জীবনে মরণে মরণোত্তরে আবু সাঈদ
আবু সাঈদের মৃত্যুতে শোকার্ত দেশবাসীর চোখের পানি এখনো শুকায়নি। বাবা-মা-ভাই-বোন-স্বজন এখনো আবু সাঈদের প্রসঙ্গ এলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এরই মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে যে মামলা করেছে তার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) সত্যকে ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে।
এফআইআর দেখে প্রশ্ন জাগছে—মামলার পরিণতি কি ন্যায়বিচারের দিকে যাচ্ছে? অসংখ্য মানুষের চোখের সামনে আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। অনেক টেলিভিশন লাইভ সম্প্রচার করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বক্তব্যে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। অথচ আবু সাঈদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে— 'আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেলের নিক্ষেপের এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তখন তার সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য বিকেল ১৫.০৫ ঘটিকার সময় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।' আবু সাঈদ কোটা সংষ্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষিম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিল। তিনি গত ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের ছোড়া ছররা গুলিতে নিহত হয়েছেন।
আবু সাঈদ। তাকে ঘিরে তার এলাকার মানুষ স্বপ্ন দেখতেন। সেই সাঈদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া অসহ্য কষ্টের। অন্য যেকোনো দিন সাঈদ বাড়িতে গেলে মা-বাবা গভীর আনন্দের সাথে অপেক্ষা করতেন। সেদিন অপেক্ষা করছিলেন মরদেহ দেখার জন্য।
আবু সাঈদের বাড়িতে তার মরদেহ নিয়ে গিয়েছিলাম ১৬ জুলাই দিবাগত রাত ২টার দিকে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মরদেহ নেওয়ার জন্য ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেছিলেন। পুলিশের পক্ষে জানানো হয় পুলিশের ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ আবু সাঈদের বাড়িতে নেওয়া হবে। আমরা আরও জানলাম পুলিশি পাহারায় মরদেহ নেওয়া হবে। শিক্ষকদের মধ্যে আমি একাই। আবু সাঈদের কয়েকজন বন্ধু-সতীর্থ গিয়েছিল। যাওয়ার সময় দেখলাম ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ কর্মকর্তা এবং কয়েকটি পুলিশ ভ্যান। কেন এত কড়া প্রহরার প্রয়োজন হয়েছে জানি না। রংপুর থেকে বিশাল বহর গেছে পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়া বাজার পর্যন্ত। জাফরপাড়া থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে সাঈদের বাড়ি।
টগবগে তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তাকে ঘিরে তার এলাকার মানুষ স্বপ্ন দেখতেন। সেই সাঈদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া অসহ্য কষ্টের। অন্য যেকোনো দিন সাঈদ বাড়িতে গেলে মা-বাবা গভীর আনন্দের সাথে অপেক্ষা করতেন। সেদিন অপেক্ষা করছিলেন মরদেহ দেখার জন্য। গর্ভে ধারণ করা বাবা-মায়ের মনে কত ঝড় যে বয়ে গেছে আমরা কি তার সামান্যটুকুও উপলব্ধি করতে পারব? মধ্যরাতের অন্ধাকার ভেদ করে কান্নার করুণ সুর সেদিন উপস্থিত সকলকে স্পর্শ করেছে। মা-বোন-স্বজনের আর্তনাদে উপস্থিত অনেকের চোখ ভিজেছে। বাবার পাথরদৃষ্টিতে গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু।
ছোটবেলা থেকে মেধার পরিচয় দিয়ে বেড়ে উঠছিলেন আবু সাঈদ। তার লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহ করার মতো সামর্থ্য পরিবারের ছিল না। নিজের পড়ালেখার ব্যয় নিজেই মেটাতেন। লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ারও উপক্রম হয়েছিল কখনো কখনো। আবু সাঈদের বাড়িতে থাকার আলাদা কোনো ঘর ছিল না। দুভাই এক বিছানায় থাকতেন। বাবা সামান্য জমি থেকে একটা অংশ বিক্রি করেছেন ঘর তোলার জন্য। দেয়ালটুকু কেবল তুলেছেন। পরিবারের সদস্যরা বলছিলেন সাঈদ বড় চাকরি করবে- এটা তার স্বপ্ন ছিল। ৫৬ শতাংশ কোটা থাকলে সেই স্বপ্ন পূরণ করা যে কিছুটা কঠিন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তিনিও যুক্ত হন
যেদিন আবু সাঈদকে হত্যা করা হলো ওই দিন আমার সহকর্মী অ্যাকাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক উমর ফারুক, শাহীনুর রহমান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নুরুল্লাহসহ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই ছিলাম। শিক্ষার্থীদের জন্য কী করা যায় এ বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। ক্যাম্পাসে ঢোকার মতো অবস্থা ছিল না। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। শিক্ষার্থীরা আহত হচ্ছিলেন, কেউ কেউ বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়ছিলেন। আহতরা কীভাবে অ্যাম্বুলেন্স পেতে পারে, কীভাবে বেরিয়ে আসতে পারে এসব কাজ করছিলাম। শিক্ষার্থীদের জন্য কখনো চিকিৎসক, কখনো পুলিশকে ফোন করছিলাম। