ফিলিপাইনের ভিগান: ঘুরতে পারেন যেসব ঐতিহ্যবাহী স্থান

ফিলিপাইন
ছবি: সংগৃহীত

অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি গোটা বিশ্বে এশিয়ার দেশগুলোর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির রয়েছে ব্যাপক সমাদর। তারমধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী সংস্কৃতির ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফিলিপাইন। জাঁকজমক শহর থেকে শান্ত দ্বীপ পর্যন্ত বিচিত্রতার সঙ্গে এখানে এমন এক ভিন্নতা রয়েছে, যার সঙ্গে এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর কদাচিৎ সাদৃশ্য মেলে। পশ্চিম ফিলিপাইন সাগরের কোলঘেঁষে দেশের বৃহত্তম দ্বীপ লুজোনের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ভিগান ঠিক তেমনি একটি শহর।

প্রায় তিন শতাব্দী পূর্ব স্প্যানিশ শিল্পকলা ও ঔপনিবেশিক স্থাপত্য এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে এই দ্বীপ নগরীতে। চলুন, ফিলিপাইনসের সাগর পাড়ের ছবির মতো শহর ভিগানের সেরা পর্যটন আকর্ষণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

ভিগান শহরের বিশেষত্ব

ফিলিপাইনের ইলোকোস সুর প্রদেশের এই রাজধানী দেশের অবশিষ্ট স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শহরগুলোর মধ্যে একটি, যার পুরোনো অবকাঠামোগুলোর বেশিরভাগই অক্ষত আছে। এর পায়ে হাঁটা পথ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি স্থাপনায় স্পষ্ট চোখে পড়ে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক যুগের অনন্য স্থাপত্যশৈলী। ইউনেসকো প্রথমে নগরীটিকে তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তীতে এটি ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী শহর হিসেবেও স্বীকৃতি পায়। ২০১৫ সালের মে মাসে ভিগানকে নিউ ৭ ওয়ান্ডার সিটিগুলোর মধ্যে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।

ভিগান শহরের জনপ্রিয় কয়েকটি দর্শনীয় স্থান

কালি ক্রিসলগো

স্প্যানিশ শৈলীর চিহ্নগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ভিগানের মেস্টিজোতে, যার প্রাণকেন্দ্র এই কালি ক্রিসলগো। এখানকার বাড়িগুলো মূলত ১৭ শতকের ফিলিপিনো-চীনা ব্যবসায়ীদের পরিবারের। সারিবদ্ধ মুচির এই রাস্তাগুলোর ওপর দিয়েই বিপণী হতো সেই সময়কার বিখ্যাত অ্যাবেল কাপড়, সোনা ও তামাকের।

ঘরগুলোর ছাদের লাল টাইলস, অত্যধিক মোটা দেয়াল, বৃহদাকৃতির দরজা, সিঁড়ির ধাপ, উঁচু সিলিং এবং জানালা পর্যন্ত স্লাইডিং ক্যাপিজ শেল ছবি তোলার দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড দেয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এগুলো টিকে রয়েছে শত শত প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের ভেতর দিয়ে। যে অংশগুলো ভেঙে গেছে তা অবিলম্বে মেরামত করে নিয়েছে বসবাসরত পরিবারগুলো। কেবল পূর্বসূরিদের ভিটে-বাড়ি বলেই নয়, বিগুয়েনরা (ভিগানের স্থানীয়দের জাতিগত নাম) বেশ শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির।

কিছু কিছু স্থাপনা পরিণত হয়েছে দোকান, জাদুঘর, সরাইখানা ও রেস্তোরাঁয়। অথচ এগুলোর গ্রিল ও কাঠের সূক্ষ্ম কারুকাজ এখনো দর্শনার্থীদের মনে করিয়ে দেয় তিন শতাব্দীর আগের সময়ের কথা।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয় সেই ১৮ শতকের প্রদীপ জ্বালানো রাস্তার আলো-আঁধারি পরিবেশ, যা পর্যটকদের আরও বিমোহিত করে তোলে।

