কর্মক্ষেত্রে বয়সের ব্যবধান কি নতুনদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে?

কর্মক্ষেত্রে বয়সের পার্থক্য
ছবি: অর্কিড চাকমা

জীবনের বড় একটা অংশ অর্থাৎ ছাত্রজীবনের পুরোটাই আমাদের কাটে সমবয়সী মানুষের সঙ্গে। তারপর যেই না আমরা পেশাজীবনে প্রবেশ করি, হুট করেই দেখতে পাই আমাদের আশপাশে আর সমবয়সীরা নেই, বরং আমরা ঘিরে রয়েছি বিভিন্ন বয়সী, বিভিন্ন ধরনের মানুষ দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময় কিছুটা অস্বস্তি হয়, মানিয়ে নিতে কিছুটা সময়ও হয়তো লাগে। তবে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে এক ছাদের নিচে বসে কাজ করা এতটাও খারাপ নয়।

নানা বয়সের, নানা প্রজন্মের মানুষের মধ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কমবয়সীরা পরিস্থিতির সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নেন? কীভাবেই বা তারা খাপ খাওয়ান?

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করেন নায়লা (ছদ্মনাম)। তিনি বলছিলেন, তার জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো। যদিও কর্মক্ষেত্রে অভিযোজনের জন্য তিনি বিশেষ কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েননি। তবে যে সমস্যাটায় পড়েছিলেন সেটি হলো, সহকর্মীরা যখন কথা বলতেন তার অনেক কিছুই তিনি বুঝতেন না।

নায়লা বলেন, 'আমার সহকর্মীরা বয়সে কিছুটা বড় ছিলেন। বয়সটা তেমন বড় সমস্যা হয়নি। সমস্যা ছিল, তারা যখন কথা বলতেন আমি প্রায়ই অপ্রস্তুত বোধ করতাম।'

আপনি যখন একটি দলে যুক্ত হন, যে দলটি বেশ আগে থেকে একসঙ্গে কাজ করছে, একে অন্যকে অনেক বছর ধরে চেনে; তখন আপনি কিছুটা একা বোধ করতে পারেন। নিজেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন লাগতে পারে।

এ প্রসঙ্গে নায়লা বলেন, 'অনেক সময় তারা আর্থিক অবস্থা, পরিবার কিংবা সন্তানদের নিয়ে নানা ধরনের হাস্যরস করেন। আমি সেগুলোর সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারি না। বিশেষ করে যখন তারা টিকটক বা স্ন্যাপচ্যাটের মতো অ্যাপগুলো নিয়ে কথা বলেন, সেগুলোকে খারিজ করে দেন কারণ এসব তাদের কাছে অর্থহীন লাগে, তখন আমি তাদের কথায় তাল মেলাতে পারি না। তাই সেই সময় মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না আমার।'

কোনো কথার প্রতিক্রিয়া দেওয়াও নবীনদের জন্য জটিল হতে পারে। একটি নতুন কর্মক্ষেত্রে মানিয়ে চলার ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা কিংবা সহকর্মীদের কথা বুঝতে না পারাও সংকট তৈরি করতে পারে। প্রায়ই দেখা যায় যে, দলনেতা বা ম্যানেজার অধস্তনদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করার প্রয়োজন মনে করেন না। ফলে সেখানে স্বচ্ছতার অভাব তৈরি হয়।

একটি আইটি গ্রুপের সাবেক পরামর্শক প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বলেন, 'ম্যানেজারের সঙ্গে আমার সত্যিকার অর্থেই বিচ্ছিন্নতা ছিল। আমি প্রতিষ্ঠানটিতে অনেকটা অন্ধের মতো কাজ শুরু করেছিলাম। কারণ আমাকে সত্যিকার অর্থেই সঠিক কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। যে বিষয়গুলো নিয়ে আমি কাজ করব সেগুলোতেও আমার প্রবেশাধিকার ছিল না। ফলে কাজটি যতটা না কঠিন ছিল তার চেয়ে বেশি কঠিন হয়ে পড়েছিল।'

