প্রতি ৯ ঘণ্টায় অন্তত ১ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়
২০১৮ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সে যৌন সহিংসতার ভয়াবহতার শিকার হন মরিময় (ছদ্মনাম)।
পরিবারের সঙ্গে যে বস্তিতে মরিময় থাকতেন সেখানে এক মধ্যবয়সী লোক তাকে ধর্ষণ করে।
সেদিন ছোট্ট সেই শিশুটি তার জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিল তার দাদি ও বস্তির অন্যান্য নারীর কাছে। যাদের মধ্যে একজন অ্যাক্টিভিস্টও ছিলেন।
তবে তার দাদি নাতনির সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনার বিচার না চেয়ে 'সামাজিক অসম্মানে'র কথা চিন্তা করে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেন।
বস্তির সেই অ্যাক্টিভিস্ট শিশুটির আইনি সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করলেও কেবল দাদি নয় অন্যদের কাছেও মুখ্য হয়ে ওঠে 'সামাজিক মর্যাদা'র বিষয়টি।
এমনকি যখন পুলিশ আসে তারা ঘটনাটিকে 'নেহায়েত গুজব' বলে উড়িয়ে দেন। যার ফলে সেই ধর্ষক একরকমের দায়মুক্তি পেয়ে যায় বস্তির অন্যান্য শিশু ও নারীকে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে।
২০১৮ সালে ব্লাস্টে প্রকাশিত 'হোয়াই রেপ সারভাইভারস স্টে আউট অব কোর্ট: লেসনস ফ্রম প্যারালিগাল ইন্টারভেনশনস' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের একটি কেস স্টাডির অংশ ছিল এটি।
তারপর বাংলাদেশে এই পরিস্থিতির খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েই গেছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪ হাজার ৭৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬২৭ জন। তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৩২৯ এ।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতি ৯ ঘণ্টায় একটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেই দেখা যায় গত চার বছরে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত দুজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিসংখ্যান থেকে প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব নয়, কারণ অনেক ধর্ষণের ঘটনাই নথিবদ্ধ হয় না।
ন্যাশনাল গার্ল চাইল্ড অ্যাডভোকেসি ফোরামের ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকটের মধ্যে মিডিয়া কাভারেজে নারী, কন্যা এবং সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠীর দুরবস্থা ঢাকা পড়ে গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং আসকের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্নাও এ বিষয়ে তার উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। আমরা সংবাদপত্রের তথ্যের উপর নির্ভর করি এবং যখন দরকার হয় পুলিশের কাছ থেকে মামলার বিষয়ে যাচাই করি। স্বাভাবিকভাবেই, ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে না গেলে এই সংখ্যাও কম দেখায়।'
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'আমরা হিসাব করে দেখেছি প্রতি ১০০টি ঘটনার মধ্যে প্রায় ৩০টি ঘটনাই রিপোর্টিং হয় না।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনা কমাতে কোনো মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন হয়নি বরং নিরাপত্তাহীনতা, বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা এবং আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় ধর্ষকদের দায়মুক্তি অব্যাহত রেখেছে।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সামাজিক ক্ষমতার গতিপ্রকৃতি একই থাকে। আর তাই লিখিত অভিযোগ কমলেও, প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন।'
ধর্ষণের ঘটনার এক তৃতীয়াংশেরই মামলা হয় না
গণমাধ্যমে আসা ৪ হাজার ৭৮৭টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৪১৯টির। যার অর্থ ধর্ষণের ঘটনার তিনটির মধ্যে কমপক্ষে একটি ঘটনার কখনো মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয়নি।
নারী অধিকারকর্মী খুশি কবির এজন্য আইনি ব্যবস্থা সহায়তার অভাবকে দায়ী করেছেন। 'নারীরা আদালতে যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন এবং ৮-১০ বছর পর্যন্ত মামলা টানতে হতে পারে। এর ফলে অভিযোগকারীদের পক্ষে মামলার ব্যয়, সামাজিক চাপ এবং দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।'
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'মামলা করলেও একজন ভিকটিম ন্যায়বিচার পাবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাহলে তারা কেন এগিয়ে আসবেন?'
