কৃষকের স্বার্থে কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সমবায়ী ব্যবস্থা
ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাজারে অত্যধিক দাম সবকিছুর। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক পাল্টেছে, কিন্তু বাজারব্যবস্থা এখনো বদলায়নি। পুরোনো আড়তদার তাই ইতোমধ্যেই তার পুরোনো পরিচয় মুছে এখনকার ক্ষমতাপ্রাপ্তদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে বাজারব্যবস্থা থেকে গেছে ঠিক আগের মতোই। অথচ দেশের মানুষের দৈনিক গড় আয় এখন ২৫৩ টাকা ৮ পয়সা। বর্তমানের বাজারের দুই কেজি চাল আর দুই কেজি সবজি কিনতে গেলেই যা শেষ হয়ে যায়।
বছর দুয়েক আগে এই বাজারব্যবস্থা নিয়েই আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল 'শুদ্ধস্বরে'। লেখার শিরোনাম ছিল 'বাজার ব্যবস্থার নতুন বিন্যাস'। ওই লেখায় দেখানো হয়েছিল—একজন কৃষক এক কেজি সবজি বিক্রি করছেন ১০-১৫ টাকায়। অথচ ভোক্তাকে তা কিনতে হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। দুই-আড়াই টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে কৃষকের পটল, বেগুন, শসা, ঝিঙা; অথচ ভোক্তা তা কিনছেন ২৫-৩০ টাকায়। মাঝখানে এই পাঁচ থেকে দশগুণ অর্থ কারা হাতিয়ে নিচ্ছে? জবাবটা আমাদের অজানা নয়। মধ্যস্বত্বভোগী-অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে কৃষক-ভোক্তা উভয়েই জিম্মি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তাই একটি রূপরেখা দাঁড় করবার চেষ্টা করা হয়েছিল লেখাটিতে। সেটি ছিল এরকম: 'ভোক্তার ক্রয় দরের ৭৫ শতাংশ মূল্য বাধ্যতামূলকভাবে চাষি বা উৎপাদক পাবেন।'
এরপর দীর্ঘ দুই বছর কেটে গেল। কিছুদিন আগে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক আবুল ফজল সেই ভাবনার সঙ্গে নতুন একটি বিষয় সামনে আনলেন। সেটি হলো—কৃষকের উৎপাদন খরচের দিক থেকে মূল্য নির্ধারণ। আমারও মনে হয়, কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করতে গেলে পণ্যের উৎপাদন খরচের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। সেটি ছাড়া পণ্যের চাহিদার হেরফের, আকস্মিক দুর্যোগ কিংবা ঋতুজনিত কারণে কৃষকের ঠকবার বড় একটা ঝুঁকি থাকে। এরপর ভাবনাটা দাঁড়ায় এরকম—'কৃষকের লভ্যাংশ উৎপাদন খরচের ৫০ শতাংশের কম হবে না। আর ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের বিক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের ১০০ শতাংশের বেশি হবে না।'
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো একটি পণ্যের উৎপাদন খরচ বিশ টাকা হলে কৃষককে ত্রিশ টাকা দিতেই হবে, আর সেটা বাজারে কোনভাবেই ৪০ টাকার বেশি দরে বিক্রি হতে পারবে না।
এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের সংবিধানে কি কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ? বাংলাদেশ সংবিধানের 'মূলনীতি' অংশে (১৪ অনুচ্ছেদ) কৃষক ও কৃষিপ্রশ্নে বলা রয়েছে, 'রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে কৃষক ও শ্রমিককে…সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা৷'
তারপরও দেশ যদি বিপরীতমুখে চলে তাহলে আইনগতভাবে সেটাকে প্রতিহত করার কোনো পথ সৃষ্টি করা হয়নি। আবার মালিকানা প্রশ্নে সংবিধানে (১৩ অনুচ্ছেদ) বলা হয়েছে, 'উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালিসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ।'
এই মালিক বা নিয়ন্ত্রক 'কৃষিসমাজ বা কৃষক' না বলে 'জনগণ' বলার মাধ্যমে অকৃষিসমাজকে এখানে সমানভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আর অকৃষিসমাজ অর্থাৎ ব্যবসায়ী—মুনাফালোভী গোষ্ঠী যখন কৃষিব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের কাজে অন্তর্ভুক্ত হয় তখন নিশ্চিতভাবেই কৃষকদের (কিংবা ভোক্তা) স্বার্থ থেকে নিজেদের স্বার্থরক্ষা তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই বলা চলে সংবিধানের উপর্যুক্ত দুটি বক্তব্য পরষ্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বিপরীতার্থক হওয়ায় এর মাধ্যমে কৃষকের মুক্তির কোনো পথ সৃজিত হয়নি।
বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে 'সমাজতন্ত্র' কথাটা থাকলেও পণ্যদ্রব্যের পুরো সাপ্লাইচেইন রেখে দেওয়া হয়েছে 'বাজার'–এর হাতে। বাজারব্যবস্থার এই মধ্যস্বত্বভোগী-লুটেরা গোষ্ঠীর আধিপত্যের বিরুদ্ধে কৃষককে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিতে কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও। বরং দিন যত গেছে কৃষকের বীজের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছে করপোরেট গোষ্ঠীর হাতে।
সংবিধানকে বলা হয় রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড; আর আইন তার রক্তপ্রবাহ। রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের কাছে তাই দাবি থাকবে সংবিধানের 'সাম্যতা' রক্ষার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে কৃষক ও ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করার। আইনটির সারমর্ম হতে পারে এমন—কৃষকের লভ্যাংশ উৎপাদন খরচের ৫০ শতাংশের কম হবে না। আর ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের বিক্রয় মূল্য উৎপাদন খরচের ১০০ শতাংশের বেশি হবে না।
তবে শুধু আইন করে বসে থাকলে চলবে না। এটিকে সর্বনিম্ন অধিকার বিবেচনায় নিয়ে ধীরে ধীরে ব্যবস্থাটিকে আরও বেশি কৃষক-ভোক্তাবান্ধব, টেকসই, জনসম্পৃক্ততামূলক এবং জাতীয় অর্থনীতির শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় আধুনিক তাপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সম্বলিত হিমাগার তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে পণ্য পরিবহনের জন্য সারাদেশে 'লং-রুট' সিস্টেমের আওতায় একটা ট্রেন চ্যানেল তৈরি করা জরুরি৷
সেটি বাস্তবায়নের জন্য জরুরি একটি ফেডারেশন গড়াও কর্তব্য। ফেডারেশন সারাদেশে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করবে। ফেডারেশনের থাকবে নিজস্ব হিমাগার ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় এই ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া, সবজি-ফল যাতে নষ্ট না হয়, তার জন্য হিমায়িত যানও প্রয়োজন। হিমায়িত সাধারণ যান ও হিমায়িত রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণ ইতোমধ্যে অন্যদেশে শুরু হয়েছে। পাশের দেশ ভারতেও হিমায়িত রেলে করে পণ্য পরিবহণ করা হয় । এছাড়া ভারত সরকার সম্প্রতি 'কিষান রেল' চালু করেছে। ট্রাকের থেকে রেলে পণ্য পরিবহণ করা যায় অনেক বেশি। জানা যায়, একটা রেল-ওয়াগনে ট্রাকের তুলনায় তিন গুণের বেশি পণ্য পরিবহণ করা যায়। উল্লেখ্য, এই পরিবহণগুলো সব ধরনের টোলের আওতামুক্ত থাকতে হবে।
দ্রুত পচনশীল পণ্যগুলোর ক্রয়-বিক্রয় প্রধানত স্থানীয় জনসমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে। অন্যান্য সংরক্ষণশীল পণ্য, যেমন- চাল, ডাল, ছোলা, তেল, লবণ, আটা, হলুদ, রসুন, লবণ, পেঁয়াজ (অত্যাধুনিক ব্যবস্থায় সংরক্ষণ সাপেক্ষে), বিভিন্ন মশলা এগুলোকে একটি ফেডারেশনের মাধ্যমে পরিচালিত করা যায়। যেহেতু স্থানীয় জনসমবায় দ্রুত পচনশীল পণ্য বণ্টনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে এবং ফেডারেশন অর্থসহ অন্যান্য সহায়তা দেবে, সেহেতু জনসমবায় লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশ ফেডারেশনকে প্রদান করবে। অন্যদিকে ফেডারেশন সংরক্ষণশীল পণ্যের দেখভালের দায়িত্ব নিলে বিলি-বণ্টনের সহযোগী হিসেবে জনসমবায়কে লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশ দেবে। এক্ষেত্রে ফেডারেশনের 'নিট আয়' জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে।
