৬ বার বদলানো হয় আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন

আবু সাঈদ
পুলিশের ছোড়া গুলির সামনে দাঁড়ানো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাঈদ। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। গুলি লাগার মুহূর্তে রাজপথে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের ছবি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে মানুষ শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন। আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে।

রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাজিবুল ইসলাম তার প্রাথমিক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন আবু সাঈদ শটগান পেলেটের আঘাতে মারা যান।

কিন্তু বাইরে থেকে চাপ দিয়ে ছয়বার প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয় তাকে। মাথায় আঘাত, বিভিন্ন ক্ষত এবং সাঈদের শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত জমাট বাঁধার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে হয়। উপসংহার হিসেবে বলা হয়, এসব আঘাতের কারণে 'শক' এবং 'রক্তক্ষরণে' আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে।

আবু সাঈদের মৃত্যুর মামলাটি এখন তদন্ত করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। তদন্তকারীরা বলছেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বদলাতে ওই ফরেনসিক চিকিৎসক চার জনের কাছ থেকে চাপ আসার কথা জানিয়েছেন যারা সবাই ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ। এদের মধ্যে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দুজন প্রাক্তন উপকমিশনার, রংপুর মেডিকেল কলেজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগপন্থি ডাক্তারদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) একজন নেতা রয়েছেন।

মামলাটির তদন্তকারীরা বলছেন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পরিবর্তন করার সঙ্গে জড়িত এই চারজন গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন।

আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর পরই মামলাটি প্রভাবিত করার চেষ্টা করে পুলিশ। তাজহাট থানায় দায়ের করা প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) অনুসারে, আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে মারা যাননি। পুলিশের প্রতিবেদনে বিএনপি, জামায়াত-শিবিরসহ দুই-তিন হাজার অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত করা হয়। পুলিশ দাবি করে, বিক্ষোভকারীরা অস্ত্র থেকে গুলি চালায় ও ইটপাটকেল ছোড়ে যাতে 'একজন ব্যক্তি' নিহত হন। এফআইআর-এ বলা হয়েছে, পরে পুলিশ জানতে পারে যে তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ।

সাঈদের সহপাঠীরা তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য পুলিশ ১৬ বছরের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রকেও এই মামলায় অভিযুক্ত করে।

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন উপকমিশনার আবু মারুফ হোসেন প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পরিবর্তন করার জন্য ফরেনসিক চিকিৎসক রাজিবুলকে বলেন। প্রতিবেদনে 'ক্রস চিহ্ন' দিয়ে তিনি তা পুড়িয়ে দিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন দিতে বলেন। নির্দেশ অনুযায়ী নতুন প্রতিবেদন দেন রাজিবুল।

এ ব্যাপারে রাজিবুলের সঙ্গে ফোনে কথা বলা সম্ভব না হলেও তিনি এর আগে ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন যে তিনি ময়নাতদন্তের ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন। মোট ছয়বার প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।

এ ব্যাপারে উপকমিশনার আবু মারুফ হোসেনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার রাজিবুল বলেন, 'তারা আমাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বলেছিল যে আবু সাঈদের মাথায় আঘাতের কারণে মৃত্যু হয়েছে। সেদিন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে প্রথমে মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন আবু সাঈদ।

দ্য ডেইলি স্টার আবু সাঈদের ময়নাতদন্তের দুটি ভিন্ন প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে যাতে রাজিবুলের স্বাক্ষর আছে। একটি প্রতিবেদনে আবু সাঈদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে শটগানের গুলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্য প্রতিবেদনটি দেওয়া হয় আবু সাঈদের মৃত্যুর ১৪ দিন পর ৩০ জুলাই। এই প্রতিবেদনে মাথার বাহ্যিক আঘাত, ক্ষতের চিহ্ন এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত জমাট বাঁধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

তদন্তকারীরা মূল রিপোর্টের একটি কপি একটি পরিত্যক্ত জায়গায় ক্রস চিহ্ন দেওয়া অবস্থায় খুঁজে পেয়েছেন।

আইসিটির দুই প্রসিকিউটর এর নেতৃত্বে ১২ সদস্যের তদন্ত দল সম্প্রতি রাজিবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, যিনি এই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের নাম প্রকাশ করেছেন। যে অফিসটিতে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পরিবর্তন করা হয়েছিল সেখানে প্রবেশকারীদের গতিবিধি এবং ডিজিটাল প্রমাণও সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা।

 

Comments

The Daily Star  | English

Is the govt backing the wrongdoers?

BNP acting Chairman Tarique Rahman yesterday questioned whether the government is being lenient on the killers of a scrap trader in front of Mitford hospital due to what he said its silent support for such incidents of mob violence.

5h ago