এই ধরনের পরিস্থিতিতে আপনাকে নিজের থেকেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য জেনে নিতে হবে। অনেক কিছুই হয়ত আপনার পছন্দ হবে না, কিন্তু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে হবে। কাজটি কঠিন হলেও, গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হলেও অনেক তরুণ পেশাজীবী মনে করেন, বয়স্ক সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করার বেশকিছু সুবিধা আছে। কারণ তারা ভালো পরামর্শদাতা ও পথপ্রদর্শক হন।

হুয়াওয়ের সলিউশন আর্কিটেক্ট মুবাল্লিগ হোসেন বলেন, 'নতুন চাকরিতে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের কাছ থেকে কাজ শিখে নেওয়া উচিত।'

দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে প্রথম প্রথম মানিয়ে নেওয়া কঠিন হতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আপনি ঠিকই কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যাবেন, সব শিখে নেবেন।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'আপনি যদি মন খোলা রাখেন এবং আন্তরিক হন তাহলে দেখবেন কী বিপুল পরিমাণ কাজ আপনি জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের কাছ থেকে শিখতে পারবেন। যা দেখে আপনি সত্যিই অবাক হয়ে যাবেন।'

আইনজীবী জালাল উদ্দীন আহমেদ তার কিছু মতামত তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, 'প্রথম দিকে আমি কাজের ধরন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পার্থক্য দেখতে পাই। এই পার্থক্যগুলো কাটিয়ে উঠতে নমনীয়তা এবং ধৈর্যের প্রয়োজন।'

বয়স্ক সহকর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে সেতুবন্ধনের শুরুটা হয় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে।

বিপনন পেশাজীবী মোহাম্মদ আশরাফুল বলেন, 'আমি আগে ভাবতাম যে বয়স্ক সহকর্মীরা অনমনীয় এবং নতুন ধারণা গ্রহণ করতে পারেন না। তাদের বেশিরভাগই তরুণ সহকর্মীদের কাছ থেকে সম্মান প্রত্যাশা করেন কিন্তু বিনিময়ে তারা নিজেরাই সম্মান দিতে চান না।'

বিভিন্ন বয়সী সহকর্মীদের মধ্যে বিভেদের কারণ বয়সের পার্থক্য নাকি অন্যকিছু তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। কার্যকর পদ্ধতিতে যোগাযোগ এবং সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে চলছে সহকর্মীদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়। সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ সাবলীল করতে নিজের মধ্যেও চরিত্রগত কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যেমন অকারণ জেদ ধরে না রাখা।

জালাল উদ্দীন বলেন, 'প্রজন্মগত ব্যবধান থাকার পরেও আমি দেখেছি যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং মন উন্মুক্ত রাখলে কর্মক্ষেত্রে একটি সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হতে পারে যা সবার জন্যই উপকারী। আমি খুবই ভাগ্যবান যে আমার সিনিয়র সহকর্মীরা সহায়ক এবং খোলা মনের ছিলেন যা আমার কাজকে সহজ করে তুলেছিল।'

নিজেদের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে মিল আছে তা খুঁজে বের করলে পেশাদার সম্পর্কের পথ আরও প্রশস্ত হতে পারে বলে মনে করেন জাপান বাংলাদেশ কানেক্ট লিমিটেডের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার শাফিন মাহমুদ। তিনি জানালেন, ফুটবলের প্রতি অভিন্ন ভালোবাসা এবং বিভিন্ন ধরনের খাবার এক্সপ্লোর করতে গিয়ে অনেক সহকর্মীর সঙ্গেই তার দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শখ হোক বা আগ্রহ, নিজেদের মধ্যে সাধারণ মিলগুলো কী আছে তা খুঁজে বের করা গেলে তা প্রজন্মের ব্যবধানও ঘুচিয়ে দিতে পারে।

সব অভিজ্ঞ পেশাজীবীই শুরুতে নবীন ছিলেন এবং সব নবীনরাই একদিন নিজেদের দক্ষতার মাধ্যমে অনেকদূর এগিয়ে যাবেন। যাদের পরামর্শে পথ চলা শুরু করেছেন, একদিন তাদের মতো পরামর্শদাতাও হয়ে উঠবেন। নিজেদের মধ্যে ব্যবধানগুলোকে মেনে নিন এবং কর্মক্ষেত্রকে কেবল চাকরির জায়গা নয় বরং একে অন্যের বিকাশ ও সহযোগিতার স্থানে পরিণত করুন।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments