পাকস্থলীর ক্যানসার কেন হয়, লক্ষণ ও প্রতিরোধ
বিশ্বব্যাপী সকল ক্যানসারের মধ্যে পঞ্চম স্থানে রয়েছে পাকস্থলী বা স্টমাক ক্যানসার। ক্যানসার সংক্রান্ত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে পাকস্থলী ক্যানসার। পাকস্থলীর ক্যানসার সম্পর্কে জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এফ কে চৌধুরী চঞ্চলের কাছ থেকে।
পাকস্থলীর ক্যানসার কেন হয়
ডা. এফ কে চৌধুরী বলেন, বিশ্বব্যাপী সকল ক্যানসারের মধ্যে পঞ্চম স্থানে রয়েছে পাকস্থলী বা স্টমাক ক্যানসার। ক্যানসার সংক্রান্ত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে পাকস্থলী ক্যানসার। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে চীন, জাপানে পাকস্থলীর ক্যানসার সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে পাকস্থলী ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন কারণে এই ক্যানসার হতে পারে। যেমন-
১. হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ পাকস্থলী ক্যানসার হওয়ার অন্যতম কারণ।
২. এ ছাড়া অতিরিক্ত ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, খাবারে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া বা লবণাক্ত খাবার, ধোঁয়াযুক্ত খাবার, নাইট্রেট, নাইট্রাইড ও সেকেন্ডারি অ্যামাইনযুক্ত খাবার পাকস্থলী ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৩. যাদের পরিবারে পাকস্থলীর ক্যানসারের ইতিহাস আছে যেমন- বাবা-মা, ভাই-বোন বা ছেলে-মেয়ে যদি কারো পাকস্থলী ক্যানসার থাকে তাহলে তাদের এই ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। চিকিৎসাশাস্ত্রে এটিকে ফ্যামিলিয়াল ক্যানসার সিনড্রোম বলা হয়, যেমন- ফ্যামিলিয়াল অ্যাডেনোমেটাস পলিপোসিস, ফ্যামিলিয়াল নন-পলিপোসিস কোলরেক্টাল ক্যানসার, জিনগত পরিবর্তন, এপস্টাইন-বার ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে পাকস্থলী ক্যানসার হতে পারে।
৪. পারনিসিয়াস অ্যানিমিয়া নামক একটি রোগ আছে যা ভিটামিন বি১২, ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতির জন্য হয়ে থাকে। পারনিসিয়াস অ্যানিমিয়া থেকে পাকস্থলী ক্যানসার হতে পারে।
৫. দীর্ঘদিন যদি কারো গ্যাস্ট্রাইটিস বা পাকস্থলীর প্রদাহ থাকে তাদেরও পাকস্থলীর ক্যানসার হতে পারে।
৬. কারো যদি কোনো কারণে পাকস্থলীতে অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে তাদের সাধারণত অস্ত্রোপচারের ২০ বছর পর পাকস্থলী ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৭. রবারের কারখানা, ধাতু ও কয়লা খনিতে দীর্ঘদিন কাজ করেন যেসব শ্রমিক এবং কাঠ বা অ্যাসবেস্টস নিয়ে কাজ করেন যারা তাদের পাকস্থলী ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
লক্ষণ
ডা. এফ কে চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে সব ক্যানসারই সাধারণত দেরিতে শনাক্ত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা না পড়ার কারণে চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। পাকস্থলী ক্যানসারের ক্ষেত্রে লক্ষণ হিসেবে অনেক রোগীর ডিসপেপসিয়া থাকে অর্থাৎ উপরের পেট ভরা ভরা, বমি বমি ভাব, পেট জ্বালাপোড়া। এ ধরনের সমস্যা নিয়ে আসা অনেক রোগীর অ্যান্ডোস্কোপি করার পর পাকস্থলীর ক্যানসার শনাক্ত হয়। এ ছাড়া পেটে ব্যথা, কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া, খাবার গিলতে সমস্যা হওয়া, ক্ষুধামন্দা, খাবারে রুচি কমে যাওয়া, রক্তশূন্যতা, পেটে চাকা অনুভূত হওয়া, কালো পায়খানা হওয়া, রক্ত বমি পাকস্থলী ক্যানসারের গুরুতর লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
রোগীর লক্ষণ, পারিবারিক ইতিহাস ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে সন্দেহে হলে পাকস্থলী ক্যানসার আছে কি না তা শনাক্ত করার জন্য আপার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অ্যান্ডোসকপি বা অ্যান্ডোসকপি করতে হবে। রোগ কোন স্টেজে আছে এবং কতখানি ছড়িয়েছে তা নির্ণয় করার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। যাদের তীব্র ডিসপেপসিয়ার লক্ষণ আছে, বিপদ চিহ্ন আছে এমন রোগীদের অবশ্যই পাকস্থলী ক্যানসার আছে কি না তা পরীক্ষা করতে হবে।
পাকস্থলী ক্যানসারের চিকিৎসা হচ্ছে অস্ত্রোপচার। যদি রোগী আর্লি স্ট্রেজে আসে এবং মেটাস্ট্যাটিস না থাকে, টিউমার যদি ছড়িয়ে না যায় তাহলে অস্ত্রোপচারের পর কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি দেওয়ার পর রোগী ভালো হয়ে যায়।
ক্যানসার কোন স্টেজে আছে মূলত তার ওপর নির্ভর করেই চিকিৎসা দেওয়া হয় রোগীকে। যদি আর্লি স্টেজে থাকে তাহলে এক ধরনের চিকিৎসা আর যদি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে চিকিৎসার ধরন আলাদা হবে। টিউমারের বৃদ্ধি, আকার ও অবস্থা বুঝে প্রয়োজন অনুযায়ী পাকস্থলীর কিছু অংশ আবার কখনো পুরোটা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়।
এ ছাড়া কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি এবং টার্গেটেড ড্রাগ থেরাপি দেওয়া হয়। অনেক সময় ক্যানসারের আকার বড় হলে সেক্ষেত্রে কেমোথেরাপির মাধ্যমে সেটি ছোট করে এনে অস্ত্রোপচার করা হয়।
ডা. এফ কে চৌধুরী বলেন, হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া এই ক্যানসারের অনত্যম কারণ তাই শুরুতে এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ শনাক্ত করা এবং অ্যান্টি এইচ পাইলোরি থেরাপি দিলে সেটি আর হবে না।
পাকস্থলী ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি। যেসব কারণে পাকস্থলীর ক্যানসার হতে পারে সেসব থেকে দূরে থাকতে হবে। ধূমপান, অ্যালকোহল পরিহার করতে হবে। জীবনযাত্রা ও খাদ্যভাসে পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন- ধোঁয়াযুক্ত, লবণযুক্ত খাবার এবং নাইট্রেট, নাইট্রাইড যুক্ত খাবার পরিহার করা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি খেতে হবে।
Comments