ঢাকার কোথায়-কীভাবে উদযাপিত হলো চীনা নববর্ষ
গত শুক্রবারে আমার তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ফলে বন্ধুরা যেসব পরিকল্পনা করছিল, অনেকটা মনের অজান্তেই সেগুলোতে হ্যাঁ বলে দিচ্ছিলাম। অথচ আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে সেদিন আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা বিয়ের দাওয়াত রয়েছে।
আমি জানি না, এটা কীভাবে আমার মাথা থেকে সরে গেল! ঢাকার লোকজন যে 'ব্রেইন ফগ' সমস্যায় ভুগছে, আমিও সেটারই দোহাই দিলাম (কিন্তু এটা উল্লেখ করলাম না যে, দিনরাত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও দেখার আসক্তি থেকেই ঢাকাবাসীর এই সংকটের শুরু)।
যাই হোক, শুক্রবারের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এক বন্ধু আমাকে একটি ভিডিও পাঠালো, যা দেখে আমি খুশি হয়ে গেলাম। ভিডিওটি ছিল গুলশান লেক পার্কে চীনা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত। ঢাকায় এ ধরনের উদযাপন এবারই প্রথম। আমি এই উৎসবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ এক কথাতেই গ্রহণ করলাম এবং রীতিমতো সেজেগুজে গুলশান লেক পার্কে চললাম।
তখন সন্ধ্যা নেমেছে, আকাশে কমলা রঙের আভা। পুরো পার্কের লম্বা লম্বা গাছগুলোকে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মরিচ বাতি দিয়ে। মাঝে মাঝেই ঝুলছে ঐতিহ্যবাহী চীনা লণ্ঠন। সেই সঙ্গে ঝুলছিল চীনের ঐতিহ্যবাহী রঙিন কাগজের ঝুলন্ত সাপ। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এক জাদুকরি পরিবেশ।
আয়োজনটি ছিল আনন্দে ভরপুর। সেখানে উজ্জল পোশাক পরে নেচে বেড়াচ্ছিল চীনা ড্রাগন ও সিংহ। ছিল বিশাল বিশাল ঢোল, ঘণ্টা ও করতালের মতো বাদ্যযন্ত্রের উপস্থিতি। বলা হয়, ঢোল আর এসব বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে পালিয়ে যাবে দুর্ভাগ্যের দানব আর শোনা যাবে সৌভাগ্যের পদধ্বনি।
ঐতিহ্যবাহী চীনা নৃত্য, বাদ্যযন্ত্রের পরিবেশনা আর মার্শাল আর্ট পরিবেশনার পেছনে ছিলেন কনফুশিয়াস ইনস্টিটিউট অব শান্তা মারিয়াম, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুশিয়াস ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
কনফুশিয়াস ক্লাসরুম সম্পর্কে যারা জানেন না তাদের বলি, কনফুশিয়াস ক্লাসরুম হলো এমন একটি ধারণা যেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে মিলে সাংস্কৃতির কর্মকাণ্ডের যোৗথ পরিকল্পনা এবং নিজেদের মধ্যে ধারণার বিনিময়।
উৎসবে বেশ মজার একটি বিষয় ছিল। সেটি হলো একটি নির্ধারিত বুথে গিয়ে দর্শনার্থীরা কাঠির সঙ্গে যুক্ত করা সাদা কাগজের পাখা নিতে পারছিলেন এবং সেটার ওপর রঙিন কালি দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করার, দৃশ্য আঁকার বা বসন্ত উৎসবের কোনো বাণী লিখিয়ে নিতে পারছিলেন।
পার্কের ভেতরে বসেছিল বেশকিছু স্টল, যা পুরো আয়োজনে বেশ মেলার আবহ তৈরি করেছি। সেখানে ছিল বার-বি-কিউ বুথ, যেখানে দর্শনার্থীদের সামনেই মাংস পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ছিল মুরগির গিলা-কলিজা, চামড়াসহ চীনা এক ধরনের সবজি দিয়ে বিশেষ পরিবেশনা। লবণ আর কিছু বিশেষ মশলা ছড়িয়ে পরিবেশন করা এই খাবারটির জন্য রীতিমতো লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিলেন দর্শনার্থীরা।
ওভারসিজ চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশের মহাসচিব ভিভিয়ান হুয়াং বলেন, 'নববর্ষ উদযাপন চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এটি ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছে। চলতি বছর চীনা নববর্ষ উদযাপিত হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি।'
'চীনে নববর্ষকে উদযাপনের ঠিক আগ মুহূর্তে দেশটির সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের চীনা দূতাবাস এবং চীন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংশ্লিষ্টরা মিলে যৌথভাবে একটি আয়োজনের পরিকল্পনা করে। যার আওতায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে ধারাবাহিক উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেখানে মেলার পাশাপাশি নয় দিনব্যাপী চীনা চলচ্চিত্র উৎসক এবং চীনের ঝেজিয়াং উ অপেরা ট্রুপের পাঁচটি পরিবেশনাও অন্তর্ভূক্ত।'
এই উৎসবের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ চীনের সমৃদ্ধ ও বর্ণিল সংস্কৃতি সম্পর্কে কাছ থেকে জানতে পারবেন এবং এই আয়োজন দুই দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।
চীনে বিশ্বাস করা হয়, চীনা নববর্ষ প্রতিটি রাশিচক্রের বছরের শুরু ও শেষকে চিহ্নিত করে। চীনা রাশিচক্র হলো চন্দ্র ক্যালেন্ডারের ওপর ভিত্তি করে একটি শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থা, যেখানে প্রতি বছরকে একটি প্রাণীর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।
২০২৫ সালের জন্য চীনা নববর্ষ শুরু হবে ২৯ জানুয়ারি। এটি হবে সাপের বছর, বিশেষ করে কাঠের সাপের। এই বছরের শেষ হবে ২০২৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি।
চীনের ঐতিহ্যে সাপ তার জ্ঞান ও রূপান্তরকারী শক্তির জন্য পরিচিত। এর সঙ্গে যখন কাঠ যুক্ত হয় তখন তা উন্নতি, স্থিতিশীলতা ও সৃজনশীলতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
আমার চীনা রাশির প্রতীক হলো বানর। জ্যোতিষীরা যেমন বলেন, বানরের সঙ্গে সাপের ইতিহাস তিক্ত। তাই আমি আশা করি এ বছর আমার 'সাপ' বন্ধুদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করব। কারণ আমি জ্যোতিষশাস্ত্র পড়তে এবং বিশ্বাস করতে ভালোবাসি।
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments