বাংলাদেশকে জড়িয়ে ভারতীয়দের অপতথ্যের প্রবাহ: কী ঘটছে আসলে?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর এবং ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থবিরতার সুযোগে বেশকিছু রাজনৈতিক হামলার ঘটনা ঘটে এবং সেই সময় সংখ্যালঘুরাও আক্রান্ত হন। তবে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাজনৈতিক পরিচয় বা আক্রোশের বশবর্তী হয়ে এসব হামলার ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে প্রচার করা হয়, যেখানে বড় ভূমিকায় ছিল ভারত থেকে পরিচালিত এক্স অ্যাকাউন্ট ও ভারতীয় বেশ কিছু গণমাধ্যম।
বাংলাদেশের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের ইনভেস্টিগেশন ইউনিট ৫ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সে (সাবেক টুইটার) এমন ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করেছে, যেখানে বাংলাদেশের আগস্টের ঘটনাবলির বিভিন্ন ছবি, ভিডিও ও তথ্যকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে প্রচার করা হয়।
গণমাধ্যমের পাশাপাশি অপতথ্যের এই প্রবাহে ভূমিকা রেখেছেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) রাজনীতিবিদ শুভেন্দু অধিকারী ও অগ্নিমিত্রা পাল, পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার দানিশ কানেরিয়া, সুইডেনে একাধিকবার কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় অভিযুক্ত সালওয়ান মোমিকা, দীর্ঘদিন ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখক তসলিমা নাসরিন, ভারতীয় গণমাধ্যম অপি ইন্ডিয়ার সম্পাদক নুপুর শর্মার মতো ব্যক্তিরা।
আগস্টে যেসব অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে তার মধ্যে ৫৯টি শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এ ছাড়া, সেপ্টেম্বরে চারটি, অক্টোবরে সাতটি এবং নভেম্বরে ৩১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানটি। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত ১৯টিসহ এই সময়কালে সর্বমোট ১২০টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে৷
আজ বুধবার প্রকাশিত রিউমর স্ক্যানারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক্স অ্যাকাউন্টগুলোর প্রতিটির অন্তত একটি পোস্টে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে প্রচারিত পোস্টগুলো এক কোটি ৫৪ লাখের বেশি বার দেখা হয়েছে।
আরও একাধিক অ্যাকাউন্ট ও ভারতীয় গণমাধ্যমের কল্যাণে এসব অপতথ্য সেই সময় ১০ থেকে ১২ গুণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল বলে অনুমান করে রিউমর স্ক্যানার।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভুয়া ও অপতথ্য ছড়ানো এসব অ্যাকাউন্টধারীর ৭২ শতাংশই ভারতে থাকেন বলে উল্লেখ করেছেন।
ভারতের একাধিক গণমাধ্যম আগস্টে দাবি করে, বাংলাদেশে বেশকিছু নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখে, দাবিটি মিথ্যা।
সনাতন ধর্মাবলাম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই কমবেশি সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার থেকে শুরু করে অপতথ্য, ভুল তথ্য এবং সর্বোপরি গুজব প্রচারের হার বাড়তে থাকে। রিউমর স্ক্যানার ভারতীয় এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারিত এমন দুইটি দাবি যাচাই করে দেখেছে যে সেগুলো মিথ্যা। এই পোস্টগুলো অন্তত সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক বার দেখা হয়েছে। সেগুলো হলো— ফরিদপুরে বিষাক্ত মদপানে দুই হিন্দু তরুণীর মৃত্যুকে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড দাবি এবং ২০২৩ সালে ঢাকার দোহারে মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ের বলে দাবি।
নিয়মিত ভুয়া তথ্যের প্রচারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি যোগ দেয় ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোও। ড. ইউনূসের শারীরিক অসুস্থতা কিংবা ট্রাম্পের জয়ে ড. ইউনূস দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন শীর্ষক ভুয়া দাবি প্রচার করে ভারতের গণমাধ্যম।
এ ছাড়া, ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে হিযবুত তাহরীরের নেতা হিসেবে গ্রেপ্তার আবদুল্লাহ আল মাহফুজকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম দাবি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানার পরবর্তীতে নিশ্চিত করে যে দুজন ব্যক্তি আলাদা।
১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগ শহীদ নূর হোসেন দিবস পালনের ঘোষণা দিলে এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া এক হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে শীর্ষক একটি দাবি ভাইরাল হয় এক্সের অসংখ্য অ্যাকাউন্টে। পোস্টগুলো প্রায় আট লক্ষাধিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। আসলে এমন কিছুই ঘটেনি বলে প্রমাণ পায় রিউমর স্ক্যানার।
নভেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পাকিস্তানের জাহাজ আসার ভুয়া দাবি করে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলা।
২৫ নভেম্বর জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন চট্টগ্রামে আদালতে হাজির করা হলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনা সৃষ্টিকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেন একদল আইনজীবীও। সেখানে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এটি নিয়েও নানা মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ায় ভারতের মিডিয়া ও এক্স অ্যাকাউন্টগুলো।
রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আগস্টে যেসব এক্স অ্যাকাউন্ট অপতথ্য ছড়িয়েছে, এখনো সেই অ্যাকাউন্টগুলো থেকেই অপতথ্য ছড়ানোর নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে। এসব অ্যাকাউন্টে অনুসারী বিপুলসংখ্যক থাকায় অপতথ্যগুলো দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে ইন্টারনেটে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণার পদ্ধতিতে একটি স্বতন্ত্র প্যাটার্ন লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার। যার মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আক্রান্তের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক ঘটনা দাবি, রাজনৈতিক সহিংসতাকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হিসেবে দেখানো, আক্রান্ত হওয়া মুসলিম বা তাদের সম্পত্তির ভিডিওকে হিন্দুদের ওপর হামলার ভিডিও হিসেবে প্রচার, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানকে একটি জঙ্গি বা ইসলামিক শাসনের উত্থান হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার দাবি উল্লেখযোগ্য।
অন্য যেকোনো কারণেই কোনো হিন্দু ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হলে ইচ্ছাকৃতভাবেই সেটাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে।
রিউমর স্ক্যানার তাদের প্রতিবেদনে বলছে, এই অপতথ্যের প্রচার শুধু ভারতের সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল, এমন বলা যাবে না। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও এই প্রবাহে অবদান রেখেছে। তাদের রিপোর্ট প্রায়ই অতিরঞ্জিত বা বিভ্রান্তিকর হওয়ার পরও বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া আউটলেটের জন্য তথ্যের সূত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই পরিষদ নয়টি সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের দাবি করে। নেত্র নিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই দাবিকে অসত্য বলা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে মৃত্যুর কোনো ঘটনাই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এর পরিবর্তে সাতটি ঘটনাকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, জনতার সহিংসতা বা অপরাধমূলক বিরোধের জন্য দায়ী করা হয়েছিল।
রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণ বলছে, এক্সে আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে নিয়ে ছড়ানো অপতথ্যগুলো দেখা হয়েছে অন্তত ২০ কোটি বার। এসব অপতথ্য গণমাধ্যমের সামাজিক প্লাটফর্ম ছাড়াও প্রচার করা হয়েছে টেলিভিশন ও প্রিন্ট সংস্করণেও। ফলে অগণিত মানুষের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা গিয়েছে।
Comments