জাপান সমবায়কে অর্থনীতির তৃতীয় খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। জাপানে ৯১ ভাগ কৃষক সমবায়ের সদস্য। জাপানে বর্তমানে ৩৬ হাজার সমবায় সংগঠন আছে, যা ছয় লাখ ৪০ হাজার কর্মীর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এসব সমবায় সংঘঠনের সদস্য ৮০ মিলিয়ন।
জাপানের জেন-নোহ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ কৃষি সমবায়গুলোর একটি ফেডারেশন। নিউজিল্যান্ডের জাতীয় মোট উৎপাদনের ২২ শতাংশ আসে সমবায় খাত থেকে। সিঙ্গাপুরের ভোগ্যপণ্যের বাজারের ৫৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে সমবায়গুলো। ফ্রান্সের প্রতি ১০ জন কৃষকের নয়জনই সমবায়ী। কোরিয়ায় ৯০ শতাংশ কৃষক সমবায়ী, কুয়েতে খুচরা বাজারের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সমবায়ের মাধ্যমে।
উল্লেখ্য, সমবায়ের সদস্যরা নিজেরাই হবেন সমবায়ের মালিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার তাদের কাছেই থাকবে। পণ্যের উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। তবে বাংলাদেশে সমবায় অকার্যকর এবং আমলা-নিয়ন্ত্রিত হয়ে আছে। সেখানে আমলাদের কঠোর খবরদারি আছে। সমবায় আইনটিকে আমলাতান্ত্রিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি আইনে রূপ দেওয়া হয়েছে। সমব্যয় আইনে বলা হয়েছে, 'যে সকল সমিতিতে সরকারের শেয়ার, ঋণ বা উক্ত সমিতির গৃহীত ঋণের ব্যাপারে সরকারের গ্যারান্টি রহিয়াছে সে সকল সমিতিতে সরকার, নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে, কোনো প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তাকে উহার নির্বাহের জন্য প্রেষণে নিয়োগ করিতে পারিবে।' আইন, বিধিসহ এমন নানান জটিলতার কারণে এ সমবায়গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দাঁড়াতে পারছে না।
ফেডারেশন কীভাবে কাজ করবে সেটি বোঝার জন্য আলাপটি চাল দিয়ে শুরু করা যায়। কারণ চাল (অন্যান্য অনেক দেশে যেমন গম) বাংলাদেশের মানুষের ক্যালরি চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশ এবং প্রোটিনের প্রায় অর্ধেক পূরণ করে। সে কারণে এবং পণ্যটি পচনশীল না হওয়ায় বিশেষ বিবেচনা প্রয়োজন।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে প্রতিমণ বোরো ধান উৎপাদনে খরচ হয় ৯৬৪ টাকা। কৃষক পর্যায়ে প্রতি মন বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। এক মণ ধানে গড়ে ২৫ থেকে ২৮ কেজি চাল হয়ে থাকে। প্রতিকেজি চালের উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩৭ টাকা। কিন্তু বস্তা হিসেবে কিনলেও ভোক্তাকে এক কেজি চাল কিনতে খরচ করতে হয় কমপক্ষে ৫৫ টাকা।
অর্থাৎ, মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিকেজি চালের দামে কমপক্ষে ১৮ টাকা বাড়তি যোগ করছেন। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কৃষকদের মাত্র ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ সরকার নির্ধারিত সংগ্রহমূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেন। লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ জানাচ্ছেন, ধান-চালের 'বাজার' ব্যবস্থাটা মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশাল এক আনন্দদায়ক ক্ষেত্র। উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যবর্তী জায়গায় অন্তত পাঁচ-ছেয় স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী মধ্যস্বত্বভোগী আড়তদার এবং অটো রাইস মিলগুলো ('মিলার'ও বলা হয়)। বাংলাদেশে প্রভাবশালী মিলারের সংখ্যা মাত্র ৫০ বলে উল্লেখ করা হয়। তার মানে মুষ্টিমেয় কিছু প্রভাবশালীদের হাতে চালের বাজার কব্জা হয়ে আছে। উল্লিখিত স্তরগুলোতে মুনাফা সংগ্রহের পর ভোক্তার কাছে গিয়ে চালের দাম অনেক বেড়ে যায়। অথচ তা থেকে উৎপাদক কিছুই পায় না। এসব ধাপের প্রত্যেকটিতে আছে ধান অর্থনীতির অ-চাষি সুবিধাভোগী।
