চাকরি শুধু আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ
জনমিতিক লভ্যাংশের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন সুবর্ণ সময় পার করলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, উপযুক্ত কর্মসংস্থান না থাকায় দেশের শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের হার দিনকে দিন বাড়ছে।
একইসঙ্গে মহামারির কারণে গত ২ বছর দেশের স্থানীয় চাকরির বাজারও সংকুচিত হয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
উপরন্তু, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ সরবরাহ কঠোর করেছে। কিন্তু এই উদ্যোগের ফলে কমতে পারে বেসরকারি বিনিয়োগ। একইসঙ্গে ঋণ ব্যয়বহুল হয়ে ওঠায় পরবর্তীতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে তা প্রভাব ফেলতে পারে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন।
তবে, এর জন্য বাজেটে নতুন কোনো উদ্যোগ যোগ হয়নি। বরং আগের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোই চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দেশে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রধানত ৩টি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সেগুলো হলো—যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে জন্য বরাদ্দ ১ দশমিক ৪২ শতাংশ বেড়েছে। তবে, অন্য ২টি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ যথাক্রমে ৩১ শতাংশ ও দশমিক ৮৩ শতাংশ কমানো হয়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের গবেষণা পরিচালক অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, যদিও সরকার জাতীয় বার্ষিক পরিকল্পনায় সাধারণত উচ্চ লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকে, তবে, প্রস্তাবিত বাজেটে কখনোই পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয় না।
তিনি সরকারকে বৃহৎ ও শ্রমঘন শিল্পগুলোতে প্রণোদনা ও ছাড় প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
'একইসঙ্গে যেসব উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়, সেগুলো আসলেই কার্যকর হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য একটি ট্র্যাকিং সিস্টেম থাকা উচিত', যোগ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই অধ্যাপক আরও বলেন, গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের বাজারে প্রবেশাধিকার তৈরি করার লক্ষ্যে সরকার কিছু নির্দিষ্ট প্রকল্প ও বরাদ্দ ঘোষণা করতে পারে।
এ ছাড়া, স্টার্টআপগুলোকে ঋণ দেওয়ার জন্য একটি তহবিল গঠনেরও প্রস্তাব দেন তিনি।
অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, 'শিক্ষিত বেকার তরুণদের দক্ষতার বৈষম্য কমানোর জন্য কিছু প্রকল্প ও বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিল। যাতে তারা প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে।'
জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের কর্মসংস্থান খাতের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, 'মহামারির আগের বছরগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হলেও কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে এবং এর ফলে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি।
সরবরাহের দিক থেকে কখনো কখনো শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শ্রম বাজারের প্রয়োজনীয় চাহিদার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না।
'তরুণদের কর্মসংস্থানের ওপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে একটি ব্যাপক কৌশল প্রয়োজন', বলেন রিজওয়ানুল ইসলাম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) লেবার ফোর্স সমীক্ষা ২০১৬-১৭ অনুসারে, দেশে জাতীয় বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। আর তরুণদের বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ।
সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। উদাহরণস্বরূপ, তৃতীয় স্তরের শিক্ষা রয়েছে, এমন তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। আর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে এই হার ২৮ শতাংশ।
রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, 'সামষ্টিক অর্থনীতি ও খাতওয়ারি নীতিগুলোকে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি আরও শ্রমঘন শিল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রস্তুত করা প্রয়োজন।'
'সরকার সম্ভাব্য অভিবাসী ও দেশে ফেরা অভিবাসীকর্মীদের চাকরি খোঁজার বা স্ব-কর্মসংস্থানের প্রচেষ্টায় সহায়তা প্রদান করতে পারে', যোগ করেন তিনি।
স্টার্টআপগুলোকে উত্সাহিত করার জন্য সরকার আয়কর রিটার্ন বাদে অন্য সব ধরনের আর্থিক প্রতিবেদনের বাধ্যবাধকতা থেকে ব্যবসাগুলোকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে।
একইসঙ্গে বর্তমান টার্নওভার করের হার দশমিক ৭ শতাংশের পরিবর্তে কমিয়ে দশমিক ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ৩০ লাখ কর্মসংস্থান বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেস প্রতিষ্ঠার জন্য 'কর্মসংস্থান অধিদপ্তর' তৈরির উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
গত বছরের বাজেট প্রস্তাবে সরকার সদ্য স্নাতক পাস করা তরুণদের জন্য 'কর্মসংস্থান ব্যাংক' ও তাদের জন্য বেসরকারি-সরকারি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালুর পরিকল্পনা করেছিল।
তবে, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য নেই।
Comments