লিভার সিরোসিসের কারণ কী, লক্ষণ ও চিকিৎসা  

লিভার সিরোসিস
ছবি: সংগৃহীত

লিভারকে শরীরের পাওয়ার হাউজ বলা হয়। কারণ এটি শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। লিভারের যত ধরনের খারাপ রোগ হয় তার মধ্যে অন্যতম লিভার সিরোসিস। লিভার সিরোসিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ।

লিভার কী

ডা. ফারুক আহমেদ বলেন, লিভার বা যকৃৎ মানবদেহের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অঙ্গ পেটের ডানদিকের উপরিভাগে থাকে। লিভার শক্তি উৎপাদন ও সংরক্ষণে কাজ করে, খাদ্যদ্রব্য পরিপাক থেকে শুরু করে, হরমোন উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ খাওয়ার পর প্রয়োজনীয়ভাবে মেটাবলাইজ করা, সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করা এবং শরীরে যে ক্ষতিকর টক্সিন তৈরি হয় বা বাইরে থেকে প্রবেশ করে তা নিষ্ক্রিয় করে থাকে লিভার।

লিভার সিরোসিস কী

লিভার বা যকৃৎ অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। লিভারে যে টিস্যু থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো লিভারের কোষ, যেগুলোকে হেপাটোসাইট বলা হয়। হেপাটোসাইট একা কাজ করে না, বরং লিভারের অন্যান্য কোষ ও রক্তনালীর সঙ্গে সংযুক্ত থেকে সমন্বিতভাবে কাজ করে।

লিভারের কোষ যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন নিজে থেকেই পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে। অনেক সময় পুনরুদ্ধার করতে পারে আবার অনেক সময় ব্যর্থ হয় আবার কোষ তৈরি করে পুনরুদ্ধার করতে পারলেও লিভারের ভেতরের স্বাভাবিক গঠনের পরিবর্তন হয় বা নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে কোষগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।

স্বাভাবিক অবস্থায় লিভারের কোষকলা নরম থাকে কিন্তু স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে এটি ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায়, কার্যক্ষমতা কমে যায়। যখন লিভার বা যকৃতের সুস্থ টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফাইব্রোসিস বা দাগযুক্ত হয় যায়, ফাইব্রোসিস টিস্যু বেশি হয়ে যায়, নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে পারে না, লিভার অকার্যকর হয়ে পড়ে সেই অবস্থাকে বলা হয় লিভার সিরোসিস।

কেন হয়

বিভিন্ন কারণে এটি হতে পারে।

১. সাধারণত ভাইরাসজনিত কারণে লিভার সিরোসিস হয়। এর মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের সংক্রমণ অন্যতম।

২.  ফ্যাটি লিভার বা লিভারে অতিরিক্ত চর্বি লিভার সিরোসিস হওয়ার অন্যতম কারণ।

৩. উইলসন ডিজিজ নামক বিরল জিনগত রোগ মানবদেহে কপার বা তামার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। শরীর অতিরিক্ত কপার জমে যাওয়ার কারণে লিভার সিরোসিস হতে পারে।

৪.  অটোইমিউন রোগের কারণে হতে পারে।

৫. কিছু কিছু ওষুধ সেবনের কারণে লিভার সিরোসিস হতে পারে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিভার সিরোসিস হওয়ার পেছনে সঠিক কারণ জানা সম্ভব হয় না।

লক্ষণ

ডা. ফারুক আহমেদ বলেন, লিভার সিরোসিস হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অনেক সময় কোনো কারণে পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম কিংবা পেটের অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে লিভার সিরোসিস শনাক্ত হয়।

তবে লিভার সিরোসিসের গুরুতর পর্যায়ে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- ক্ষুধামন্দা, ওজন কমে যাওয়া, স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাওয়া, জ্বর হওয়া, পেট ফুলে যাওয়া, পেটে ও পায়ে পানি আসা এবং জন্ডিস হয়ে যাওয়া লিভার সিরোসিসের প্রধান লক্ষণ। অনেক সময় রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, ঘনঘন জ্বর আসে, রক্তবমি হয়, কালো পায়খানা হয়।

জটিলতা

লিভার সিরোসিসে প্রধান জটিলতার মধ্যে রয়েছে রক্ত বমি হওয়া, কালো পায়খানা হওয়া, রক্তপাত হওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, সংক্রমণ, হওয়া, কিডনি খারাপ হয়ে যেতে পারে, ফুসফুসে পানি জমতে পারে। এমনকি লিভার ক্যানসারের মত মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

চিকিৎসা

লক্ষণ দেখা দিলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই লিভার সিরোসিস শনাক্ত করা সম্ভব। এই রোগের চিকিৎসায় প্রতিকারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় যে কারণে রোগীদের কিছু বিষয় মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। যেমন- সুষম খাবার খেতে হবে, পেটে ও পায়ে পানি আসলে লবণ কম খাওয়া, সহজে হজম হয় না এমন খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা। প্যারাসিটামল, ঘুমের কিংবা ব্যথার ওষুধ না খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় রোগীদের।

এছাড়া রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী ওষুধ এবং লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। একইসঙ্গে লিভার সিরোসিস হওয়ার পেছনে যেসব কারণ শনাক্ত হয়েছে তা দূর করার জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেমন- হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস, ফ্যাটি লিভার, উইলসন ডিজিজ থাকলে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিলে রোগী অনেকাংশে ভালো থাকে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় লিভার সিরোসিস হওয়ার পেছনে কোনো কারণ জানা যায় না কিংবা সিরোসিস গুরুতর পর্যায়ে থাকে। চিকিৎসায় কাজ হচ্ছে না সেক্ষেত্রে চিকিৎসা হচ্ছে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বা যকৃৎ প্রতিস্থাপন করা। এর মাধ্যমে লিভার সিরোসিস নিরাময় সম্ভব।

প্রতিরোধ

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস এবং ফ্যাটি লিভারের কারণে লিভার সিরোসিস হয়, আর এগুলো প্রতিরোধযোগ্য রোগ। সচেতনতা এবং কারণ জেনে তা প্রতিরোধ করার মাধ্যমে লিভার সিরোসিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

১. হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি ভাইরাস রক্তবাহিত রোগ। কোনো প্রয়োজনে কারো রক্ত নেওয়ার সময় ভালো মত স্ক্রিনিং করে নিতে হবে। কোনোভাবেই যাতে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

২. হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী টিকা আছে। দেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রমে শিশুদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। শিশুর টিকা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাপ্তবয়ষ্ক যারা নেননি তাদেরও টিকা নিতে হবে।

৩. ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ, রেজার, ব্লেড ব্যবহার করতে হবে। রেজার, ব্লেড, টুথব্রাশ এগুলো কোনোভাবেই অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যাবে না।

৪.  অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কোলেস্টরেল বেশি থাকার কারণে ফ্যাটি লিভার হয়। ফ্যাটি লিভার যাতে না হয় সেজন্য সুষম খাদ্য ও নিয়মিত শরীর চর্চার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ওজন ঠিক রাখতে হবে।

৫. শরীরে অতিরিক্ত কপার ও আয়রন জমে যাওয়া প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে লিভার সিরোসিস প্রতিরোধ সম্ভব।

 

Comments

The Daily Star  | English

Nation mourns lost children

The death toll from the jet crash at Milestone School and College rose to 32 yesterday, as the nation reeled from shock and grief following the country’s deadliest aviation tragedy in years.

7h ago