তিনি বলেন, ধর্ষণ মামলাগুলো ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা থাকলেও অধিকাংশই অমীমাংসিত থেকে যায় এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা বিরল।
'আদালত একা ন্যায়বিচার দিতে পারে না, কারণ মামলা দায়ের, তদন্ত পরিচালনা এবং সাক্ষী উপস্থাপনের ৯৯ শতাংশ প্রক্রিয়া রাষ্ট্র পরিচালিত। ত্রুটিপূর্ণ এই ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার অভাব ভুক্তভোগীদের মামলা এবং অভিযোগ দিতে নিরুৎসাহিত করে যা শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার দিতে আদালতের ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করে।'
২০১৮ সালের ব্লাস্ট গবেষণার লেখক আইন গবেষক তাকবীর হুদা, এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণ না থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেন।
'এই ধরনের ব্যবস্থা না থাকলে, ধর্ষকরা ভুক্তভোগী পরিবারকে সামান্য অর্থ দিয়ে তাদের দায়মুক্তি কিনতে পারে। প্রথমে মামলা করতে না দেওয়া বা পরে মামলা ছেড়ে দিতে তাদের বাধ্য করতে পারে।'
২০০৭ সালে আইন কমিশন ক্রাইম ভিকটিমস কমপেনসেশন অ্যাক্টের খসড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও আজও এটি আলোর মুখ দেখেনি। যার ফলে ধর্ষণ ও সহিংসতার শিকার ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করে।
২০২০ সালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান
কম দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা ২০২০ সালে প্রবর্তিত মৃত্যুদণ্ডের বিধানকেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন।
তাকবীর হুদা বলেন, বিচারকরা বর্তমানে কেবল যাবজ্জীবন কিংবা মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে পারেন, যা কেবল সবচেয়ে গুরুতর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'মৃত্যুদণ্ডের প্রভাব সামান্যই কাজ করে। বরং অনেক সময় মামলার রায়ে না পৌঁছানোর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। প্রতিটি ফৌজদারি মামলায় কোনো বিচ্যুতি ছাড়াই যুক্তিসঙ্গতভাবে অপরাধ প্রমাণ করা প্রয়োজন। মৃত্যুদণ্ড প্রায়শই আইনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে ন্যায়বিচার বিলম্বিত করে।'
প্রতি ৫ জনের ৩ জনই শিশু
পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, এই সময়ের মধ্যে শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ২ হাজার ৮৬২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিন জনই শিশু।
মামলা থেকে দেখা গেছে ভুক্তভোগীদের ৪৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর।
জেডআই খান পান্নার মতে, শিশুরা প্রায়ই যৌন সহিংসতার শিকার হয় কারণ তাদের বয়স কম, সচেতনতা কম এবং তারা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানে না।
তাদের প্রতিবাদ করতে না পারার অসহায়ত্বের সুযোগ কাজে লাগায় অপরাধীরা। তাদেরকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে বলে জানান তিনি।
গত ১২ অক্টোবর বাড়িতে ব্যাগ পৌছে দিলে ২০০ টাকা দেওয়ার কথা বলে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি নয় বছর বয়সী একটি শিশুকে ধর্ষণ করে।
ভয়াবহ যৌন সহিংসতার শিকার শিশুটির শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে তাকে অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শিশুটির মা জানান, তার পেট কেটে সেখানে আলাদাভাবে মল বের করার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। চিকিৎকরা চেষ্টা করছেন তার স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থা ফেরাতে। তবে তার ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েই গেছে।'
জেড আই খান পান্না বলেন, 'যদি প্রতিটি স্কুলে বাধ্যতামূলক মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ চালু করা হয় এবং পাঠ্যসূচিতে যৌনশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা এবং পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে পারে।'
শিশু অধিকার সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, নীরব থাকার সংস্কৃতি পরিবারের মধ্যে যৌন নির্যাতনকে বাড়িয়ে তোলে।
'ছোটবেলা থেকেই শিশুদের প্রায়ই নির্যাতনের ব্যাপারে চুপ থাকার জন্য চাপ দেওয়া হয়, বিশেষ করে সেটা যদি পরিবারের ভেতরে হয়। দোষারোপ বা অবিশ্বাসের ভয় তাদেরকে নীরবে এই নির্যাতন সহ্য করতে বাধ্য করে।'
রোকসানা সুলতানা শিশুদের নিজেদের শরীর সম্পর্কে সচেতনতা, শারীরিক সীমা সম্পর্কে জানা এবং 'না' বলা শেখানোর ওপর জোর দেন।
বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'দুর্বল রাষ্ট্র ব্যবস্থা সব ধরনের সহিংসতায় ইন্ধন জোগায়।'
জেড আই খান পান্না বলেন, যতক্ষণ না নারী ও মেয়েদের সুরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ আমরা তাদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধ কমাতে পারব না।
Comments