প্লাজা সালসেডো

ভিগানের একদম কেন্দ্রে অবস্থিত এই প্লাজা ও এর আশপাশ শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট।

মধ্যযুগীয় স্প্যানিশ ঘরানায় বানানো প্লাজা সালসেডোকে ঘিরে রয়েছে টাউন হল, শপিং সেন্টার, গির্জা ও ফুড কোর্ট।

প্লাজার ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে একটি কৃত্রিম ফোয়ারা। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে চালু করা হয় এই শো। সপ্তাহান্তে এটি শুরু হয় রাত সাড়ে ৮টায়।

ফটোগ্রাফারদের প্লাজার যে দিকটি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে সেটি হচ্ছে ভিগান ক্যাথেড্রাল, যার আরেক নাম সেন্ট পল মেট্রোপলিটন ক্যাথেড্রাল। ১৫৭৪ সালে নির্মিত এই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল একটি চ্যাপেল হিসেবে। পরে ১৬৪১ সালে এটিকে গির্জায় রূপান্তর করা হয়, যেটি ১৮ শতকের শূন্য দশকে আবারও পুনর্নির্মিত হয়। ভিগানের ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট স্বীকৃতির অন্যতম কারণ হলো এই ভিগান ক্যাথেড্রাল।

সান্তা মারিয়া চার্চ

ইলোকোস সুরের এই রোমান ক্যাথলিক গির্জাটি ১৯৯৩ সালের ১১ ডিসেম্বর ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে মনোনীত হয়।

ফিলিপাইনের অন্যান্য শহরের গির্জাগুলোর থেকে অনেকটাই ভিন্ন। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত গির্জাটি রীতিমত দুর্গের মতো। গ্রানাইট পাথরের ৮৫ দাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি বেয়ে গির্জায় পর্যন্ত উঠতে হয়। তন্মধ্যে গ্র্যান্ড থ্রি-ফ্লাইট সিঁড়িটি গির্জার দরজার একদম সামনের উঠানে গিয়ে শেষ হয়। এখান থেকে নিচের সমভূমি এবং গোটা সান্তা মারিয়া শহরকে দৃষ্টিতে ধারণ করা যায়।

বান্তে চার্চ বেল টাওয়ার

উত্তর-পূর্ব ভিগানের বান্তে একটি পাহাড়ে অবস্থিত। এর ইটের কাঠামোর শীর্ষে যাওয়ার জন্য একটি ঘূর্ণায়মান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। এখান থেকে টাওয়ারের ঠিক মাঝখানে ঝুলানো বিশাল ঘণ্টাটি চোখে পড়ে। স্প্যানিশ শাসনামল ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইলোকোস থেকে শত্রুদের পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো ওয়াচটাওয়ারটি।

মিন্দোরো সৈকত

পশ্চিম ফিলিপাইন সাগর সংলগ্ন এই সৈকতে রয়েছে কালো কিন্তু মসৃণ ও সূক্ষ্ম বালি। এখানকার স্রোত বেশ শক্তিশালী, তাই সাঁতার বা গোসলে নামার আগে সাবধান থাকা প্রয়োজন। পশ্চিম উপকূলে থাকায় এই সৈকত সূর্যাস্ত দেখার জন্য একটি উপযুক্ত জায়গা।

ভিগানের স্থানীয় খাবার

অবকাঠামোগত দিক থেকে স্প্যানিশ উপনিবেশের প্রভাব থাকলেও খাবার ও রন্ধনশৈলীর দিক থেকে বিগুয়েনরা অনেকটাই চীন-ঘেঁষা। তবে সময়ের সঙ্গে বিবর্তনের মাধ্যমে যথেষ্ট স্বকীয়তা এসেছে উপকূলবর্তী খাবারে। তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে ভিগান লঙ্গানিস। রসুনে সমৃদ্ধ এই খাবারের বিশেষত্ব হচ্ছে হলুদাভ সসেজ। অল্প পানিতে রান্নায় পানি বাষ্পীভূত হওয়ার পর উদ্বৃত্ত চর্বিতেই ভাজা হয় লঙ্গানিসা। এই ভাজা চলতে থাকে বাদামি বর্ণ না আসা পর্যন্ত। ভিনেগারে ডুবিয়ে রাখলে স্বাদ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে।

