কবরস্থান নাকি জীবন্ত ল্যান্ডমার্ক?

ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ায় মানুষ এসে সর্বপ্রথম কী দেখতে চায়? সিডনিতে এলে অবশ্যই অপেরা হাউস। কিন্তু আমি চাইলাম কবরস্থান দেখতে। যাকেই বলি, সেই অবাক হয়। পাগলও ভাবে মনে হয়! তো যাই যাই করে আর যাওয়া হয় না। এদিক যাই ওদিক যাই, কিন্তু সেখানে আর যাওয়া হয় না।

শেষমেশ সময় হলো, মানুষ পেলাম...সঙ্গে সঙ্গে দে ছুট! তাও গেলাম তো গেলাম ঈদের দিন! তখন পুরোদমে শীত। দ্বিতীয়বার গেলাম কিছুদিন আগে, এখন এখানে বসন্ত। কিন্তু খুবই অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, এখানে শীত, বসন্ত কোনো প্রভাব ফেলে না। জায়গাটা সবসময়ই ঠান্ডা, কেমন একটা হাড়কাঁপানো বাতাস। কে জানে, বিশাল সমুদ্রের মাঝে এত এত মানুষ বিশ্রাম নিচ্ছে বলেই হয়তো এই জায়গাটা জায়গাটা ঠান্ডা কিনা!

তো এবার আসি কেন কবরস্থান? 'দিল চাহতাহে' এই আইকনিক সিনেমা আমরা কে দেখিনি? এমন মানুষ পাওয়া কঠিন যে এই সিনেমা দেখেনি এবং জীবনে একবার 'তানহাই' গান শুনেনি। আমি যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিনই চিন্তা করে রেখেছিলাম কোনোদিন যদি সিডনি যাই, তাহলে অবশ্যই আমির খান তার 'তানহাই' গানে যে বিশাল সমুদ্রের পাশে কবরস্থানের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, সেখানে যাব। যেই ভাবনা সেই কাজ। চলে যখন আসছি সিডনি, তখন ইচ্ছা পূরণ করা তো জায়েজ।

জায়গাটার নাম ওয়েভারলি সিমেট্রি। সমুদ্রের সঙ্গে আকাশ মিশে গেছে এখানে, আর চারদিকে সাদা সাদা কবরের ক্রস সাইন। এই জায়গাটা এমন একটা জায়গা যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য আর জীবনের নির্মম সত্য এক হয়ে মিশে আছে হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে! আজকের গল্প সিডনির এই পূর্ব শহরতলিতে অবস্থিত কবরস্থান কেন্দ্র করে।

সিডনির পূর্ব শহরতলিতে ব্রোন্টের উপকূলীয় ক্লিফের পাশে অবস্থিত ওয়েভারলি সিমেট্রি কেবল একটি সমাধিক্ষেত্র কোনোভাবেই নয়, বরং তার থেকেও অনেক বেশি কিছু। ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কবরস্থানটি অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম আইকনিক একটি স্থান, যা প্রশান্ত মহাসাগরকে উপেক্ষা করে তৈরি হয়েছে। আর এ কারণেই এটি সবার মাঝে পরিচিত। বুক ঝাঁঝরা করা সমুদ্রের দৃশ্য, বাতাসের মৃদু ফিসফিস এবং ঐতিহাসিক সমাধিস্তম্ভগুলো এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে অদ্ভুত সুন্দর হাহাকারমূলক অনুভূতি তৈরি করা স্থানগুলোর মধ্যে একটি!

ছবি: জিবু

ওয়েভারলি কবরস্থানের সৌন্দর্য

এখানে আসার পর প্রথম যে জিনিসটি ধাক্কা দেয় সেটা হলো সাদা মার্বেল হেডস্টোন এবং সমুদ্রের আকাশী নীলের মধ্যে অত্যাশ্চর্য বৈসাদৃশ্য। ওয়েভারলি কবরস্থান দিগন্তের দিকে প্রসারিত, সমাধির পাথরগুলো ঢেউয়ের মতো তার ঢালে নেমে আসে—প্রতিটি ইতিহাসের একেকটি নীরব সাক্ষী। ভিক্টোরিয়ান ও এডওয়ার্ডিয়ান ডিজাইনের এই সমাধিগুলোর এক সময় বেঁচে থাকার গল্প বলে, নিরবচ্ছিন্নতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। স্থাপত্যগুলো শিল্পের রূপে শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। বড় বড় ক্রস, দেবদূতের ভাস্কর্য এবং সিডনির বহু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রমাণ হিসেবেই যেন খোদাই করা হয়েছে একেকটি পাথরে।

যখন ক্লিফসাইড পথ ধরে হাঁটছিলাম, কেমন একটা প্রশান্তির অপ্রতিরোধ্য অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখছিল। কোলাহলপূর্ণ শহর থেকে অল্প দূরত্বে থাকা এই কবরস্থানটি আরেক পৃথিবীর মতো মনে হয়—এমন একটি জায়গা যেখানে সময় ধীর হয়ে যায়! জীবনের স্থিরতা-অস্থিরতা দুইই এসে কেমন এলোমেলো করে ফেলে সব।

এখানে আছে গোছানো সুন্দর বাগান, আছে ক্লিফসাইড ট্রেইল-বিখ্যাত বন্ডি থেকে কুজি হেঁটে যাওয়ার পথ। পুরো রাস্তাটাই খুবই সুন্দর। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এখানে বিশেষভাবে যাদুকরী মুহূর্ত। সূর্যের আলো সমাধির পাথরগুলোকে সোনালি রঙে স্নান করায়, ঢেউগুলো সুর তুলে তুলে নিচের পাথরের কাছে আছড়ে পড়ে।

বিশাল বড় এই কবরস্থানে ছোট ছোট অনেকগুলো লুক আউট আছে যেখান থেকে বিশাল সমুদ্র দেখা যায়। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি! নীল পানি যখন আছড়ে পড়ে নিচের বড় বড় পাথরে, সেটা হয়ে যায় ধবধবে সাদা! সাদা-নীলের এই খেলা চলতেই থাকে, মুগ্ধতা বাড়াতেই থাকে।

ইতিহাসে নিমজ্জিত একটি স্থান

ওয়েভারলি কবরস্থান ঐতিহাসিক কারণেও বেশ সমৃদ্ধ। এখানে লেখক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়া কিংবদন্তিসহ অনেক বিশিষ্ট অস্ট্রেলিয়ানদের কবর রয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন বিখ্যাত কবি হেনরি লসন, যার সমাধি সাহিত্য উত্সাহীদের জন্য একটি তীর্থস্থান। এই কবরস্থানটি সিডনির বহু সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি মর্মস্পর্শী অনুস্মারক হিসেবেও কাজ করে, যা বিভিন্ন ধর্মের, জাতির ও সামাজিক পটভূমির প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিটি সমাধিপাথর শহরের অতীতের একটি আভাস দেয়—বিজয়, ট্র্যাজেডি সবই মিলেমিশে দাঁড়িয়ে আছে।

ওয়েভারলি কবরস্থানের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেন বিগত সময়ের মাঝে ফিরে যাওয়ার মতো। কিছু শিলালিপি ১৯ শতকের, সেই যুগের ভাষা, রীতিনীতি ও সামাজিক মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। অনেক কবর আদিবাসীদের, যারা ভীষণ কষ্টের মুখোমুখি হয়েছিল, লেখা আছে সেই গল্পগুলোও!

ছবি: শিশির

কবরস্থানের চেয়েও বেশি: একটি জীবন্ত ল্যান্ডমার্ক

মৃতদের জন্য একটি জায়গা হওয়া সত্ত্বেও ওয়েভারলি কবরস্থান পুরোটাই জীবন্ত গল্প-স্মৃতি ও সংযোগের, যা দাঁড়িয়ে আছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এটি একটি সাংস্কৃতিক ল্যান্ডমার্কও, হাঁটতে থাকলে পুরো একটা ঐতিহাসিক ট্যুর হয়ে যায়।

আপনি যখন এই পথ ধরে হাঁটবেন, অনেকটা আমির খানের মতোই আপনিও আসলে হারিয়ে যাবেন নিজস্ব চিন্তায়, অসীম সমুদ্রের মাঝে জীবনের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলো ভীষণভাবে নাড়া দেবে। এটি এমন একটি জায়গা, যা আমাদের জীবন এবং মৃত্যু, উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি, স্থায়ীত্ব এবং ক্ষণস্থায়ীতার মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্যের কথা মনে করিয়ে দেয় বারবার।

এখানে একটা মায়া আছে। জীবন-মৃত্যুর গল্প আছে। শান্ত-অশান্ত ভাবনা আছে। ঠান্ডা বাতাসেও উষ্ণতা আসে। তাই হয়তো এই জায়গাটা আমার ভীষণ প্রিয়। আমার কাছে মনে হয় এই ক্লিফসাইড অভয়ারণ্যে, সাদা মার্বেলগুলো ফেরেশতাদের মতো প্রয়াতদের দেখে-শুনে রাখছে আর নীল সমুদ্র অন্তহীন সুর তুলে তাদের গান শোনাতে ব্যস্ত। এখানকার একেকটি মুহূর্ত একেকটি শান্ত প্রতিধ্বনি, যা সময়কে অতিক্রম করে চলেছে। জানিনা কেন, কিন্তু এখানে এসেই আমার মনে হয়েছে সৌন্দর্য সত্যিই সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত জায়গায় দেখা যায়।

Comments

The Daily Star  | English

Tax-free income limit may rise to Tk 3.75 lakh

The government is planning a series of measures in the upcoming national budget to alleviate the tax pressure on individuals and businesses, including raising the tax-free income threshold and relaxing certain compliance requirements.

12h ago