বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কোটা বৈষম্য কেন?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হয়েছে কোটার বিরুদ্ধে নয়, ন্যায্যতার পক্ষে। সেই আন্দোলনে স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও অনেক জায়গায় এখন আগের মতোই অন্যায্য কোটা রয়ে গেছে। ফলে পরিশ্রম আর অর্থের সঙ্গে ভালো পরীক্ষা দিয়েও সুযোগ পাওয়া অনিশ্চিত।
কোটা প্রথা নিয়ে এখনো সমালোচনা চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে—বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি যাদের জন্য রাখা, সেই সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী কি এই সুবিধা পাচ্ছে?
প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে যেটাকে কোটা হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তা কি আদৌ প্রকৃত কোটা, নাকি বিশেষ ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর সুবিধামতো একটি সুবিধা? উদাহরণস্বরূপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা এমন কোন সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, যাদের পোষ্যদের জন্য আলাদা কোটা প্রয়োজন? নাকি এটি অযৌক্তিক বিশেষ সুবিধা, যা শুধুমাত্র ক্ষমতার বলয় থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগে মেধাবীদের বঞ্চিত করে গড়পড়তা শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছেন।
তথ্য দেখে বলা যায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটায় ভর্তি কার্যক্রম সংক্রান্ত তথ্য রীতিমতো পিলে চমকানোর মতো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে কোটায় ভর্তি হয়েছে সর্বমোট ২২৪ জন—১০১ জন মুক্তিযোদ্ধা, ৫৩ জন পোষ্য ও ২০ জন উপাচার্য (ভিসি) কোটাসহ অন্যান্য কোটায় ভর্তি। ভিসি কোটা নামক এই বিশেষ পদ্ধতি শুধুমাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে এবং এই কোটার প্রকৃত সংজ্ঞায়নও জরুরি। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের প্রতি ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১১ জনই কোটায় ভর্তি। মাত্র ২৬ নম্বর পেয়ে কোটাতে ভর্তির সুযোগও পেয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৬২১টি, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ৫৩৭টি এবং ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ৫৩৪টি আসন বিভিন্ন কোটায় বরাদ্দ ছিল। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও ভর্তির সুযোগ পান ৭১ শিক্ষার্থী। মাত্র ১৯ নম্বর পেয়েও ভর্তির রেকর্ড রয়েছে। রাবিতে কেবল কোটাতেই বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট আসনের প্রায় ১২ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় শুরুতেই শতকরা ১২ জন মেধাবীকে বিশেষ সুবিধা না থাকার কারণে ছাটাই করে ফেলছে। তার বদলে মাত্র ১৯ নম্বর পাওয়া কোটাধারীরা সুযোগ পাচ্ছে। সেই ১২ জন মেধাবীর কেউ হয়তো দরিদ্র কৃষকের সন্তান, কেউ হয়তো জমি বা মায়ের গয়না বন্ধক রেখে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু তাকে মেধা নয়, হারিয়ে দিয়েছে জন্ম নামক লটারিতে কৃষকের ঘরে যাওয়া।
আরও কষ্টের ব্যাপার হলো, চলতি শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বিভাগে চার শতাংশের নির্ধারিত কোটা লঙ্ঘন করে আইন বিভাগে সাত জন পোষ্য কোটাধারীকে ভর্তি করা হয়। একইভাবে নিয়ম বহির্ভূতভাবে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে দুইজনের সুযোগ থাকলেও তিনজন এবং অর্থনীতি বিভাগে চারজনের সুযোগ থাকলেও পাঁচজনকে ভর্তি করা হয়। আইন বিভাগে পড়তে চাওয়াটা অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন। আবার সেই স্বপ্ন অনেকের কাছে ছেলেখেলার মতো। একদম তলানি থেকে খুঁটির জোরে সাত জনকে ভর্তি করার মতো ঘটনা মেধাবীদের সঙ্গে চূড়ান্ত প্রহসন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পোষ্য ও খেলোয়াড়সহ বিভিন্ন কোটায় শিক্ষার্থী ভর্তি বহাল রয়েছে। খেলোয়াড়দের কোটার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মৌখিক ও ব্যবহারিকের মাধ্যমে ভর্তি হতে পারবে। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ৪৯ জন এবং ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে এই বিশেষ কোটাতে। খেলোয়াড়রা আসলে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী নয়, অথবা বিশেষ বিবেচনায় যদি তাদেরকে সুবিধা দেওয়াই হয় তাহলে মান নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে ছাড় দেওয়াটা আত্মঘাতী। শুধুমাত্র মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষার মাধ্যমে কতটুকু মেধা যাচাই করা সম্ভব? সঙ্গে স্বজনপ্রীতি ও প্রশ্নবিদ্ধ বাছাই প্রক্রিয়ার অভিযোগও আছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেক বিভাগে সর্বোচ্চ দুইজন পোষ্য ভর্তি হতে পারবেন এবং মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য কোটা আগামী ভর্তি পরীক্ষায় বহাল থাকবে। এ ছাড়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের একই চিত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তার সন্তানদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ স্কুল-কলেজে পর্যাপ্ত অগ্রাধিকার থাকে। যে সুবিধাগুলো সচরাচর একজন দিনমজুর, কৃষক, গার্মেন্টস কর্মী, রিকশাওয়ালা বা অর্থনৈতিক কাঠামোতে থাকা নিচের স্তরের মানুষের সন্তান পায় না। একটি সামাজিক কাঠামোর আপাত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা একটি জনগোষ্ঠীকে অন্যান্য বেশি বিপর্যস্ত জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে সুযোগ দেওয়াটা মোটেও বিজ্ঞানসম্মত কোনো প্রক্রিয়া না। 'পোষ্য কোটা' এই পরিচয় আদতে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার ধারক নয়। এই সুবিধার মাধ্যমে ইতোমধ্যে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা একটি গোষ্ঠীর জন্য কোনো ত্রাণকর্তার আবির্ভাবও ঘটাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পোষ্য কোটার ব্যাপারে একটা মজার গল্প আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্ম, বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ে ওঠা, সেখানেই ভর্তি হওয়া, সেই প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ এবং সেখানের গোরস্থানেই সবশেষে দাফন। এই গল্পের প্রেক্ষাপটকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।