কালি ক্রিসলগোর পর্যটকরা বরাবরই যে খাবারটি খুঁজে ফেরেন সেটি হচ্ছে পিনাক্বেট। কেননা কেবল সেরা পিনাক্বেট পাওয়া যায় বলেই নয়, এই স্থানটি পিৎজার জন্যই সুপরিচিত। এর প্রধান সামগ্রী হচ্ছে বেগুন, ওকড়া, করলা, রসুন, পেঁয়াজ, মটরশুঁটি ও টমেটো। ভিগানসহ গোটা ফিলিপাইনজুড়ে যে খাবারটিতে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা হলো—বিবিঙ্কা।

সাধারণত সংস্করণটি পিঠা তৈরির চাল দিয়ে পোড়ামাটির চুলায় রান্না করা হয় এবং পরিবেশন করা হয় কলা পাতায়। সকালের বা মাঝ-দুপুরের নাশতা হিসেবে খাওয়া এই খাবারটি বিশেষ করে ক্রিসমাসের মৌসুমে বেশি দেখা যায়। আরও দৃষ্টিগোচর ও সুস্বাদু করতে দেওয়া হয় মাখন, পনির বা নারকেলের গুঁড়া।

কোনো কোনো সংস্করণ ময়দা দিয়েও মিষ্টান্ন হিসেবে বানানো হয়। গ্যালাপং বিবিঙ্কার প্রধান উপকরণ গ্যালাপং (আঠালো চাল), পানি ও নারকেল দুধ। মাঝে মধ্যে পাকা কাঁঠালও দেওয়া হয়।

বর্তমানে পুডিংয়ের মতো দেখতে ক্যাসাভা বিবিঙ্কার প্রচুর চাহিদা। এটি বানানো হয় ক্যাসাভা চাল, নারকেলের দুধ ও কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে। এই ক্যাসাভা চালের পিঠার সঙ্গে পনির মিশিয়ে বানানো হয় রয়্যাল বিবিঙ্কা।

ভিগানের ঐতিহ্যবাহী উৎসব

বিগুয়েনদের স্বকীয়তার সরব উপস্থাপন দেখা যায় ভিগানের স্থানীয় উৎসবগুলোতে। ব্যাপক জনপ্রিয় খাবার লঙ্গানিসাকে কেন্দ্র করে তাদের রয়েছে পূর্ণাঙ্গ একটি উৎসব। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এই আনন্দ আয়োজনে থাকে পথনৃত্য প্রতিযোগিতা। এখানে অংশগ্রহণকারীরা লঙ্গানিসার বাহারি রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পোশাক পরেন। লঙ্গানিসা খাবার তৈরির তথা রান্নার প্রতিযোগিতাও থাকে আয়োজনে। এ ছাড়াও পরিবেশিত হয় কুচকাওয়াজ, যেখানে অংশগ্রহণ করে স্থানীয় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংস্থা ও স্কুল।

শহরের সর্বাধিক প্রতীক্ষিত উৎসবগুলোর একটি হচ্ছে ভিভা ভিগান বিনাত্বাতান ফেস্টিভ্যাল অব দ্য আর্টস। প্রতি বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহব্যাপী আয়োজিত এই উৎসবের উপলক্ষ হলো ভিগানের ঐতিহ্যবাহী অ্যাবেল বুননশৈলী। 'বিনাত্বাতান' শব্দটির মাধ্যমে তুলার শুঁটি পিটিয়ে বীজ অপসারণ করার প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়। এটি অ্যাবেল বুননের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

