বাংলাদেশে বেকারত্ব ধারণার চেয়ে অনেক বেশি

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেকারত্বের নিম্নমুখী হার এবং উন্নত শ্রমবাজারের চিত্র তুলে ধরতে যে মানদণ্ড ও আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি ছিল চার দশকেরও বেশি পুরোনো।

রাষ্ট্র পরিচালিত পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই তথ্য বিশ্ববাজারে ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করলেও, বিশেষজ্ঞদের মত—এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিকল্পনা এবং কর্মসংস্থান তৈরির প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড উপেক্ষা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এখনো ১৯৮২ সালের ১৩তম আইসিএলএস (ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব লেবার স্টাটিসটিসিয়ানস) ব্যবহার করছে। অথচ ২০১৩ সালে এটি ১৯তম হালনাগাদ হয়েছে।

আরও সুনির্দিষ্ট এবং হালনাগাদ তথ্য পেতে বেশির ভাগ দেশ এখন ১৯তম আইসিএলএস ব্যবহার করছে।

প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আইসিএলএস আয়োজন করে, যেখানে সারা বিশ্বের জন্য মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়।

লেবার ফোর্স সার্ভে ২০২২ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৩তম আইসিএলএসের ভিত্তিতে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ বা ২ কোটি ৫৮ লাখ।

১৯তম আইসিএলএস সংজ্ঞা ব্যবহার করলে বেকারত্বের হার বেড়ে পাঁচ দশমিক নয় শতাংশে দাঁড়াবে। এ ছাড়া, যুব বেকারত্বের হার আট শতাংশ থেকে বেড়ে হবে ১৭ দশমিক সাত শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরো যুব ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর যে বয়সসীমা ব্যবহার করে, সেটি আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ভিন্ন।

বেকারত্বকে খাটো করে দেখার চেষ্টা

বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান সংস্থা যে সংজ্ঞা ব্যবহার করেছে, তাতে বেকারত্বের হার কম দেখানো হয়েছে।

কারণ ১৩তম আইসিএলএসের কর্মসংস্থানের বিস্তৃত সংজ্ঞা রয়েছে।

উদাহরণ স্বরূপ, ১৩তম আইসিএলএস সংজ্ঞা অনুসারে যে ব্যক্তি নিজের ব্যবহারের জন্য পণ্য উৎপাদন করেন, তাকেও কর্মজীবী শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।

১৯তম আইসিএলএসে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে। 'কর্মসংস্থানের কাজ' ও 'নিজস্ব ব্যবহারের উত্পাদন কাজ' পৃথক শ্রেণিকরণ করা হয়েছে।

'মান এবং সংজ্ঞার এই বৈষম্যের কারণে বিবিএস বছরের পর বছর স্ফীত কর্মসংস্থানের হার নথিভুক্ত করতে সক্ষম করেছে, ফলে দেশে বেকারত্ব ইস্যুর ব্যাপ্তি হ্রাস পেয়েছে,' শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, পুরানো মানদণ্ডের ওপর নির্ভরতা শ্রম ও কর্মসংস্থানের অবস্থার প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। যার প্রভাব দেখা গেছে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ, কর্মসংস্থান, বেকারত্ব হার, যুব বেকারত্ব, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ এবং অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সূচকে।

বাংলাদেশে আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পৌটিআইনেন  বলেন, 'কিছু দেশ এখনো ১৩তম আইসিএলএস ব্যবহার করে, তবে তাদের বেশির ভাগ দেশের  জনসংখ্যার আকার বাংলাদেশের মতো না।'

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে আরও বলেন, 'কারণ বাংলাদেশের জনসংখ্যার আকার আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক সংখ্যা এবং গড়কে প্রভাবিত করে।'

আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ১৯তম আইসিএলএস ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে এবং এটি গ্রহণে ইতোমধ্যে বিবিএসকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।

২০২৩ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ২১তম আইসিএলএসে অনানুষ্ঠানিক খাত এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির তথ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমরা বিবিএসকে এই প্রাসঙ্গিক সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে কিছু গ্রহণ শুরু করতে উত্সাহিত করছি।'

শ্রমশক্তি জরিপে পুরোনো তথ্য ব্যবহারের কথা স্বীকার করে পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, নতুন মান গ্রহণ করতে সময় প্রয়োজন।

তবে বিশেষজ্ঞদের আহ্বান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন মানদণ্ডে স্থানান্তরিত হওয়া উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে বিবিএসের হালনাগাদ সংজ্ঞা গ্রহণ করা উচিত।

'আমরা যদি হালনাগাদ সংজ্ঞা উপেক্ষা করি, তাহলে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ভুল পথে নিয়ে যাবে।'

বিভ্রান্তিকর তথ্য এড়াতে তিনি হালনাগাদ সংজ্ঞা ব্যবহার করে পুরোনো তথ্য গণনা করার পরামর্শ দেন।

এক ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করে জেনেভায় আইএলওর কর্মসংস্থান বিষয়ক সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম তথ্যের সামঞ্জস্য বজায় রেখে হালনাগাদ সংজ্ঞা গ্রহণের আহ্বান জানান।

শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, নীতিনির্ধারণী দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯তম আইসিএলএস পদ্ধতি আরও বেশি অর্থবহ এবং ভবিষ্যতে বিবিএসের এটি অনুসরণ করা উচিত।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, 'নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবিএসের শ্রম সংক্রান্ত তথ্য অর্থহীন। এতে প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠেনি।'

তবে শ্বেতপত্র প্রকাশের পর বিবিএসের ১৯তম আইসিএলএস স্ট্যান্ডার্ড গ্রহণের পদক্ষেপে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

'আমাদের পূর্ববর্তী বছরগুলোর বিস্তারিত তথ্য প্রয়োজন, যা সঠিক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা হবে,' যোগ করেন তিনি।

বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, এলএফএস ২০২৩-এর সর্বশেষ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তারা এরই মধ্যে একটি নতুন অধ্যায় সন্নিবেশ করেছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা ধীরে ধীরে নতুন মানে যেতে শুরু করেছি। এতে কিছুটা সময় লাগবে।'

পুরোনো সংজ্ঞাগুলো পতিত সরকারের রাজনৈতিক আনুকূল্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কোনো রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দেওয়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের ছিল না। এ ছাড়া, আমাদের আগের শ্রম তথ্য প্রকাশনা আইএলও পর্যবেক্ষণ করেছে।'

এই মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক ও শ্বেতপত্র প্যানেলের সদস্য সেলিম রায়হান। তিনি মনে করেন, শ্রমবাজারের ইতিবাচক সূচক দেখাতে বিবিএসের ওপর রাজনৈতিক চাপ ছিল।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইতিবাচক চিত্র উপস্থাপন করতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওপর চাপ থাকতে পারে, যেন তারা হালনাগাদ সংজ্ঞা গ্রহণ না করে।'

Comments

The Daily Star  | English
Chinese firms bullish on Bangladesh’s manmade fibre

Chinese firms bullish on manmade fibre exports to Bangladesh

Non-cotton garments are particularly lucrative, fetching higher prices than traditional cottonwear for having better flexibility, durability

15h ago