বরং যে বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতি ধরে রাখছে, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতিতে পড়ার সব যোগ্যতা থাকার পরেও হাজারো সিরিয়াল পেছনো থাকা একজনকে জায়গা করে দিতে হচ্ছে তাকে। সে তখন তার অপছন্দের একটি বিষয়ে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। অথচ তার এই মানিয়ে নেওয়ার ফলে চা-বাগান শ্রমিকের মেধাবী সুবিধাবঞ্চিত কেউ কিন্তু পড়ছেন না। সব ধরনের সুবিধা সমেত বড় হওয়া একজনকেই তার জায়গাটা ছেড়ে দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ সেই মেধাবী, একজন সিরিয়ালে অপেক্ষমাণ মেধাবী এবং তলানিতে থাকা পোষ্য—এই ট্রিনিটিতে ট্রাজেডিই হলো একমাত্র ফলাফল।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার জন্য যোগ্যদেরকে যাচাই করে। কিন্তু কোটা পদ্ধতি যেভাবে শুরুতেই যোগ্যদেরকে ছেঁটে ফেলার বন্দোবস্ত করছে, তা আসলেই আশংকাজনক। প্রতি বছর যদি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ৫০০ শিক্ষার্থী কোটায় ভর্তি করে, তার অর্থাৎ ৫০০ যোগ্য শিক্ষার্থীকে অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করছে। একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবচেয়ে যোগ্যদেরকে বাছাই করে না, তখন সেটা তার প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি ও গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। ধীরে ধীরে এই প্রবণতা তাকে আরও দুর্বল করে ফেলে। জ্ঞানচর্চার বদলে শক্তিশালী সুবিধার বলয় বিশ্ববিদ্যালয়কে তার আদি চরিত্র থেকে বের করে দেয়। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পোষ্য কোটার ব্যাপারে একটা মজার গল্প আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্ম, বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ে ওঠা, সেখানেই ভর্তি হওয়া, সেই প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ এবং সেখানের গোরস্থানেই সবশেষে দাফন। এই গল্পের প্রেক্ষাপটকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। বুঝতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যায্য আচরণ সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটা ভয়ের মধ্যে রাখে। তারা প্রথম থেকেই বুঝে নেয়, বিভাগের ভালো ফলাফল করা শিক্ষক পুত্র অথবা কন্যাই একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবে। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু শুরুতে তার প্রতি ন্যায়বিচার করেনি; যেহেতু তার একজন সম্ভাব্য যোগ্য মেধাবীকে সহপাঠী হিসেবে নেয়নি; মেধা তালিকার একদম তলানি থেকে শক্তিশালী সুবিধাপ্রাপ্ত একজনকে তুলে এনেছে, সেজন্য মুখরোচক গল্পের সূচনা হয়।
পোষ্য কোটায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ভেতরেও হীনমন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। সেটার প্রভাব একাডেমিক জীবন থেকে কর্মজীবন পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদে থাকতে পারে।
জুলাই বিপ্লবের পরে অযৌক্তিক কোটা গ্রহণকারীদের ভালোভাবে দেখার প্রবণতাও বেশ কমে যাবে। কারণ, সামাজিকভাবে যেকোনো অযৌক্তিক কোটার বিরুদ্ধে সবার একটা তীব্র প্রতিক্রিয়াবোধ সৃষ্টি হয়েছে। জুলাইয়ে রাজপথের এত রক্ত মানুষকে অন্যায্যতার বিপক্ষে লড়াই করতে শিখিয়েছে। এত কিছুর পরেও অযৌক্তিক কোটা জুলাইয়ের রক্তের সঙ্গে বেইমানি।
বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটা বাতিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অনড় অবস্থানে থেকে তাদের দাবি আদায়ে প্রস্তুত। জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশে যেখানে অযৌক্তিক কোটার কারণে হাজারো মানুষের রক্ত ঝরেছে; গণআন্দোলনের মাধ্যমে একটি সুসজ্জিত ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে; বন্দুকের সামনে গিয়ে ছাত্র-জনতা লড়াই করেছে; জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশে সুবিধাবাদের সিলসিলাকে তারা প্রত্যাখ্যান করবে, এটাই স্বাভাবিক।
সেই নতুন বাস্তবতায় কোটা পদ্ধতির সর্বাত্মক সংস্কার দরকার। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটাসহ সব অযৌক্তিক বিশেষ সুবিধাপ্রথা বাতিলে গণদাবি তুলতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচারের মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া বিশেষ সুবিধা বিলোপে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্র সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ জরুরি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যৌক্তিকভাবে কোটা পদ্ধতিকে সাজাতে হবে। যেন যোগ্যরাই সেই কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পায়। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আদিবাসী বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্যান্য অংশের জন্য কোটা আসলে কতটুকু অপ্রয়োজনীয়, সেটিও বোঝা দরকার। অযৌক্তিক কোটার বিলোপ করে শিক্ষাকেন্দ্রে মেধাবীদের মূল্যায়ন করাটা সার্বজনীন দাবি।
Comments