উৎসবের প্রধান আকর্ষণ থাকে পথনৃত্য প্রতিযোগিতা, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা এই অ্যাবেল বস্ত্র দিয়ে বানানো পোশাক পরেন। আয়োজনে আরও থাকে নানা ধরনের আর্টস প্রদর্শনী, ঐতিহ্যবাহী খেলার প্রতিযোগিতা এবং ক্যারাবাও (ভিগানের বুনো মহিষ) প্যারেড।

বাংলাদেশ থেকে ফিলিপাইন্সের ভিগান যাওয়ার উপায়

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপদেশটিতে ভিগানের নিকটবর্তী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে ৮২ কিলোমিটার দূরত্বের শহর লাওয়াগে।

আকাশপথে ঢাকা থেকে ব্যাংকক, দুবাই বা হংকংয়ে ট্রানজিট নিয়ে ফিলিপাইন্সের ম্যানিলা হয়ে লাওয়াগ যেতে হয়। এই যাত্রায় প্রায় পৌনে ১৭ থেকে ২৩ ঘণ্টা সময় লাগে। লাওয়াগ থেকে ভিগানের বান্তে পর্যন্ত আবার দেড় ঘণ্টার বাস যাত্রা আছে।

এ ছাড়া ম্যানিলায় অবতরণ করে সেখান থেকে বাসে করে ৭ ঘণ্টায় সরাসরি ভিগান যাওয়া যায়।

ভ্রমণকালীন প্রয়োজনীয় টিপস

ভিগানের মুচি পাথরের রাস্তায় পা পিছলে বা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বিশেষ করে আর্দ্র মৌসুমগুলোতে এই বিড়ম্বনা বেড়ে যায়। তাই হাঁটার সময় সাবধানতা অবলম্বনের জন্য ভাল ট্র্যাকশনের জুতা পরিধান করা জরুরি।

শহরের ইউনেসকো হেরিটেজ ভিলেজ ভ্রমণের সুযোগ হলে ঐতিহ্যবাহী ক্যালেসায় (ঘোড়ায় টানা দ্বিচক্রযান) চড়া উচিত।

ভিগানের আরও একটি মজার পরিবহন হলো ট্রাইসাইকেল, যেটি মূলত একটি ছোট্ট গাড়ি ও মোটরসাইকেলের অদ্ভুত সমন্বয়। এতে সর্বোচ্চ ছয়জন লোক যাতায়াত করতে পারে।

যাতায়াত ভাড়া ও শপিংয়ের ক্ষেত্রে সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে খুচরা মুদ্রা (ফিলিপাইন পেসো) রাখা উচিত। তা না হলে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করতে হতে পারে। প্রায় স্থানে দর্শনার্থীরা বড় নোট ভাংতি করার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনার শিকার হন।

ফিলিপাইনের ভিগান ভ্রমণ একইসঙ্গে এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শহর পরিদর্শন ও ইতিহাসের পাতায় পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার শামিল। মুচি পাথরের ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়া বা ক্যালেসায় চড়ার সময় মনে হবে যেন মধ্যযুগের স্পেন আবার পুনরুত্থিত হয়েছে। কালি ক্রিসলগো ও প্লাজা সালসেডো থেকে পাওয়া বিস্ময়ের ঘূর্ণিপাকে রীতিমত আন্দোলন ঘটাবে মিন্দোরোর আদিম সমুদ্র সৈকত। লঙ্গানিসের ভোজ আর উৎসবে বৈচিত্র্যের সর্বোচ্চ অভিকর্ষ টের পান প্রত্যেকটি ভিনদেশি পর্যটক। এরপরে বিবিঙ্কা চেখে দেখার পরেও তারা মুক্ত হতে চান না এই মুগ্ধতার বেড়াজাল থেকে। উপরন্তু, টাইম মেশিনে করে তিন শতাব্দীরও আগের সময়ে ভ্রমণের সুযোগ কে-ই বা হাতছাড়া করতে চান!

 

Comments

The Daily Star  | English

Sweeping changes in constitution

Expanding the fundamental rights to include food, clothing, shelter, education, internet and vote, the Constitution Reform Commission proposes to replace nationalism, socialism and secularism with equality, human dignity, social justice and pluralism as fundamental principles of state policy.

2h ago