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানকে ফোন করে কয়েকজন আহত শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা এবং শিক্ষার্থীরা যাতে আহত না হয় সেই বিষয়ে অনুরোধ করছিলাম। ওইদিন যতবার ফোন করেছিলাম পুলিশ কমিশনার ফোন ধরেছিলেন। আহত ছাত্রদের কীভাবে হাসপাতালে নেওয়া যাবে সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে ফোনে কথা চলাকালে সংস্কৃতি-সংগঠক ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য এবং কলেজ শিক্ষক কাফি সরকারের মুঠোফোনে জানতে পারি আমাদের অনেক শিক্ষার্থী রাবার বুলেটে আহত হয়ে হাপাতালে ভর্তি। তার মধ্যে একজন শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমরা চারজন শিক্ষক মিলে হাসপাতালে যাই। যেতে পথে খবর পাই পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ বেঁচে নেই। তিনি ইংরেজি বিভাগের দ্বাদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী। গত মাসের চার তারিখে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করেছে। নিজের ফলাফলটাও আর তার জানা হবে না।
হাসপাতালে পৌঁছে যে দৃশ্য চোখে পড়াল তা বর্ণনার বাইরে। শিক্ষার্থীরা আহাজারি আর ছোটাছুটি করছে। স্ট্রেচারে নিথর শুয়ে আছে আবু সাঈদ। সহযোদ্ধার মরদেহ স্ট্রেচারে নিয়ে শিক্ষার্থীরা রওনা দিয়েছিল ক্যাম্পাসের দিকে। পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে পুলিশ। মরদেহ হস্তান্তরে কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়েছে পুলিশ। আমরা অপেক্ষা করছিলাম তার বাড়ি থেকে কেউ এলে মরদেহ গ্রহণ করা হবে। সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে আসে তার বড় ভাইসহ কয়েকজন আত্মীয়। সাঈদের চাচাতো ভাই রুহুল আমিন পুলিশের সঙ্গে মরদেহ দেখতে গিয়েছিল। সে অনেকগুলো ছবিও তুলেছে। সেসব ছবিতে দেখা যাচ্ছে মাথার পিছন থেকে অনেক রক্ত গড়িয়ে জমা হয়ে আছে স্ট্রেচারে।
আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন বলছিলেন, 'আমার ভাই শহীদ হয়েছে। আমরা তার জন্য গর্ব করি।' অর্থপ্রদানের সময় কয়েকজন কথা বলেন। সেসময়ে উপস্থিত প্রায় সকলের চোখ ভিজে যায়।
আবু সাঈদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন হাসপাতালে সার্বক্ষণিক উপস্থিত ছিল। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি বিজন মোহন চাকি, ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আসিফ আল মতিন, সহযোগী অধ্যাপক আলী রায়হান, সহকারী অধ্যাপক মৌটুসী রায়, জিলানী, অ্যাকাউন্টিং বিভাগের আশানউজ্জামান উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে পারি সাঈদ জানিয়েছিল আন্দোলনে সে মারা গেলে ক্যাম্পাসে যেন তার জানাজা নামাজ পড়া হয়। আসিফ আল মতিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে এ বিষয়ে যখন কথা বলেন তখন ক্যাম্পাস উত্তাল। উপাচার্য অবরুদ্ধ। তার বাসায় এবং কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। আবু সাঈদের মৃত্যুর খবরে ক্যাম্পাস রণাঙ্গণে পরিণত হয়। উপাচার্যের বাসভবন ভাঙচুর হয়। এই পরিস্থিতিতে মরদেহ ক্যাম্পাসে নেওয়া সম্ভব নয় এমনটাই জেনেছেন আসিফ আল মতিন। সেকারণে আর ক্যাম্পাসে তার জানাজা পড়া সম্ভব হয়নি।
আবু সাঈদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। আবু সাঈদের হাত ধরে সেই কষ্ট লাঘবের স্বপ্ন দেখতেন তার বাবা-মা। এই স্বপ্ন এখন অতীত। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার পরিবারের জন্য সাড়ে সাত লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে। সেদিন আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন বলছিলেন, 'আমার ভাই শহীদ হয়েছে। আমরা তার জন্য গর্ব করি।' অর্থপ্রদানের সময় কয়েকজন কথা বলেন। সেসময়ে উপস্থিত প্রায় সকলের চোখ ভিজে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। আরও অনেকেই কিছু কিছু করে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। যদিও এই সহায়তায় সন্তান হারানোর শোক সামান্যতমও ভুলতে পারবেন না বাবা-মা-স্বজন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হেয়াত মামুদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় বাংলা বিভাগ আর নিচ তলায় ইংরেজি বিভাগ। ফলে গত কয়েক বছরে অসংখ্য দিন সাঈদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সাঈদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ ছিল না। তার মৃত্যুর পরে দেখেছি সে আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল। আবু সাঈদের সঙ্গে জাগতিক আর কারো কোনো কথাই হবে না। তবে সাহসীর বেশে মৃত্যকে বরণ করা আবু সাঈদ বীরের মর্যাদা পাবে। মানুষ বহুকাল তাকে মনে রাখবে। আমরা চাই মামলায় তদন্ত নিরপেক্ষ হোক। এই তদন্ত ছাড়াও বিচারবিভাগীয় তদন্ত আছে। অন্তত সেখানে প্রকৃত চিত্র উঠে আসুক। কেবল আবু সাঈদ নয় দেশের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
আবু সাঈদ মারা যাওয়ার আগের দিন ফেসবুকে লিখেছে 'অন্তত একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়টা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।' তার মৃত্যু জগতজুড়ে সম্মানের আর গর্বের হয়ে উঠেছে।
Comments