বর্তমানে ১ মণ বোরো ধানের উৎপাদন ব্যয় ৯৬৪ টাকা। তার মানে প্রতিমণ বোরোধান কৃষকের কাছ থেকে ১ হাজার ৪৪৬ টাকা দরে কিনতে হবে। সেক্ষেত্রে দেখা যায় খুদজাতীয় বা তুষের হিসাব বাদে প্রতিকেজি চালের (এক মণ ধানে ২৫ কেজি চাল ধরে) বিপরীতে দাম আসে ৫৭ টাকা ৮৪ পয়সা। প্রতিকেজিতে গাড়িভাড়া, মিলভাড়া বা অবকাঠামো, প্যাকেজিং ও শ্রমিক মূল্য ধরলে কেজিতে মোট খরচ দাঁড়ায় ৬০ টাকা ৫৫ পয়সা। আবার প্রতিমণ ধানে কালো চাল, কাটা চাল, খুদ ও পলিশ পাওয়া যায় প্রায় ৪ দশমিক ৭৮ কেজি। কেজিপ্রতি যার গড় মূল্য ৩০ টাকা। আবার প্রতিমণ ধানে প্রায় ১০ কেজি তুষ পাওয়া যায়। বিক্রি হয় ১২ টাকা কেজিতে। এগুলোর মাধ্যমে প্রতিকেজি চালের বিপরীতে ১০ টাকা ৫৩ পয়সা বাদ যায়। তার মানে প্রতি কেজি চালের মূল্য দাঁড়ায় ৪৭ টাকা ৩২ পয়সা। সেটা বাজারে ৫০ টাকায় বিক্রি হলে, প্রতি কেজি চালে দেশে রাজস্ব হিসেবে ২ টাকার অধিক অর্থ যুক্ত হবে। এতে করে লাভবান হবেন কৃষক, ভোক্তা, রাষ্ট্র সকলেই। শুধুমাত্র জাতীয় রাজস্ব নয়, এটি চালু করা গেলে কৃষক প্রতি কেজি ধান এখনকার থেকে প্রায় ১০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করতে পারবেন এবং ভোক্তাও প্রতিকেজি চাল বর্তমান মূল্যের তুলনায় ১০-২০ টাকা কমে কিনতে পারবেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, কৃষক পর্যায়ে এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয় ১০ টাকা ৫১ পয়সা। জমি তৈরি, সার, বীজ, মজুরি, সেচ, কীটনাশক, জমির লিজ ব্যয় এবং ঋণের সুদসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এই খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কৃষককে প্রতিকেজি আলুতে কমপক্ষে ১৫ টাকা ৭৬ পয়সা দিতে হবে এবং যার বাজারদর কোনোভাবেই ২১ টাকা ২ পয়সার বেশি হবে না। ফেডারেশন ব্যবস্থায় এই বাজারমূল্যকে আরও কমিয়ে আনা যাবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রতি কেজি আলুর দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত।
বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে এক কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ হয় ২৭ টাকা ৭৩ পয়সা। সেক্ষেত্রে, কৃষককে প্রতি কেজি পেঁয়াজে কমপক্ষে ৪১ টাকা ৫৯ পয়সা দিতে হবে এবং যার বাজারদর কোনোভাবেই ৫৫ টাকা ৪৬ পয়সার বেশি হবে না। বর্তমান বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ১১০-১২০ টাকা।
ডিসিসিআইয়ের তথ্যমতে, এক কেজি হলুদ উৎপাদন করতে কৃষকের ব্যয় হয় ৩৪ টাকা ৭৬ পয়সা। অর্থাৎ কৃষককে প্রতি কেজি হলুদে অবশ্যই ৫২ টাকা ১৪ পয়সা দিতে হবে এবং যার বাজারদর কোনোভাবেই ৬৯ টাকা ৫২ পয়সার বেশি হবে না। বর্তমানে এক কেজি হলুদের গড় খুচরা বিক্রয়মূল্য ৩২৩ টাকা ৩৮ পয়সা অর্থাৎ বৃদ্ধি হলো ৮৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
লেখক বিল ম্যাককিবেনের মতো দায়বদ্ধ পরিবেশবাদী কিউবা, ব্রাজিলের করিতিবা ও পোর্তো আলেগ্রে এবং ভারতের কেরালার বাজারব্যবস্থাকে এভাবেই দেখেছেন, যেখানে বাজারের শক্তিগুলোর ওপর সবকিছু ছেড়ে না দিয়ে সামাজিক পরিকল্পনার ওপর অনেকটা জোর দেওয়া হচ্ছে।
দেশের বর্তমান বাজারব্যবস্থা জাতীয় আয় বাড়াতে সহায়ক নয়। এতে করে লাভটা যায় ব্যবসায়ী নামক মুষ্টিমেয় একটি অউৎপাদনশীল গোষ্ঠীর নিকট। নতুন ফেডারেশন ব্যবস্থা দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে একটি মুখ্য অর্থনৈতিক খাত হিসেবে কাজ করতে পারে। কৃষক-ভোক্তার সুবিধাপ্রাপ্তির পাশাপাশি এটি জাতীয় আয় বাড়াতে যেমন সহায়ক হবে, তেমনি সমাজের ব্যাপকসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটাবে।
রাহুল বিশ্বাস: লেখক ও গবেষক
Comments