আলমারিতে বেশকিছু গুলির চিহ্নও দেখতে পান র‌্যাব কর্মকর্তারা।

ফাঁস হওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে ত্বকী হত্যায় ১১ জন অভিযুক্তের প্রত্যেকের ভূমিকার কথা সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়।

আজমেরী ছাড়া অন্য অভিযুক্তরা হলেন—ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর, তায়েবউদ্দিন জ্যাকি, রাজীব, কালাম শিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন ও জামশেদ হোসেন।

অভিযুক্ত লিটন, ভ্রমর, জ্যাকি এবং সন্দেহভাজন হিসেবে রিফাত বিন ওসমান ও সালেহ রহমান সীমান্তকে গ্রেপ্তারও করে র‌্যাব। পরবর্তীতে সবাই জামিনে বেরিয়ে আসেন।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই বছরের জুলাই ও নভেম্বর মাসে যথাক্রমে লিটন ও ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনা থেকে হত্যা পর্যন্ত সব ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে ভ্রমর আদালতে জবানবন্দিতে তার দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারেরও আবেদন জানিয়েছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English
gold price hike in Bangladesh

Why gold costs more in Bangladesh than in India, Dubai

According to market data, gold now sells for $1,414 per bhori in Bangladesh, compared to $1,189 in India, $1,137 in Dubai

1h ago