সস্তার আলু এখন অনেক চাষির গলার ফাঁস

ফাইল ফটো

বাজারে এখন সবচেয়ে সস্তা খাদ্যপণ্যের তালিকায় সবার ওপরে একটি হলো আলু। গত নভেম্বরে আলু রোপণের সময় চড়া দাম পাওয়ার আশায় কৃষকরা চলতি সিজনে প্রচুর পরিমাণে আলু চাষ করেছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড পাঁচ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। গত সিজনের শেষের দিকে দেশে আলুর দাম কেজিতে ৮০ টাকা হয়েছিল।

তবে, বর্তমান পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে, খেত থেকে আলু তোলার সময় চাষিরা এখন আর মুনাফার কথা ভাবতে পারছেন না।

রেকর্ড পরিমাণে চাষ ও পর্যাপ্ত যোগানের সম্ভাবনার কারণে উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে আলু বিক্রি করে কীভাবে টিকে থাকবেন তা নিয়েই চিন্তিত কৃষকরা।

রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গতকাল ঢাকায় প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ২০ থেকে ৩০ টাকা। গত এক সপ্তাহ ধরে এই দামেই আলু বিক্রি হচ্ছে।

দেশের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া ও জয়পুরহাটের বেশ কয়েকজন কৃষক দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন—কেজিপ্রতি আলুর দাম এখন ১১ টাকার কম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এবার প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে ১৫ টাকা। যা গত বছর ছিল ১৩ টাকা।

অনেক কৃষক বলছেন—তারা উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না। তারা আলুর দাম বাড়াতে বা তাদের সহায়তার জন্য সরকারি উদ্যোগ আশা করছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন বিভাগের পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগে কখনো এত জমিতে আলু চাষ করি নাই।'

চলতি মৌসুমে মোট উৎপাদন এক কোটি ২০ লাখ টন হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ)।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন এক কোটি ছয় লাখ টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে—গত মৌসুমে আলু উৎপাদিত হয়েছিল এক কোটি নয় লাখ টনের কাছাকাছি। দেশের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন।

সরকার মনে করে, হিমাগারের সুবিধার অভাবে মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ আলু নষ্ট হয়। আলুর এই বাড়তি সরবরাহ ছোট কৃষকদের স্বস্তি দিতে পারে।

দিনাজপুরের উত্তর গোসাইপুর গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন সম্প্রতি প্রতি কেজি আলু ১৩ টাকায় বিক্রি করেছেন। তার উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ১৬ টাকা ৬০ পয়সা।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলুর বীজের বেশি দামের কারণে এ বছর উৎপাদন খরচ কেজিতে তিন থেকে চার টাকা বেড়েছে। গত মৌসুমে প্রতি কেজি বীজের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ছিল। চলতি মৌসুমে রোপণের সময় প্রতি কেজি বীজের দাম ছিল ৮০ টাকা।'

পাশাপাশি শ্রমিক খরচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও বেড়েছে বলে জানান ‍তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে—কীটনাশক, বীজ, শ্রমিক ও জমি ইজারা বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ দুই টাকা বেড়েছে।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার আলু চাষি শরিফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেজিপ্রতি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ১৬ থেকে ১৭ টাকা। ভালো দাম না পাওয়ায় গত মঙ্গলবার ১১ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করেছি।'

সার ও বীজের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, 'যদি লোকসান হতেই থাকে তবে আগামী মৌসুমে আলু চাষ করব কিনা নিশ্চিত নই।'

আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো—আলু সংরক্ষণের জন্য গত মৌসুমের তুলনায় প্রতি কেজিতে প্রায় চার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ আলু উৎপাদনকারী জেলা জয়পুরহাটের আলু চাষি মাজহারুল ইসলাম অন্য অনেকের চেয়ে ভাগ্যবান।

১০ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করে খরচ তুলতে পেরেছেন জানিয়ে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'সত্যি বলতে কী, চাষবাস চালিয়ে যাচ্ছি কারণ আমাদের লজ্জা নেই।'

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্রপস উইংয়ের পরিচালক শওকত ওসমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনুকূল আবহাওয়া ও লেট ব্লাইট রোগ না হওয়ায় চলতি মৌসুমে উৎপাদন খুব ভালো হয়েছে। তাই কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না।'

আলুর দাম কমার বিষয়টি সাময়িক বলে মনে করেন তিনি।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে আলুর খুচরা দাম চলতি সিজনে ৪০ টাকা কেজির বেশি হবে না বলে দাবি করেছেন হিমাগার মালিকরা।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমান দাম কৃষকদের জন্য সন্তোষজনক নয়। অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়।'

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চলতি মৌসুমে আলু চাষ পূর্বাভাস ছাড়িয়ে গেছে। দেশের বাজার ব্যবস্থার প্রকৃতি বিবেচনায় পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত জটিল কাজ।'

হিমাগার ভাড়া বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয় জেনেছে। এটি ন্যায়সঙ্গত কিনা তা মূল্যায়ন করতে আলোচনা হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'আলু মজুদের খরচ বাড়লে কৃষকদের জন্য তা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।'

তার মতে, উত্পাদন ও চাহিদার তথ্যের মধ্যে ফাঁক আছে। এই সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে কৃষকরা যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে না পড়েন সেজন্য নীতি সহায়তার পরিকল্পনা করছে সরকার।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বাণিজ্য ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষকের ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh trade deficit July-August FY25

Trade deficit narrows 2.6% in July-April

The country’s trade deficit narrowed by 2.60 percent in the first ten months of the current fiscal year compared to the same period a year ago, thanks to a rise in export earnings coupled with subdued imports..During the July-April period of fiscal year (FY) 2024-25, the trade gap was $18.

7h ago